হাঁড়ির খবর
কুসুমে কুসুমে মুক্তিচিহ্ন
র্বভুক বলে কিছু হয় না। অমন সুরসিক ভোজনবিলাসী প্রতাপ রায়মশাই মাছ খেতেন না। চিংড়ি বিনা অন্য কোনও মাছ যে তিনি মুখে তুলতে পারেন না, তা বার বার ছাপার অক্ষরে কবুল করে গিয়েছেন। আবার এমন মানুষও আছেন ডিম যাঁর রোচে না। এমনিতে নিষিদ্ধ সব মাংস, বাঙালির শুঁটকি বা জাপানির কাঁচা মাছ সুশি-সাশিমি টপাটপ মুখে পুরছেন, কিন্তু ডিমের আঁশটে গন্ধটুকু না কি নিতে পারেন না!
আমার পরিচিত এমন এক আশ্চর্য মানুষও সে দিন ডিমের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ডিম বলতে অ্যাদ্দিন স্রেফ ওমলেট খেতেন। ডিমের কুসুম তাঁর কাছে অস্পৃশ্য। কলকাতার ফুটপাথের অপার্থিব লাল ডিমের কষা খেতেন কুসুম বাদ দিয়ে। পাঁচতারা হোটেলের মেনুতে ডুবে তিনিই ডিমের মহিমা আবিষ্কার করেছেন দেখা গেল।
পার্ক হোটেল তাদের মেনুতে এখন কেজ-ফ্রি এগের আমদানি করেছে। ব্যাপারটা নতুন কিছু নয়। সাদা বাংলায়, যাকে বলা যায় স্বাধীন মুরগিদের ডিম। মানে, মুরগিকে পোলট্রির খাঁচার ঘিঞ্জি গাদাগাদি থেকে মুক্ত খোলামেলা পরিবেশে রেখে যত্ন-আত্তিতে জন্মানো ডিম। পশুপ্রেমীরা অনেক দিনই এটাই মানবিক বলে সওয়াল করে আসছেন। পোলট্রির এইটুকুনি খাঁচায় মুরগিকে কষ্ট দেওয়ার তাঁরা বিরোধী। খাদ্য-বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ডিমই খেতে ভাল এবং পুষ্টিকর।
স্বাস্থ্যকর পরিবেশ ছাড়াও এই ডিমের জন্য মুরগিদের ডায়েটের দিকটাও মনে রাখা হয়। কেউ কেউ জৈবিক বা অর্গানিক দানা খাইয়ে অর্গানিক ডিম চাষেও নজর দিচ্ছেন।
পার্কে এই মুক্ত মুরগির ডিমের কুসুম ফিকে হলদে নয়। প্রায় হাঁসের ডিমের মতো কমলা-ঘেঁষা হলুদ। ফ্রায়েড আন্ডা পাতে নিয়ে ডিমে বীতস্পৃহ বন্ধুটি দেখি কুসুম ভেঙে খাচ্ছেন। একটু নুন-মরিচ ছড়িয়ে দিব্যি খাওয়া যায়। যে-সে ডিমের কুসুমে এই বাঁধুনি হয় না। কুসুমের এই রূপেই ডিমের জাত মালুম হবে।
কলকাতায় কেজ-ফ্রি ডিমের হাল-হদিস এখনও অনেকের অজানা। তবে পশুপ্রেমীদের আন্দোলনে পাঁচতারা হোটেলগুলো সাড়া দিচ্ছে। গত বছর হায়াত রিজেন্সি কলকাতায় কেজ-ফ্রি ডিম আমদানি করেছিল। দামে সাধারণ ডিমের ডবল। হায়াতের প্রাতরাশে এখন কেজ-ফ্রি ডিমেরই একাধিপত্য। পার্কও একই পথের পথিক। মাসখানেক ধরে সেখানে দ্য ব্রিজে চলছে মুক্ত মুরগিদের আন্ডা উৎসব। শেফ সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ও শোনালেন, প্রাতরাশের মেনু থেকে পুরনো ডিম বাতিল করে দিয়েছেন।
পাঁচতারায় খাওয়ার রেস্ত নেই, এমন অনেক রসিকই ডালহৌসি-লালবাজার-শিয়ালদহে ফুটের ধারে ডিম চাখবার সময়ে নিজস্ব ব্র্যান্ড পছন্দ করেন। সুবিধের জন্য দেশি হাঁস-মুরগির ডিমের গায়ে কান্ট্রি এগের আদ্যক্ষর ‘সি’ লেখা। রাজারহাটের কোনও চাষির সঙ্গে হটলাইট যোগাযোগে শুধু খুদে-খুদে লালচে দেশি ডিমের প্রবেশাধিকার। শোভাবাজারের বিখ্যাত মিত্র কাফের তরুণ ক র্ণধার তাপস রায়ও ডিমের ব্যাপারে বেজায় খুঁতখুঁতে। কবিরাজি কাটলেট বাঁধার জন্য পছন্দ স্বাদু দেশি  হাঁসের ডিম। আবার ব্রেকফাস্টে পোচ-হাফবয়েল নামাতে স্রেফ দেশি মুরগির ডিম ছাড়া চলবে না। পাঁচতারার কেজ-ফ্রি ডিম সেবনে ধাতস্থ যাঁরা, তাঁদের আক্ষেপ, এক বার এই ডিমে অভ্যেস হয়ে গেলে না কি কিছুতে পাতি পোলট্রি আন্ডা মুখে রোচে না।
হায়াতের এগজিকিউটিভ শেফ বিক্রম গানপুলে বা পার্কের দ্য ব্রিজে শেফ সুরজিতের কড়া নজরদারিতে রোজই ডিমের পরীক্ষা হয়। দুটো ডিম ভেঙে দেখলেই মালুম হবে, কেজ-ফ্রিতে কুসুমের রংটা গাঢ় তো বটেই সাদা অংশটাও বেশি থকথকে। দ্য ব্রিজের উৎসব এখন এই অনাস্বাদিতপ্রায় ডিমের তুকতাকে ভরপুর। পালকের মতো ফিনফিনে ছোট্ট-ছোট্ট লুচির সঙ্গে বাঙালি ঘরের মশলাদার লালচে ডিমের কষা পাঁচতারায় বিকোচ্ছে। চেখে কলকাতায় ফেরা এনআরআইকুল আবেগে কাঁপছেন। ব্রিজে এর নাম দেওয়া হয়েছে, ঝাড়গ্রামের ডিমের ঝাল। জঙ্গলমহলের গেটওয়ে ঝাড়গ্রামের সঙ্গে এমন ডিম কষার আত্মীয়তার ভিত্তি আছে বলে মনে হয় না। কিমার কোফতার পেটে আস্ত ডিমের নার্গিসি কাবাব বা দক্ষিণ ভারত-ঘরানায় কারিপাতা-সুরভিত ডিম-ভুজিয়া, পরোটাকুচি ও চিকেনের পদও মুখ ছেড়ে দেয়! কিন্তু এই নতুন ডিমের স্বাদ উপভোগ করতে আপনাকে অন্য কিছু খেতে হবে।
মিত্র কাফে বা নিরঞ্জন আগারের ডিমের ডেভিলে গাঢ় কমলা কুসুমটা গরগরে মাংসের কিমার বাহুবন্ধনে প্রায় আত্মহারা। আসলি ডিমের ডেভিল কিন্তু সে রকম নয়। দ্য ব্রিজের ডেভিল্ড এগে ভাজাভুজির বালাই নেই। আধখানা ডিমসেদ্ধর কুসুমে মাস্টার্ড, হর্সরেডিশ, ভিনিগার, হোয়াইট ওয়াইনের কারসাজি লা-জবাব। তবে এতে চিরকেলে ডিমসেদ্ধর অভিজ্ঞতাটাই যা পাল্টে দিচ্ছে। ইয়া মোটা ইতালিয়ান ওমলেট ফ্রিতাতা বা মাফিনের গায়ে বিছোন হ্যাম-বেকনের ফালিসমেত ডিমের পোচ এগ বেনেডিক্টের মতো ক্লাসিক পদগুলো সবই রয়েছে। বিস্ময় পদটি কিন্তু টোড ইন আ পড। ডিম, ময়দা, দুধের ব্যাটারে কালজয়ী ইয়র্কশায়ার পুডিংয়ের খোলটা অনেকটা কবিরাজি কাটলেটের মোড়কের মতো স্বাদু। ইয়র্কশায়ার পুডিং সাহেবরা ছুটির দুপুরে মাংসের স্টেকের সঙ্গে খান। এখানে পুডিংয়ের বাস্কেটে একটা আস্ত ডিম, সঙ্গতে পেঁয়াজ-রেড ওয়াইন সসের একটা জমপেশ কাই।
আর ফিরে ফিরে আসতে হবে দ্য ব্রিজের অষ্টপ্রহরের ব্রেকফাস্ট মেনু-র ডিমভাজায়। বাঙালি ভুলে যায় ডিমভাজা বা ফ্রায়েড এগ মানেই ওমলেট নয়। ফ্রায়েড এগের কুসুম তার নিজস্বতা অটুট রেখেছে। একটুও ঘেঁটে বা মিশে না-গিয়ে টলটলে রূপেই তার অধিষ্ঠান। ইস্টারের আবহে ডিম অযাত্রাফাত্রা এখন বাঙালি ভুলে গিয়েছে। ডিমের খোলায় রং করে ছেলে-বুড়ো সক্কলে ফেসবুকে ছবি ‘আপলোডাতে’ ব্যস্ত। মুক্ত মুরগির ডিমের ‘সানি-সাইড আপ’-এও জমতে পারে ইস্টারের উদ্যাপন।

ছবি: শুভেন্দু চাকী




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.