খরচ হয়ে গিয়েছে সরকারি ক্ষতিপূরণ আর বেসরকারি সাহায্য বাবদ পাওয়া টাকা। বাঁ পা-টা এখনও অস্বাভাবিক ফোলা গৌতম ঘোষের। পূর্ণিমা ডোম এখনও ডান পা টেনে হাঁটেন। দুবরাজপুরের লোবা গ্রামের এই দুই বাসিন্দাকে সামনে রেখেই পঞ্চায়েত ভোটের প্রচারে নেমেছে এলাকার ‘কৃষিজমি রক্ষা কমিটি’। কমিটির সম্পাদক জয়দীপ মজুমদার বলেন, “ওঁদের দেখলে, কথা শুনলেই মানুষের মনে পড়বে, জমি আন্দোলন ঘিরে ঠিক কী হয়েছে লোবায়।”
খোলামুখ কয়লাখনির জন্য জমি নেওয়াকে কেন্দ্র করে বিবাদের জেরে ৬ নভেম্বর ভোরে পুলিশি অভিযান চলে লোবা গ্রামে। পাঁচ গ্রামবাসী পুলিশের গুলিতে জখম হন বলে অভিযোগ। আট জনের বিরুদ্ধে সরকারি সম্পত্তি নষ্ট, সরকারি কর্মীর উপরে সশস্ত্র আক্রমণ ও খুনের চেষ্টা, সরকারি কাজে বাধা-সহ একাধিক ধারায় মামলা রুজু করে পুলিশ। অভিযুক্তদের মধ্যে কমিটির সম্পাদক জয়দীপ মজুমদার, সভাপতি ফেলারাম মণ্ডল, আহ্বায়ক আশিস মিশ্র ছাড়াও রয়েছেন সক্রিয় সদস্য, ঘটনার দিন আহত গৌতম ঘোষও।
গৌতমবাবু বলেন, “ক্ষতিপূরণ বাবদ যে টাকা পেয়েছিলাম (মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেওয়া ২৫ হাজার, কংগ্রেস নেত্রী দীপা দাশমুন্সি ও পিডিএস নেতা সমীর পুততুণ্ড দিয়েছিলেন ১০ হাজার করে) সব খরচ হয়ে গিয়েছে। এখন কী করব জানি না। তবে পঞ্চায়েত ভোটকে সামনে রেখে কমিটির সভাগুলিতে থাকতে চেষ্টা করি।” একই সুর ওই দিনই জখম পূর্ণিমাদেবীর গলাতেও।
পাঁচ মাস আগে যাঁরা আহত হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে তিন জন স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন। পারেননি বছর চল্লিশের গৌতম। চাষের কাজ করতেন। এখন পারেন না। উনচল্লিশ বছরের পূর্ণিমা জব-কার্ডধারী দিনমজুর ছিলেন। করতেন পরিচারিকার কাজও। পায়ের সমস্যায় সে সব এখন অতীত। |
বেসরকারি শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ করবে না তৃণমূল সরকার, এই নীতির ফলে ডিভিসি-এমটা সংস্থা সরাসরি জমি কিনতে নেমেছিল লোবায়। তাতেই মাথাচাড়া দিয়েছিল দালাল-রাজ। শোনা যায়, সিপিএমের প্রভাবশালী নেতারা এই দালালদের পিছনে ছিলেন। পরে সেই জায়গাটা নেন জেলা তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতা।
তৃণমূলের একাংশের ‘মদতে’ দালালদের দাপাদাপিতে স্থানীয় মানুষ ও কৃষিজীবীদের একটা বড় অংশের মধ্যে অসন্তোষ দানা বাঁধে। ডিভিসি এমটার কাছ থেকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। ২০০৮-এর পর লোবা পঞ্চায়েত ছিল তৃণমূলের কব্জাতেই। জমি-বিবাদের পর হাওয়া ঘুরে যায় তৃণমূলের উল্টো দিকে। প্রতিবাদের কেন্দ্রে চলে আসে ডিভিসি-এমটার একটা মাটি কাটার যন্ত্র, যা দীর্ঘদিন ছিল কৃষিজমি রক্ষা কমিটির সদস্য ও গ্রামবাসীদের দখলে। সেই যন্ত্র ছাড়ানো নিয়েই ৬ নভেম্বরের সংঘর্ষ। ঘটনার প্রতিবাদে ধর্নামঞ্চে চলে অবস্থান। লোবায় বড় বড় নেতাদের নিত্য আনাগোনা শুরু হয়। তৃণমূলের সঙ্গে গ্রামবাসীদের দূরত্ব আরও বাড়ে, যখন মুখ্যমন্ত্রী লোবায় এলেও ধর্নামঞ্চ এড়িয়ে যান। কমিটির সদস্যদের জামিনের বিরোধিতা করে পুলিশ। মহাকরণে আলোচনার জন্য কমিটির নেতাদের ডাকলেও, জমি অধিগ্রহণে সরকারি মধ্যস্থতার অনুরোধও অগ্রাহ্য করে তৃণমূল সরকার।
কমিটির সেই ধর্নামঞ্চের আশপাশ জনশূন্য। পাঁচ মাস আগে গজিয়ে ওঠা মুড়ি-তেলেভাজার দোকানটিও বন্ধ। লড়াই কিন্তু থামেনি, মঞ্চ সরেছে কেবল। তৃণমূলের সন্দেহ, হারানো জমি পেতে ভোটের আগে কমিটির সঙ্গে সমঝোতা করছে সিপিএম। লোবা পঞ্চায়েতের তৃণমূল-সমর্থিত সিপিআইয়ের প্রধান শেখ শফিক বলেন, “কমিটি আর সিপিএম একসঙ্গে মিটিং করছে বলেও শুনেছি।” এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত সিপিএম নেতা সাধন ঘোষ জানান, লোবায় একলা চলার পরিকল্পনা তাঁদের।
কমিটির নেতাদের আশঙ্কা, ভোটের আগে শাসক দলের ‘চাপে’ তাঁদের ধরবে পুলিশ। কমিটির সভাপতি ফেলারাম মণ্ডল বলেন, “আমাদের নেতারা গ্রেফতার হলেও জমি-আন্দোলন ও ভোট-প্রচার যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে জন্যই গৌতম এবং পূর্ণিমাকে মাঠে নামানো।”
তবে কমিটির নেতাদের ধরতে পুলিশের উপরে চাপ বাড়ানোর সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছেন তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল। তাঁর বক্তব্য, “কৃষিজমি রক্ষা কমিটি ভোটে লড়লে কিছুই যায়-আসে না।” “ভোট যায়-আসে। পা গেলে, আসে না”, কমিটির হয়ে প্রচারসভায় বলছেন গৌতম, পূর্ণিমা।
|