পুলিশ রাজারহাটে পিয়ালি মুখোপাধ্যায়ের ফ্ল্যাটের দরজা ভাঙার আগেই বর্ধমানে তাঁর পরিবারের লোকজন ‘আত্মহত্যা’র খবর পেয়ে গিয়েছিলেন। যদিও গলায় দড়ির কথা শুনেছিলেন কি না, তা নিশ্চিত নয়।
শুধু খবর পাওয়াই নয়, গত ২৬ মার্চ রাত ৮টার আগেই রাজারহাটের নারায়ণপুরে পিয়ালির ফ্ল্যাটের সামনে পৌঁছে যান তাঁর স্বামী, বাবা, ভাই। এয়ারপোর্ট থানার পুলিশ দরজা ভাঙে রাত সাড়ে ৯টা নাগাদ। তা হলে কী করে তার আগেই খবর এসে গেল যে পিয়ালি আত্মঘাতী হয়েছেন?
বুধবার বর্ধমানের গোলাপবাগে নিজের বাড়িতে বসে ঠিক এই প্রশ্নটাই তুললেন পিয়ালির বাবা প্রণব মুখোপাধ্যায়। বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটের গোয়েন্দা প্রধান অর্ণব ঘোষ অবশ্য বলেন, “পুলিশ দরজা ভাঙার পরই বিষয়টি জানাজানি হয়। পিয়ালির বাড়ির লোকজন আমাদের কাছে এমন অভিযোগ করেননি যে তাঁরা বিষয়টি আগেই শুনেছিলেন।”
প্রণববাবুর আক্ষেপ, “ওই দিন বিকেল পৌনে ৫টা নাগাদ পাড়ার এক তৃণমূল কর্মী বাড়িতে এসে খবর দেন, পিয়ালি ওর ফ্ল্যাটে আত্মহত্যা করেছে। পরে দেখলাম, দুপুর দেড়টা থেকেই গোটা বর্ধমান খবরটা জানে। কী করে আমাদেরও আগে জেনে গেল?” তাঁর আক্ষেপ, সাত দিন পেরিয়ে গেলেও পুলিশ তাঁদের সঙ্গে কথা বলেনি। ফলে তাঁরা নিজেদের কথা জানাতেও পারছেন না। |
মায়ের ছবির সামনে মেয়ে সংবৃতা। ছবি: উদিত সিংহ |
এ দিন বহু চেষ্টা করেও পিয়ালির স্বামী সুভাষ চক্রবর্তীর সঙ্গে কথা বলা যায়নি। তবে তাঁর বাড়ির লোকজন জানান, বিকেল পৌনে ৪টে নাগাদ দুর্গাপুরে নিজের কর্মস্থলে খবর পেয়ে তিনি ফিরে আসেন। তবে বাড়িতে আসেননি। ওই পাড়াতেই পিয়ালিদের বাড়িতে ঢোকেন। খানিক পরে বাড়ির লোকের সঙ্গেই কলকাতায় চলে যান।
পিয়ালির মৃত্যুর কয়েক দিন পর থেকেই অবশ্য সুভাষ কার্যত একটু আড়ালে সরে গিয়েছেন। তাঁর বাড়ির লোকজনও কথা বলতে আগ্রহী নন। দোতলায় ওঠার দরজায় তালা। পিয়ালির শ্বশুর, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় পাঠাগারের প্রাক্তন কর্মী সুশীল চক্রবর্তী বা তাঁর স্ত্রী ছায়াদেবী কিছুতেই দোতলায় যাওয়ার অনুমতি দিলেন না। সুভাষের ভাই বিকাশ বলেন, “দাদা-বৌদি দোতলায় থাকতেন। বৌদি বেশ কিছু দিন এ বাড়িতে আসেননি। যখন আসতেন, তখনও আমাদের সঙ্গে কথা হত না। ওঁদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল কি না, জানি না। তবে দাদা এখানে একাই থাকেন।” একা কেন? “অনেক দিন ধরেই আমাদের হাঁড়ি আলাদা। তিনি কখন আসেন, কখন যান, আমরা জানতে পারি না।” তিনি যাতে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ না করেন, তার জন্য কি তাঁকে চাপ দেওয়া হচ্ছে বা লোভ দেখানো হচ্ছে? তাই কি তিনি আড়াল নিয়েছেন? বিকাশের জবাব, “কী করে বলি বলুন? দাদা কি কিছু বলে?”
পিয়ালি-সুভাষের এক মাত্র মেয়ে, বছর ছয়েকের সংবৃতা ছিল মামার বাড়িতেই। মায়ের ছবির দু’ধারে ফুলদানিতে রজনীগন্ধার গোছা, পাশে ধূপ জ্বলছে। সামনে মেঝেয় বসে ভাত খাচ্ছিল ছোট্ট মেয়েটি। কতটা বুঝেছে সে? প্রণববাবু বলেন, “ও ঘটনাটা জানে। তবে মুখে কোনও কথা নেই। ওকে দয়া করে বিরক্ত করবেন না।” দরজার গোড়ায় ঝিমোচ্ছিল বাচ্চা অ্যালসেশিয়ান জিকো। প্রণববাবু বলে চলেন, “পিয়ালি ওকে খুব যত্নে পুষছিল। ট্রেনারও রেখেছিল। আমার মেয়েকে ও ঝুলন্ত অবস্থায় দেখেছে। তার পর থেকেই ঝিমিয়ে রয়েছে। ”
তবে পিয়ালিকে নিয়ে যে নানা প্রশ্ন উঠছে, তাতে বিরক্ত তাঁর বাড়ির লোকজন। প্রণববাবুর কথায়, “প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, মেয়ের ফ্ল্যাটের ভাড়া কে দেয়? কে ওকে গাড়ি কিনে দিল? আমার মেয়ে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের আইন পরামর্শদাতা ছিল। প্রায়ই লাখ টাকার চেক দেখাত আমাদের। সমস্যায় পড়লে আমাদের কাছ থেকে ধারও নিত। পরে শোধ করে দিত।”
পুলিশ অবশ্য জানাচ্ছে, বর্ধমান থেকে কলকাতায় গিয়ে রাতারাতি বিলাসবহুল জীবনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা পিয়ালির টাকার উৎস কী ছিল, তা জানতে তাঁর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ব্যাঙ্কশাল কোর্টের আইনজীবী হিসাবে তাঁর পসার কত ছিল, খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। পিয়ালি যে গাড়ি ব্যবহার করতেন, সেটি যে উপহার পাওয়া সেই ব্যাপারে পুলিশ এক প্রকার নিশ্চিত। কিন্তু বর্ধমানে যে দু’টি বাসের পারমিট পিয়ালি বের করে দিয়েছিলেন বলে পুলিশ জেনেছে, সেগুলির মালিক কারা সে ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।
বর্ধমান জেলা টিএমসিপি-র এক নেতার দাবি, তৃণমূলের এক মন্ত্রীর নেকনজরে পড়ার পরেই জীবন পাল্টে গিয়েছিল পিয়ালির। দু’বছর আগেও জামালপুরে প্রত্যন্ত গ্রামে প্রাথমিক স্কুলে পড়াতেন তিনি। ওই জেলা নেতার হাত দিয়েই মন্ত্রীর সুপারিশের চিঠি যায় জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদের তৎকালীন চেয়ারম্যানের কাছে। পিয়ালি বর্ধমান শহরে বদলি হন। পরে মন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগের সূত্রেই চলে আসেন কলকাতায়।
প্রণববাবুর দাবি, ঘটনার আগের রাতে সাড়ে ১০টা নাগাদ তাঁর সঙ্গে পিয়ালির কথা হয়েছিল। তিনি তখনও ছিলেন সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ছিলেন। তাঁর প্রশ্ন, “পিয়ালির সঙ্গে এক বান্ধবী এবং আর এক জন গিয়েছিলেন বলে শুনেছি। এখনও তাদের জেরা কেন করল না পুলিশ?”
বিধাননগরের গোয়েন্দা প্রধান বলেন, “পিয়ালির সঙ্গে যাঁদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল তাঁদের সবাইকেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।” ঘটনার দিন কেষ্টপুরের এক তৃণমূল নেতা পিয়ালিদের বাড়িতে খবর পাঠান বলে পরিবার সূত্রে জানানো হয়েছিল। কিন্তু পুলিশ জানায়, তার পর থেকেই তাঁর মোবাইল বন্ধ। সেই নেতার পরিচয়ও অজ্ঞাত। পুলিশের দাবি, পিয়ালির আত্মীয়দের সঙ্গে ফোনে কথা বলা হচ্ছে। প্রয়োজনে বাড়ি যাওয়া হবে বা কলকাতায় ডেকে পাঠানো হবে।
|