এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে আমার ‘দিদি নম্বর ওয়ান’ এর সেট।
আগুন লাগার ঘটনা যে কী ভয়ঙ্কর হতে পারে শুক্রবার টালিগঞ্জের দাসানি স্টুডিয়োয় দাঁড়িয়ে স্বচক্ষে না দেখলে উপলব্ধি করতে পারতাম না।
আজ বেলা এগারোটা নাগাদ পয়লা বৈশাখের এপিসোডের শ্যুটিং শুরু হয়েছিল। কলকাতার বিভিন্ন বাঙালি প্রতিষ্ঠান কর্ণধার অথবা কণর্ধারের স্ত্রীরা ছিলেন অতিথি হিসেবে। খেলা জমে উঠছে বেশ। তৃতীয় রাউন্ড শেষ হতেই হঠাৎ একটা ভয়ঙ্কর শব্দ। উপরে তাকিয়ে দেখলাম একটা লাইট ফাটল। শ্যুটিংয়ের সময় এমন হামেশাই হয়। তার পরে দু’ তিন সেকেন্ড বুঝতে পারিনি কী হয়েছে।
আচমকা উপরে তাকিয়ে দেখি কুড়ি ফুট উঁচু সিলিংয়ে ছোট ছোট আগুনের ফুলকি থেকে হুহু করে আগুন দাবানালের মতো ছড়াচ্ছে। কারণ সিলিংটার গায়ে পাটের কাপড় মোড়া। সেটে তখন শুরু হয়ে গিয়েছে আতঙ্কিত চিৎকার। প্রাণ বাঁচাতে দিশাহারা হয়ে ছোটাছুটি চলছে। আর আমি দাঁড়িয়ে হতভম্বের মতো। এমন সময়ে কারা যেন আমাকে টেনে হিঁচড়ে বাইরে আনার চেষ্টা করতে লাগলেন। বারবার পিছন ফিরে ব্যাকুল হয়ে দেখছিলাম সেলিব্রিটি অতিথিরা, কলাকুশলীরা বেরোতে পারছেন কি না। মনে হচ্ছিল এক বার ভিতরে গিয়ে দেখে আসি, সেটটা কী অবস্থায় রয়েছে।
বেরিয়ে আসতেই দেখলাম স্টুডিয়ো চত্বরে অসংখ্য মানুষের ভিড়। তাঁদের চোখে মুখে আতঙ্ক। ‘দিদি নম্বর ওয়ান’ এর এসি ফ্লোর থেকে গলগল করে ধোঁয়া আকাশ ঢেকেছে। জানতে পারলাম ফ্লোরের সরু গেট দিয়ে ঠাসাঠাসি করে বেরোতে গিয়ে উপস্থিত অতিথি ও কলাকুশলীদের কেউ কেউ বেশ খানিকটা আহত হয়েছেন।
কারও মুখে-গায়ে লেগেছে আগুনের হল্কা। কেউ বা ধাক্কাধাক্কিতে আহত। |
ফ্লোরের গেট কার্বন ডাই অক্সাইডের চাপে নাকি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ধাক্কা দিয়ে খুলে লোকজনকে বার করে আনা হয়েছে। কিছুতেই যেন মেনে নিতে পারছিলাম না আমার ‘দিদি নম্বর ওয়ান’ এর সেটটা আর নেই। অঝোর ধারার কেঁদে চলেছি। কেবল মনে হচ্ছিল সবাই প্রাণে বেঁচে বেরিয়ে আসতে পারল তো? যত ভাবছি, তত হাত পা আতঙ্কে হিম হয়ে আসছে।
দমকলকর্মীরা ততক্ষণে হাজির। খুব তৎপরতার সঙ্গে আগুন নেভাতে গিয়ে তাঁদের মধ্যেও কেউ কেউ আহত হয়ে পড়লেন। অন্যদিকে নজর যেতে দেখলাম শো-এর অতিথিরা, কলাকুশলীরা কেউ খুঁজছেন মানিব্যাগ, কেউ বা খুঁজছেন ঘরের চাবি বা মোবাইল। সবই তো সেটের মধ্যে পড়ে রয়েছে।
ততক্ষণে আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। অন্যন্য ফ্লোরের শ্যুটিং বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সেখানকার শিল্পীদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থাও হচ্ছিল যত দ্রুত সম্ভব।
বারবার চারপাশের সকলকে কাতর অনুরোধ করছিলাম আমাকে একবারটি ফ্লোরের ভেতরে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কেবল মনে হচ্ছিল কেউ ভিতরে পড়ে রইল না তো! শেষ পর্যন্ত বহু অনুরোধের পরে ফ্লোরের কাছে পৌঁছে ভিতরে তাকিয়ে দেখলাম সেখানে ঘুটঘুটে অন্ধকার। সঙ্গে নাকে এল উগ্র পোড়া গন্ধ।
সেই মুহূর্তে কী যে হল আমার! চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলাম।
হাত-পা অবশ হয়ে আসছিল। জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম।
জ্ঞান ফিরল যখন, তখন নার্সিং হোমে। এখনও বসে যে লিখছি, মনের মধ্যে আতঙ্ক। আগুনের দৃশ্যগুলো কেবল চোখে ভাসছে। মনে পড়ছে প্রাণ ভয়ে সিঁটিয়ে যাওয়া আতঙ্কিত মানুষগুলোর মুখ।
স্টুডিয়োর মধ্যে এর আগে অগ্নিকাণ্ড বহু বার হয়েছে। কিন্তু তার পরেও স্টুডিয়ো মালিকেরা আগুন থেকে সুরক্ষার ব্যাপারে সতর্ক হননি। আজও তাঁরা উদাসীন। দাসানি স্টুডিয়োতে কোনও অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র ছিল না, ছিল না প্রচুর পরিমাণে জল সরবরাহের ব্যবস্থাও। এমনকী স্টুডিয়ো কর্তৃপক্ষের কাছে কোনও ফায়ার লাইসেন্সও ছিল না বলে শুনলাম। সব চেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এটাই, এই রকম নিরাপত্তাহীন, অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্যেই আমাদের কাজ করে যেতে হচ্ছে। আগামী দিনেও হয়তো করে যেতে হবে। সকলের কথা ভেবে সরকারের উচিত অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা করা। দরকার সরকারের কড়া নজরদারি। নইলে কি আমরা এ রকম জতুগৃহে বসেই অনন্তকাল বিনোদনের কাজ করে যাব! |