|
|
|
|
|
|
ব্যাগ গুছিয়ে...
|
জেনেশুনে বিষের দেশে
গিয়ে পড়লেন দেবদূত ঘোষঠাকুর। আর সে দেশের চিড়িয়াখানায়
গিয়ে বুঝলেন
সেই কাল
নাগিনীদের কাছে এ দেশের বিষধরেরা
নেহাত ঠান্ডা। সেই সাপ জ্যান্ত, তাঁর ক্যামেরা ও কলমে। |
|
কী কুক্ষণেই না কেউটে, গোখরো, শঙ্খচূড়দের নিয়ে বড়াই করেছিলাম!
উত্তর কুইন্সল্যান্ডের কেইর্নসের ট্রপিক্যাল জু-তে কোয়ালা, ক্যাঙারু দেখার পরে গিয়েছিলাম কুমিরের খাওয়া দেখতে। সেখানেই চিড়িয়াখানার ডিরেক্টর অ্যাঞ্জেলা ফ্রিম্যানের সঙ্গে গল্প হচ্ছিল। আমাদের দেশে নদী-নালায় যে নানা প্রজাতির কুমির পাওয়া যায় সেটাই বলছিলাম অ্যাঞ্জেলাকে। কুমিরের কথা বলতে বলতেই এসে গেল সাপের প্রসঙ্গ। অ্যাঞ্জেলাকে আমাদের কেউটে, গোখরোদের গল্প শোনাচ্ছিলাম। গ্রামবাংলার মানুষেরা কী ভাবে সাপের সঙ্গে ঘর করেন সেটা বোঝাচ্ছিলাম। বছরে সাপের কামড়ে কত লোকের মৃত্যু হয় দিচ্ছিলাম সেই পরিসংখ্যান। গোখরো, কেউটের বিষের তীব্রতা কেমন তাও বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম।
অ্যাঞ্জেলা কিছুক্ষণ শুনলেন। তার পরে কুমিরের ডেরা থেকে আমাকে হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেলেন সাপের ঘরের দিকে। সেখানে খাঁচায় পর পর রাখা কয়েকটা সাপ। অ্যাঞ্জেলা কিছুটা বিদ্রুপ মিশিয়ে বললেন, “রাখ তোমার গল্প। বিষাক্ত সাপ দেখতে চাও তো, চল আমার সঙ্গে। কত দেখবে দেখ।” চিড়িয়াখানায় ঢোকার মুখেই আমাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে সবুজ রঙের একটা সাপের। হৃষ্টপুষ্ট সাপটি ডাল জড়িয়ে জুলজুল করে চেয়েছিল আমার দিকে। অ্যাঞ্জেলা হাসলেন। বললেন, “দূর! ওটা তো গ্রিন পাইথন। ও সাপের বিষ নেই।” |
গ্রিন পাইথন |
চিড়িয়াখানার মহিলা ডিরেক্টর আমার হাতে গুঁজে দিলেন একটা পুস্তিকা। বললেন, “যাদের এখন দেখতে যাচ্ছ তাদের সম্পর্কে কিছুটা আগে থেকে জেনে রাখ। মনে তো হচ্ছে বিষাক্ত সাপ সম্পর্কে কোনও ধারণাই নেই তোমার।” সাপ নিয়ে নানা তথ্যচিত্র দেখেছি, বই পড়েছি। সেখানে কেউটে, শঙ্খচূড়, ব্ল্যাক মাম্বা, র্যাটল স্নেক, কোরাল স্নেক ভাইপারদের রুদ্রমূর্তির সাতকাহন রয়েছে। কিন্তু পুস্তিকায় থাকা সাপগুলির বেশির ভাগই আমার অপরিচিত।
ওই পুস্তিকার একটি অংশ দেখিয়ে অ্যাঞ্জেলা বললেন, “ভাল করে দেখ। বিষের তীব্রতার নিরিখে যদি বিষধর সাপেদের একটা তালিকা তৈরি কর তা হলে প্রথম দশে অস্ট্রেলিয়ার অন্তত পাঁচটি সাপের নাম পাবে। তালিকার প্রথম তিনটিই আমাদের অস্ট্রেলিয়ার। ইনল্যান্ড তাইপান, ইস্টার্ন ব্রাউন স্নেক এবং কোস্টাল তাইপান।”
সাপ যখন এতটা বিষধর তখন তার চেহারাও নিশ্চয় ভয়ানক হবে। কাচের ও পাশ থেকে আমাদের দেখে নিশ্চয়ই ফোঁস ফোঁস করতে শুরু করবে, ছোবল মারবে কাচের গায়ে। কিংবা লেজের উপরে দাঁড়িয়ে উঠে ফণা তুলে ধরবে আর থুতু ছিটিয়ে দেবে। থুতু তো নয় বিষ! কিন্তু কোথায় কী! কাচের বাক্সের বাইরে সাপের পরিচয় লেখা না থাকলে বুঝতেই পারতাম না ঝোপের আড়ালে নির্বিকার ভাবে শুয়ে থাকা বাদামি সাপটাই ইনল্যান্ড তাইপান। পাশের খাঁচায় বালির উপর দিয়ে যাচ্ছিল একটা কোস্টাল তাইপান। রঙ কিছুটা নীলচে কালো। দেহের গড়নটা অনেকটা আমাদের দাঁড়াশ সাপের মতো। তথ্য বলছে, ইনল্যান্ড তাইপানের ১১০ গ্রাম বিষ ১০০ মানুষকে মারার ক্ষমতা রাখে। বাদামি ছাড়াও ইনল্যান্ড তাইপানের একটি প্রজাতি আবার জলপাই রঙের। |
|
|
কোস্টাল তাইপান |
ব্ল্যাক স্নেক |
|
আর ইস্টার্ন ব্রাউন স্নেকের সঙ্গে আকৃতিতে আমাদের জলঢোঁড়ার অনেকটা মিল রয়েছে। তবে ব্রাউন স্নেক অনেকটা বড়, একটু মোটা, আর ঢোঁড়ার গায়ের চামড়াটা কালচে বাদামি। থাকে ঝোপে। জলঢোঁড়া কামড়ালে স্থানীয় ভাবে একটা ক্ষত হয় মাত্র, আর কিছু হয় না। কিন্তু আমাদের কেউটের বিষের থেকে ইস্টার্ন ব্রাউন স্নেকের বিষ অন্তত ১২ গুণ বেশি তীব্র। বালির উপর দিয়ে সর সর করে ছুটে যেতে দেখলাম একটা ডোরাকাটা সাপকে। ওটা টাইগার স্নেক। এটারও বিষ মারাত্মক। পরের সাপটার পেটের অংশটা লাল। সাপের নাম তাই রেড বেলিড স্নেক। তারও বিষ নাকি মারাত্মক। দেখা মিলল কপার হেডেরও। বিষের তীব্রতার প্রশ্নে এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায়।
আসলে অস্ট্রেলিয়ার সাপেদের বিষ যতই তীব্র হোক না কেন, ফোঁস করে ওঠাটা কিন্তু তাদের স্বভাববিরুদ্ধ। আমাদের দেশের গোখরোরা মুখোমুখি হলেই তাদের লেজের উপরে দাঁড়িয়ে ওঠে ফণা তুলে ফোঁস ফোঁস শব্দ করে ভয় দেখায়। আফ্রিকার এক ধরনের কেউটে সরাসরি বিষ ছেটায় চোখ লক্ষ করে। অস্ট্রেলিয়ার তাইপান, ব্রাউন স্নেক বা টাইগার স্নেকেরা তাদের জাতভাইদের এ রকম রুদ্রমূর্তি দেখে নিশ্চয় লজ্জায় মুখ লুকোবে। ওদের বিষ যতই তীব্র হোক না কেন।
অস্ট্রেলিয়ায় এত নামী-দামি সাপ। কিন্তু সাপের কামড়ে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা অত্যন্ত কম। সাপের কামড়ে মারা যাওয়ার সাম্প্রতিক সংখ্যা হল বছরে ১০ জনেরও কম। বিশ্বে সাপে কাটায় মৃতের সংখ্যার বিচারে সব থেকে এগিয়ে শ্রীলঙ্কা। ভারত আর আফ্রিকায় সাপে কাটায় মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যা শ্রীলঙ্কার পরেই। একটি তথ্য বলছে, সারা বছরে গোটা বিশ্বে সাপের কামড় খান ১০ লক্ষ থেকে ২০ লক্ষের মতো মানুষ। তাদের মধ্যে ৫০ হাজার থেকে ৬০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। |
|
|
কমন ব্রাউন স্নেক |
টাইগার স্নেক |
|
কিন্তু অস্ট্রেলিয়ায় সাপের কামড়ে এত কম মানুষের মৃত্যুর রহস্যটা কী?
সাদারল্যান্ড এবং কিং নামে দুই গবেষক অস্ট্রেলিয়ার সাপেদের নিয়ে অনেক বছর গবেষণা করেছেন। ট্রপিক্যাল জু-র এক গাইড সেই কাজের উল্লেখ করে বললেন, “অস্ট্রেলিয়ার বিষাক্ত সাপেরা কাউকে কামড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই কিন্তু বিষ ঢেলে দেয় না। দেখা গিয়েছে ১০ বার যদি কাউকে ওই সব সাপ কামড়ায় তার মধ্যে মাত্র এক বার বিষ যায় আক্রান্তের শরীরে। ওরা বিষ নিজের শরীরে সঞ্চয় করে রাখে। সব সময় প্রয়োগ করে না।”
অস্ট্রেলিয়ার সাপেদের চরিত্র নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করেছেন ব্রায়ান বুশ। বুশের গবেষণাপত্র থেকে অস্ট্রেলিয়ার বিষধর সাপেদের সম্পর্কে অনেক তথ্য জানা যায়। তাঁর গবেষণাপত্রের এক জায়গায় বুশ লিখছেন, “সবাই অস্ট্রেলিয়ার সাপেদের বদনাম করে। কিন্তু ওরা খুবই নিরীহ। একটা ঘটনাও দেখাতে পারবেন না যেখানে এখানকার তাইপান, ব্রাউন স্নেকেরা মানুষকে আক্রমণ করেছে। ওরা শিকার করার সময়েও খাদ্যের উপরে বিষ প্রয়োগ করে না। স্রেফ গিলে ফেলে।” বুশের ব্যাখ্যা, “যদি ওদের খালি পায়ে না মাড়িয়ে দাও (একমাত্র চোখ বন্ধ করে চললে কিংবা অতিরিক্ত নেশাগ্রস্ত হলে যা সম্ভব) কিংবা ওদের নিয়ে কসরত্ দেখাতে না চাও, তা হলে অস্ট্রেলিয়ার বিষধর সাপেদের হাতে তোমার মৃত্যু নেই।”
বিভিন্ন সময় ধরে বিভিন্ন দেশের জীববিজ্ঞানীরা সাপ নিয়ে গবেষণা করছেন। তার ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে বিশ্বের সব থেকে তীব্র বিষধর সাপেদের বিভিন্ন তালিকা। ওই তালিকার অধিকাংশেরই প্রথম দশে রয়েছে অস্ট্রেলিয়ার ছ’টি সাপের নাম। তালিকায় এক, দুই, তিন নম্বরেই রয়েছে অস্ট্রেলিয়ার সাপ— ইনল্যান্ড তাইপান, ইস্টার্ন ব্রাউন স্নেক এবং কোস্টাল তাইপান। বিশ্বের প্রথম ২৫টি সর্বাপেক্ষা বিষধর সাপের তালিকায় ঢুকে পড়েছে অস্ট্রেলিয়ারই ১২ টি প্রজাতি। |
|
ল্যান্ড তাইপান |
সাপ নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন তাঁদের দেওয়া তথ্য বলছে, মোট ২ হাজার ৭০০ প্রজাতির সাপ রয়েছে পাঁচ মহাদেশ মিলিয়ে। তাদের মধ্যে মাত্র ৪৫০টি প্রজাতি বিষধর। আর বিষধরদের মধ্যে ২৫০ সাপের বিষ মানুষের মৃত্যু ঘটাতে পারে। সর্বাপেক্ষা বেশি সংখ্যক বিষধর সাপ কিন্তু রয়েছে অস্ট্রেলিয়ায়। অস্ট্রেলিয়ায় ১৪০ ধরনের স্থলবাসী সাপ রয়েছে। ৩২ ধরনের সাপ জলে থাকে। মোট ১৭২ প্রজাতির সাপের মধ্যে ১০০ প্রজাতি বিষধর। তবে মাত্র ১২টি সাপের বিষের মানুষ মারার ক্ষমতা রয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ায় এত বিষধর সাপ কোথা থেকে এল তা নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে নানা গল্পকথা প্রচলিত রয়েছে। যদিও তার কোনওটাই সত্যি নয়। কুইন্সল্যান্ডের ব্যবসায়ী ম্যাক ফেয়ারব্রাদারের ব্যাখ্যা, “এখানে অতি বিষধর সাপের একটি প্রজাতির সঙ্গে অন্য একটি প্রজাতির মিলন হচ্ছে। যেমন তাইপান আর ব্রাউন স্নেকের মধ্যে মিলনে একটি নতুন সঙ্কর এবং অতি বিষধর সাপের সৃষ্টি হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে পাইথনের সঙ্গে প্রজনন হয়েছে ছোট বিষধর সাপেদের। তাতেই জন্ম হয়েছে ব্রাউন স্নেক, টাইগার স্নেকদের।” ফেয়ারব্রাদার নিজের মতের পক্ষে বলার জন্য ডেকে নিয়ে এলেন কৃষক পরিবারের মহিলা এলিজাবেথকে। এলিজাবেথ বললেন, “যে ভাবে জঙ্গল নষ্ট হচ্ছে তাতে নতুন পরিবেশে সাপেদের বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করতে হচ্ছে। নতুন প্রজাতির জন্ম হচ্ছে সেই বাধ্যবাধকতা থেকেই।”
আর এসব শুনে বেজায় খেপে গেলেন চিড়িয়াখানার গাইড। মুখ লাল করে বললেন, “এ ভাবে মানুষকে ভুল বোঝাতে নেই। দয়া করে এ সব বাচ্চাদের সামনে বলবেন না। ওরা ভুল শিখবে। দুই ভিন্ন প্রজাতির সাপের মধ্যে কখনও মিলন হয় না। অস্ট্রেলিয়ার বিশাল স্থলভূমির দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের বাসযোগ্য নয়। ওই দুই-তৃতীয়াংশে রয়েছে পাথর, মরুভূমি, জঙ্গল। যা নানা ধরনের প্রাণীদের নিরাপদ আশ্রয়। পক্ষীকুলের মতো অস্ট্রেলিয়ায় সাপেদেরও তাই বাড়বাড়ন্ত।”
|
|
|
|
|
|