|
|
|
|
বাবা জ্ঞান দিয়ো না |
ডাগ আউট নয় নখ-আউট |
কেকেআর ডাগ আউটে
বসেছেন বেশ কয়েক বছর। দেখেছেন মাঠের
অনেক সিংহই
আসলে ভিতুর ডিম।
আসলে এই উপত্যকায় বসলে মাথার চুল আর হাতের নখ
দু’টোই
আক্রান্ত
হতে থাকে। নিজের অভিজ্ঞতা জানাচ্ছেন জয়দীপ মুখোপাধ্যায় |
আর তো মাত্র কয়েক ঘণ্টা।
তার পরেই কলকাতা নাইট রাইডার্স নেমে পড়বে রাজস্থান রয়্যালস-য়ের বিরুদ্ধে খেলতে। জয়পুরে।
গত বুধবার। এ বারের আইপিএল শুরুর আগে টিভিতে আগের বারের ফাইনাল দেখাচ্ছিল।
চোখের সামনে যেন ২৭ মে ২০১২-র ফ্ল্যাশ ব্যাক দেখতে পেলাম। ডাগ আউটে আমার চোখ জলে ভিজে। জয় ভট্টাচার্য (কেকেআর-য়ের ম্যানেজার) হাউহাউ করে কাঁদছে। দশ-পনেরো মিনিট তো বিশ্বাসই করতে পারিনি যে আমরা আইপিএল জিতেছি। শাহরুখ গ্যালারি থেকে নেমে এসে ডাগ আউটে সবাইকে জড়িয়ে ধরছে।
কান্না তো পাবেই। ডাগ আউটেই তাই কেঁদে ফেললাম আমরা।
আগে ড্রেসিং রুমটাই ছিল সুখ-দুঃখ-রাগ দেখানোর জায়গা। কিন্তু সেটা তো বন্ধ দরজা। সবার সামনে এমন হাট করে খুলে রাখা ডাগ আউট নয়। যেখানে রাগ-অভিমান সব প্রকাশ্যে। টি টোয়েন্টি ম্যাচে ডাগ আউট হয়ে দাঁড়াল ড্রেসিং রুম আর মাঠের মিসিং লিঙ্ক। আর আইপিএল-য়ে ড্রেসিং রুমটা রয়ে গেল শুধু টয়লেট হিসাবে।
কিন্তু ডাগ আউটে কোনও দরজা নেই, তার মানে কিন্তু এই নয় যে, সবাই তাদের ইমোশনকে চেপে রাখে। চেপে রাখবেই বা কী ভাবে? সুনীল নারিন কম কথার মানুষ। ডাগ আউটেও নিজের স্বভাবসিদ্ধ মৌনতা বজায় রাখে। মনবিন্দর বিসলা আবার উল্টো। সব সময় কথা বলে। কিন্তু সে সবই ক্রিকেটীয় কথা। কোথায় ওর ভুল হচ্ছে? কোথায় ফুটওয়ার্কে গণ্ডগোল হল, সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নেয়। |
|
ছবি: উৎপল সরকার |
কোচ বেলিসও আবার নারিনের মতো অল্প কথার মানুষ। চেনাজানা হয়ে গেলে আবার ওর মতো মিশুকে মানুষ কমই আছে। ২০১২য় যখন বেলিস কোচ হয়ে আসে, ও তো আর জানত না কেকেআর ডাগ আউটে সৌরভ থাকা আর না-থাকার পার্থক্য। ও ক্লিন স্লেটেই শুরু করেছিল। একটাই ব্যাপার, টিমের কী অবস্থা, সেটা ডাগ আউটে ওকে দেখেই বুঝতে পারবেন। এতটাই খোলা মনের বেলিস।
কেকেআর-য়ে অনেক পরিবর্তনের সাক্ষী আমি। তিন কোচকেই খুব কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছে। বুকানন তো একেবারে হেডমাস্টার। সব কিছুই ওর কপিবুক স্টাইলে চাই। এই সিচ্যুয়েশনে এই করতে হবে, ওই সিচ্যুয়েশনে ওইটা। এমনকী ডাগ আউটে কে কোথায় বসবে তার একটা লিস্ট পর্যন্ত থাকত বুকাননের কাছে। আর অস্ট্রেলিয়া থেকে আসা সাপোর্ট স্টাফ। সাপোর্ট স্টাফেই তো ডাগ আউট ভরে যেত, আমরা বসব কী! কখনও কখনও আমরা বসতাম আইস বক্সের উপরে।
এ অবস্থার পরিবর্তন হয় হোয়াটমোর আসার পর। আমরাও আইস বক্সের বদলে পাকাপাকি ডাগ আউটে বসতে পারলাম। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়াতেই বিশ্বাসী। কপিবুকে নয়। তাতে সুবিধা হত এই যে ডাগ আউটে প্লেয়াররা অনেক রিল্যাক্সড থাকতে পারত। আমার মতে সেটাই সব থেকে ভাল পথ। আরে স্ট্র্যাটেজি এ-বি-সি নয় তৈরি থাকল, কিন্তু সিচ্যুয়েশন এক্স এলে বুকানন কোথায় যাবে? সেটার স্ট্র্যাটেজি তো আর তৈরি নেই।
কোচদের মধ্যে পরিবর্তন এলেও, এই একটা ব্যাপারে কেকেআর এখনও কেকেআর-য়েই আছে। অধিনায়ক বদলে গিয়েছে। কিন্তু দুই অধিনায়কের ব্যবহার একই আছে। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় আর গৌতম গম্ভীর। দু’জনেই কাম অ্যান্ড কমপোজড। দেখে বুঝবেন না কী ঘটছে ওদের মাথায়। সৌরভ যেমন ডাগ আউটের এক জায়গায় বসে থাকত, গম্ভীরেরও জায়গাও তেমন বাঁধা। গম্ভীরের তো প্যাড, গার্ড, ব্যাট রাখার জায়গাও নির্দিষ্ট। ও এলে আমরা উঠে সেগুলো রাখার জায়গা করে দিই। একটা ম্যাচে গম্ভীর একবার আউট হয়ে ফিরে প্যাড পরা অবস্থাতেই বসেছিল। সেই ম্যাচ জেতায় সেটাই হয়ে দাঁড়ায় লাকি চার্ম। সৌভাগ্য যে গত বার আর ওকে প্যাড পরে ডাগ আউটে বেশি বসতে হয়নি।
|
|
‘কুল’ ওয়াসিম আক্রম |
এমন অনেক সংস্কার কেকেআর-য়ের অনেক প্লেয়ারেরই। একটা ম্যাচে বালাজি অনেক মার খেয়েছে। সবাই ভাবছি কেকেআর ম্যাচটাই না হেরে যায়। হঠাৎ ওয়াসিম আক্রম উঠে বলল, “কেউ নড়াচড়া করবে না। নড়াচড়া করছ বলেই বালাজি মার খাচ্ছে। যে যার জায়গায় চুপটি করে বসে থাকো।” ডাগ আউটে এমন ‘সংস্কারাচ্ছন্ন’ হলে কী হবে, প্র্যাকটিসের সময় কিন্তু একেবারে অন্য মেজাজে আক্রম। ইয়ার্কি মারছে, গান করছে। জমিয়ে রাখছে কেকেআর।
জমিয়ে রাখায় কম যায় না শাহরুখ খান। প্রথম দু’টো সিজনে ডাগ আউটের কাছাকাছি থাকত। পরের দিকে গ্যালারিতে বসত। তবে ম্যাচের পরে ডাগ আউটে এসে কনগ্রাচুলেট করত। টিম হারুক কী জিতুক।
তবে মাঠে বা মাঠের বাইরে যে প্লেয়ারদের দাপট দেখে ভাবেন ভয়-ডর এঁদের ডিকশনারিতে নেই, তাঁদের বলব এক বার ডাগ আউটে বসুন না। বুঝবেন মাঠের বাইরের অনেক সিংহই আসলে ভিতুর ডিম। নখ খাওয়া আর ইষ্টনাম জপ করা ছেড়ে দিন। কালিস, ম্যাকেলাম, মনোজ— কাকে ছেড়ে কাকে বলব! প্রতি ম্যাচের পর ডাগ আউট পরিষ্কার করলে মনে হয় নখের ফ্যাক্টরি খোলা যেত।
তবে নখ খাওয়ায় প্রথম পুরস্কার অবশ্যই পাবে হোয়াটমোর। হাতের
নখ আর একটাও বাকি নেই। কেকেআর ডাগ আউটে কমন জোকস ছিল হোয়াটমোর কখন পায়ের নখ
খাওয়া শুরু করবে? অবশ্য আমিই
বা কাকে বলি! আমি তো নিজে
গলার লকেট ধরে বসে থাকি। জয় ভট্টাচার্য আবার মাঠের দিকেই তাকিয়ে থাকতে পারে না। এক মনে পায়ের কাছে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে। যেন ম্যাচের ভাগ্য ওখানেই দেখবে।
আসলে ডাগ আউট মানেই টেনশনের আঁতুড় ঘর।
ব্যতিক্রম, ওয়াসিম আক্রম। |
|
জমিয়ে রাখায় কম যান না শাহরুখ খানছবি: উৎপল সরকার |
সৌরভ-গম্ভীরের পর এই এক ‘কুল’ লোক দেখেছি। টিমের পরিস্থিতি যাই হোক না কেন আক্রমের শরীরী ভাষায় কোনও ছাপ পড়বে না। ডাগ আউটের পিছন দিকে ওর এক ফেভারিট সিট আছে। আমি বসতাম ওর পাশে। আমার বসার উদ্দেশ্য আক্রম কী করে গেম রিড করে সেটা বোঝা। আক্রমের মাস্টার প্ল্যানিংয়ের নমুনা একবার পেয়েছিলাম। আমি ডাগ আউটের পাশে একটা আইস বক্সের উপর বসে। জয়দেব উনদকট বল করছে। হঠাৎ আক্রম আমাকে ডেকে বলল, ড্রিংক্স ব্রেকের সময় গম্ভীরকে চুপিচুপি বলতে, যাতে ফাইন লেগকে একটু এগিয়ে আনে। আমিও মনোজকে কায়দা করে সেটা বলে দিলাম। ফল? ফাইন লেগে ক্যাচ ধরল ফিল্ডার।
সেই মাস্টার মাইন্ডই আবার ডাগ আউটে বসে জোকস ক্র্যাক করছে। প্লেয়ারদের মোটিভেট করছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় তো আক্রম দেখেছি সব সময় গান গাইছে। কী ডাগ আউটে, কী ক্যাচ প্র্যাকটিস দেওয়ার সময়। এটাই আসল মস্তানি।
আশা করি গত বারের মতো এ বারও কেকেআর আইপিএল-য়ে মস্তানিটা করতে পারবে। এ বার আমি আর ডাগ আউটে বসব না। এই দু’মাস ওই পয়েন্ট অব ভিউটা পাব না।
তবে নিশ্চিত, এ বারও ফাইনালের পর কেকেআর ডাগ আউট থেকেই মাঠের দিকে দৌড়ে যাবে সবাই। |
|
|
|
|
|