শহরের পুরনো বহুতল, বাজার বা হাসপাতালের ক্ষেত্রে যা হয়, টিভি সিরিয়ালের স্টুডিওর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না। রিজেন্ট পার্কের দাসানি স্টুডিওয় আগুনের জেরেও যেমন নড়েচড়ে বসেছে রাজ্য সরকার।
খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্বেগের পরিপ্রেক্ষিতে যেমন অচিরেই টেলিভিশন জগতের বিভিন্ন প্রযোজকের সঙ্গে বৈঠকে বসার কথা বলছেন মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। বস্তুত, এর আগেও কিন্তু সিরিয়াল-নির্মাতা বা প্রযোজকদের সঙ্গে বারংবার আলোচনায় বসেছেন অরূপবাবু। বিপদের আভাস পেয়ে কোনও কোনও ক্ষেত্রে শু্যটিং হয়তো কিছু দিনের জন্য বন্ধ থেকেছে। তার পরে আবার যে কে সে-ই। দাহ্য পদার্থে ঠাসা সেটে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শু্যটিংয়ের ধারা কিন্তু এখনও অটুট। অরূপবাবু নিজেও মানছেন, টিভি চ্যানেলগুলির রমরমার জেরে নিত্যনতুন বেআইনি স্টুডিও গজিয়ে উঠছে কলকাতা ও সংলগ্ন এলাকায়। কারও পরিত্যক্ত বাড়ি, বাগানবাড়ি বা ফ্ল্যাটেই সেট বানিয়ে কাহিনি-ভিত্তিক সিরিয়ালের শু্যটিং চলছে মাসের পর মাস ধরে।
‘ওয়েস্ট বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশন অফ টেলিভিশন প্রোডিউসার্স’ (ডব্লিউবিএটিপি) এবং ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশন অফ টেলিভিশন অ্যাফিলিয়েট্স’ (ডব্লিউবিএটিএ) এ রাজ্যের টিভি প্রযোজকদের এই দুই সংস্থার সঙ্গেই বৈঠকে বসা হবে বলে জানিয়েছেন অরূপবাবু। শনিবার তিনি বলেন, “এ বার স্টুডিওগুলোর জন্য দু’টি বিষয় বাধ্যতামূলক করা হবে। দমকলের ছাড়পত্র বা ফায়ার লাইসেন্স থাকতেই হবে। এবং যেখানে শু্যটিং হচ্ছে, সেই জায়গাটির নির্মাণগত স্থিতিশীলতা বা স্ট্রাকচারাল স্টেবিলিটি-র দিকটাও দেখতে হবে।”
কিন্তু বাস্তবে, স্টুডিওগুলোর জন্য এই নিয়মের শাসন কার্যকর করা কত দূর সম্ভব? টিভি সিরিয়াল নির্মাতারাই বলছেন, বাজেটের সীমাবদ্ধতার জন্যই ধারাবাহিক ভাবে নিরাপত্তার বিষয়টিতে আপস করা হয়। তা ছাড়া, নিরাপত্তা সংক্রান্ত কোন বিষয়টি কে দেখবেন, তা নিয়েও সিরিয়াল প্রযোজক বা স্টুডিও-মালিকদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি লেগে থাকে। কোনও স্টুডিওয় বিদ্যুতের ব্যবস্থা হয়তো স্টুডিও-মালিকের এক্তিয়ারভুক্ত। আবার কোথাও সিরিয়ালের প্রযোজকই হয়তো সেটে জেনারেটরের ব্যবস্থা করে নিচ্ছেন। প্রযোজকদের প্রশ্ন, কোনও পুরনো বাড়িতে শু্যটিং করা হলে, তার জন্য ছাড়পত্র তাঁরা কেন নিতে যাবেন? স্টুডিও-মালিকদের কারও কারও মত, অনেক সময়ে সেটের ত্রুটির জন্যও আগুন লাগতে পারে। তা হলে স্টুডিও-কর্তৃপক্ষকে কেন অহেতুক হয়রান করা হবে? |
সাধারণত, বাণিজ্যিক এলাকা বা জনবহুল স্থানে আগুন নিয়ে সতর্কতার যে বিষয়গুলিতে দমকল জোর দেয়, তা নিয়েও বহু স্টুডিও-মালিক বা প্রযোজকদের আপত্তি আছে। রিজেন্ট পার্কের যে স্টুডিওয় শুক্রবার আগুন লাগে, তার সিইও অমিতাভ দাসানিই বলেছেন, স্প্রিঙ্কলার বসালে জলে ভাসিয়ে সেটের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। এটা অনেক নির্মাতাও চাইবেন না। দমকল-কর্তারা কিন্তু বলছেন, আগুনের বিপদ এড়াতে শুধু স্প্রিঙ্কলার নয়, বেশ কিছু ছোট ছোট নিয়ম মেনে চললেও বিপদের আশঙ্কা অনেকটাই কমে। দমকলের ডিজি দুর্গাপ্রসাদ তারানিয়া বলেন, “দাসানি স্টুডিওতেই কয়েকটি ছোট ছোট বিষয় মাথায় রাখা হলে এতটা আতঙ্ক ছড়াত না।” যেমন, স্টুডিও থেকে বেরোনোর দরজা কোথায় ক’টি রয়েছে, সে বিষয়ে আগে থেকেই সবাইকে ওয়াকিবহাল করে রাখা যেত। স্টুডিওয় ইমার্জেন্সি আলোর ব্যবস্থা থাকলে এতটা আতঙ্ক ছড়াত না। আগুন নেভানোর যন্ত্র ব্যবহারে কলাকুশলীদের তালিম দেওয়া যেত। স্প্রিঙ্কলার না-থাকলেও স্টুডিওয় জলের জন্য হাইড্র্যান্ট রাখা যেতে পারত।
দাসানিদের অবশ্য দাবি, তাঁদের স্টুডিওয় জলাধার ছিল। কিন্তু স্টুডিওর আগুন নেভানোর ব্যবস্থা নিয়ে দমকল সন্তুষ্ট নয়। ওই স্টুডিওর বাড়ির মালিকানা নিয়েও সংশয় রয়েছে। স্টুডিওর কর্তা দাসানিরা ওই তল্লাটের পুরনো ভাড়াটে। ওই বাড়ির বিপুল পুর-কর বকেয়া। কারা এই কর মেটাবে, তা নিয়েও ধন্দে প্রশাসন। আর আগুন নেভানোর ব্যবস্থায় খামতির জন্য দমকলের তরফে স্টুডিও-কর্তা সম্পতরাও দাসানির (অমিতাভের বাবা) বিরুদ্ধে মামলা রুজু করা হলেও তাঁকে এখনও গ্রেফতার করা হয়নি। পুলিশের দাবি, অভিযুক্তকে পাওয়া যাচ্ছে না। অমিতাভ কিন্তু জানিয়েছেন, তাঁর বাবা ৭৭ বছরের বৃদ্ধ। এখন অসুস্থ। অমিতাভবাবু এ দিনও বলেছেন, একটা ছোট দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে। এখন ফের স্টুডিওয় শু্যটিং শুরুর অনুমতি দেওয়া হোক।
দমকল-কর্তারা কিন্তু স্পষ্ট বলছেন, আর কিছু ক্ষণ স্টুডিওর ভিতরে আটকে থাকতে হলেই মারাত্মক কোনও বিপদ ঘটতে পারত।
সমস্যাটা সিরিয়াল-নির্মাতারা যে বুঝছেন না, তা নয়। সকলেই জানেন, টিভি সিরিয়ালের ক্ষেত্রে সেটে ৫০-১০০ জন মিলে বদ্ধ জায়গায় অসম্ভব গরমের মধ্যে কাজ করেন। শু্যটিংয়ের দরকারে সেটেও বিস্তর দাহ্য পদার্থ থাকে। এই অবস্থায় আগুন লাগার সম্ভাবনা বিলক্ষণ থাকে। পোড় খাওয়া প্রযোজক বিশ্বজিৎ গুহের কথায়, “দমকল বা প্রশাসনের কাছ থেকে কয়েকটি বিষয়ে তালিম পেলে আমরা পরিস্থিতি কিছুটা উন্নত করতে পারি।” সদ্য আতঙ্কের ধাক্কা কাটিয়ে অভিনেত্রী রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়ও এ দিন বলেন, “একমাত্র সরকার কড়া হলেই আমরা নিরাপদ পরিবেশে টেলিভিশনের কাজ করতে পারব।”
দমকলের ডিজি বলছেন, “এ বার স্টুডিওগুলির বিরুদ্ধে আমরা অভিযান শুরু করব।” সেটা কবে? সদুত্তর অবশ্য মেলেনি।
|