|
|
|
|
|
যে চলে গেল, সে আমাদের
না ওদের, ওই প্রশ্নটা তুলবেন না
ডেরেক ও’ব্রায়েন |
|
প্রত্যেকের জীবনেই এমন কিছু মুহূর্ত আসে, যেগুলো ভীষণ দুঃখের ও বেদনার। গত কয়েকটি দিন ঠিক সে রকম। অসম্ভব হতাশার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এসএফআই নেতা সুদীপ্ত গুপ্তর হঠাৎ-মৃত্যু আমায় নাড়িয়ে দিয়ে গিয়েছে।
মাত্র ২৩ বছরের ওই তরুণের সামনে তো গোটা জীবনটা পড়ে ছিল। আমার বাড়ির কাছাকাছি পাড়াতেই থাকত ছেলেটি। টিভির পর্দায় আর খবরের কাগজে সুদীপ্তর ভেঙে পড়া বাবা-দিদির ছবি দেখে কষ্ট হচ্ছিল। এটা তো হওয়ার কথা ছিল না!
প্রতিটি মৃত্যুই দুঃখজনক। কিন্তু ভুললে চলবে না, গত ৩৪ বছরের বাম অপশাসনে প্রায় ৮০ হাজার নিরীহ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। এই তরুণের মৃত্যু শুধু তাঁর বাবার সন্তান হারানো নয়; তাঁর পরিজন-বন্ধুদের কাছের মানুষ চলে যাওয়া নয়। এই ঘটনা কলকাতা তথা রাজ্যবাসীর কাছে একটি সতর্কবার্তা।
সংবাদমাধ্যমে বলা সুদীপ্তর দিদির একটি কথা আমায় খুব ভাবাচ্ছে “নেতারা অল্পবয়সি ছাত্রছাত্রীদের নিজেদের স্বার্থপূরণের জন্য ব্যবহার করেন। এ ধরনের মৃত্যুতে এসএফআই বা তৃণমূলের যত না ক্ষতি, তার থেকে অনেক বেশি ক্ষতি একটা পরিবারের।” সুদীপ্তর দিদি প্রশ্ন তুলেছেন, “ছাত্ররা তাদের নিজস্ব অধিকার নিয়ে কথা বলতেই পারে। তাদের কোনও সমস্যা থাকলে তারা কলেজের অধ্যক্ষের সঙ্গে কথা বলতে পারে। কিন্তু কেন তারা রাজনীতির পতাকার নীচে দাঁড়িয়ে লড়াই করবে?”
সুদীপ্তর দিদির ওই কথা ব্যবহার করে সহজেই সিপিএম বা এসএফআইয়ের সমালোচনা করা যায়। বলাই যায় যে, তারাই সুদীপ্ত ও তার বন্ধুদের বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছিল। কিন্তু আমি তা করব না। সেটা আমার রুচিতে বাধে। কিছু বিষয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে থাকা উচিত।
কিন্তু প্রশ্ন হল, কলেজ নির্বাচন কি দলের চিহ্ন ছাড়া করা সম্ভব? ছাত্ররা কি তাদের কলেজ-ক্যাম্পাসকে রাজনীতি-মুক্ত করতে পারবে? রাজনীতি-মনস্ক হওয়া বা সমসাময়িক রাজনীতি সম্পর্কে সজাগ দৃষ্টি রাখা এক কথা। কিন্তু কোনও রাজনৈতিক দলের সর্বক্ষণের সমর্থক হয়ে ওঠা বা ভোটের জন্য কাজ করা সম্পূর্ণ আলাদা কথা। এই প্রসঙ্গটাই সুদীপ্তর দিদি তুলে ধরেছেন। আমার মনে হয় এটা যথেষ্ট ভাববার বিষয়। প্রত্যেকেরই নিজস্ব রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ বজায় রাখার অধিকার আছে। কিন্তু তা যেন তার ন্যায়নীতি ঝাপসা করে না দেয়।
আমার মনে হয়, এখন আপাতত মাস ছয়েক বিভিন্ন কলেজে ছাত্র নির্বাচন বন্ধ রাখাটাই শ্রেয়। এই সময়ের মধ্যে বরং আলোচনা করে দেখা হোক, ফের নির্বাচন করা সম্ভব কি না। ছাত্ররা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না-থেকেও কী ভাবে তাদের রাজনৈতিক অধিকার বজায় রাখতে পারে, সেটাই ভাবার বিষয়। এটি একটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়। আমি জানি আমি কী বলতে চাইছি। কিন্তু আমি এটাও স্বীকার করে নিচ্ছি যে, অন্যদের এই বিষয়ে ভিন্ন মত থাকতেই পারে। তাই আমার প্রস্তাব, ছাত্রদের জন্য কী ভাল, তা ঠিক করার জন্য অন্তত ছ’মাস ধরে বিতর্ক করা হোক।
১৯৭৭ থেকে ২০১১ পর্যন্ত সিপিএম পশ্চিমবঙ্গের প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল ছিল। রাজনীতি থেকে সমাজজীবন, সর্বত্রই তারা তাদের একচেটিয়া দাপট কায়েম করে রেখেছিল। এমনকী পুলিশও কাজ করত রাজনৈতিক রং দেখেই। তৃণমূল কংগ্রেস সেই জাল কেটে পুলিশকে বার করে এনেছে। তবে মানছি, আরও অনেক কিছু করতে হবে। আমাদের এবং বিরোধীদেরও। কারণ আমরা সবাই, সামগ্রিক ভাবে, বাঙালি জনজীবনের অংশীদার।
এত দিন ধরে পশ্চিমবঙ্গের, বিশেষ করে কলকাতার, বিভিন্ন কলেজ ক্যাম্পাস সিপিএমের নিয়োগশালা ছিল। এসএফআই যে শুধু ছাত্র রাজনীতিতে প্রভাব খাটাত তা-ই নয়, স্কুল কলেজের ভর্তি থেকে শিক্ষকদের বদলতিতেও তারা যথেষ্ট প্রভাবশালী ছিল। এখন সেই এসএফআই একটি ক্ষয়িষ্ণু শক্তিতে পরিণত হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই তৃণমূল-সহ অন্য প্রতিপক্ষরা তার সুযোগ নিতে চাইছে। কিন্তু এসএফআই তো এত সহজে ছেড়ে দেবে না। জমি দখলের লড়াইয়ে তারাও নেমে পড়েছে। এ সবের পরিণতিই এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি।
আমরা কখনওই চাই না যে, পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাক। যখন কোনও ছাত্র মারা যায় তখন এই প্রশ্ন তোলা সঙ্গত নয় যে, সে কি ‘আমাদের ছাত্র’ না ‘ওদের’। আসল বিষয়টি হল, একটি তরুণ প্রাণ অকালে চলে গেল। এক জন নাগরিকের মৃত্যু হল। একটি পরিবার তার অমূল্য সন্তান হারাল। এই মৃত্যুতে ক্ষতি হয়েছে গোটা রাজ্যের। সেই জন্যই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দুঃখের দিনে সুদীপ্তর পরিবারের পাশে দাঁড়াতে গিয়েছিলেন। এটা কোনও তৃণমূল রাজনীতিকের এক জন মৃত এসএফআইয়ের কর্মীর পরিবারের প্রতি সৌজন্য দেখানো নয়। এটি এক জন তরুণ সহ-নাগরিকের প্রতি মুখ্যমন্ত্রীর সহমর্মিতা প্রকাশ। আমি আশা করব, সমস্ত দল ভবিষ্যতে এই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করবে। তা হলেই রাজ্যের রাজনৈতিক সংস্কৃতির কিছুটা বদল হবে। হিংসার আঁচ কমবে।
আর কিছু না হোক, সুদীপ্তর স্মৃতির জন্য এটুকু অন্তত করা উচিত। আমাদের প্রত্যেকের পক্ষ থেকে এই সম্মানটুকু যেন তাকে দেওয়া হয়। |
|
|
|
|
|