দলের সংসদীয় বোর্ডে আনার সঙ্গে সঙ্গেই নরেন্দ্র মোদীর ধারাবাহিক উত্থানের নকশাটিও চূড়ান্ত করে ফেলেছেন বিজেপি ও সঙ্ঘ নেতৃত্ব। এমন ভাবে পরিকল্পনা করা হচ্ছে, যাতে প্রথমে দিল্লি এবং তার পরে ধাপে ধাপে গোটা দেশে মোদীকে তুলে ধরা যায়।
বিজেপির শীর্ষ সূত্রের বক্তব্য, মোদীকে সংসদীয় বোর্ডে আনার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় সভাপতি রাজনাথ সিংহের পথে কম বাধা আসেনি। কিন্তু বিজেপির একটা বড় অংশই মনে করেন, লোকসভায় বিজেপির জয় নিশ্চিত করতে মোদীই একমাত্র মুখ। এই পরিস্থিতিতে দলের একটা বড় অংশের দাবিকে গুরুত্ব দিতেই যাবতীয় বাধা উড়িয়ে মোদীকে সংসদীয় বোর্ডে এনেছেন রাজনাথ। তাঁকে প্রচার কমিটির প্রধান করার বিষয়টিও এক রকম চূড়ান্ত। পাশাপাশি রাজধানীতে মোদীর যাতায়াত যাতে আরও বাড়ানো যায়, সে দিকেও নজর রাখছেন বিজেপি নেতৃত্ব। আগামী রবিবারই এক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দিল্লি আসছেন মোদী।
মোদীকে দল কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে, তা বোঝাতেও বাড়তি পদক্ষেপ করছেন রাজনাথ। প্রতি বছর ৬ এপ্রিল বিজেপির প্রতিষ্ঠা দিবসের মূল অনুষ্ঠানটি হয় দিল্লিতে। এ বারে রাজনাথ ওই দিন গুজরাতে যাবেন। মোদীর সঙ্গে একমঞ্চে সে দিন দলের প্রতিষ্ঠা দিবস পালন করবেন তিনি।
বিজেপি শীর্ষ সূত্রের মতে, এই মুহূর্তে লোকসভায় জিততে গেলে সে ভাবে নির্ভরযোগ্য কোনও মুখও নেই। তাই মোদীর জনপ্রিয়তাকে যতটা সম্ভব কাজে লাগানোই দলের লক্ষ্য। রাজনাথ সংসদীয় দল ঘোষণার দু’দিন আগেই আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতের সঙ্গে একান্ত বৈঠক করেন মোদী। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীর ভাবমূর্তির উপর অনেকটাই ভরসা করছেন সঙ্ঘের শীর্ষ নেতারা। তা ছাড়া সামনেই কর্নাটক নির্বাচন। দক্ষিণে দলের দখলে থাকা একমাত্র রাজ্যে ক্ষমতা ধরে রাখতে বিজেপি মরিয়া। কিন্তু ইয়েদুরাপ্পার দলত্যাগের পরে সেখানে যা পরিস্থিতি, তাতে জয়ের আশা ক্ষীণ বলে এক রকম স্বীকারই করে নিয়েছেন নেতৃত্বের একটা বড় অংশ। পরিস্থিতি বুঝে কংগ্রেস এখন মোদীর উদ্দেশে কর্নাটক নিয়ে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। তাদের বক্তব্য, মোদী আগে কর্নাটকে দলকে জিতিয়ে দেখান!
পাল্টা মুখ খুলছেন বিজেপি নেতারাও। তাঁদের যুক্তি, এক জনের ক্যারিশমায় ভোটে জেতা যায় না। তার জন্য সংগঠনও দরকার। মোদীর ভাবমূর্তি বাঁচাতে কর্নাটক নির্বাচনের পরে তাঁকে প্রচার কমিটির প্রধান করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে।
মোদীকে এ ভাবে বাড়তি গুরুত্ব দেওয়ায় দলের অন্দরেই যেমন অসন্তোষ তৈরি হয়েছে, তেমনই সঙ্ঘের মধ্যে মোদী-বিরোধীরাও সক্রিয়। গত কালই গুজরাতে মোদীর নির্বাচনী কেন্দ্রের এক সভায় বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতা প্রবীণ তোগাড়িয়া ঘোষণা করেছেন, “আর দু’বছরের মধ্যেই গুজরাতকে হিন্দু-রাজ্য বানানো হবে।” তোগাড়িয়া মোদী-বিরোধী বলেই পরিচিত। যে সময় মোদী গুজরাতের উন্নয়ন মডেল নিয়ে গোটা দেশে প্রচারের পরিকল্পনা করছেন, তখন সেই গুজরাতেই হিন্দুত্বের উস্কানি দিয়ে মোদীর অস্বস্তি বাড়াচ্ছেন তোগাড়িয়া। বিজেপির প্রাক্তন তাত্ত্বিক নেতা গোবিন্দাচার্যও মোদীকে নিশানা করতে ছাড়েননি। তাঁর কথায়, “মোদীকে সংসদীয় বোর্ডে আনার সিদ্ধান্তেই স্পষ্ট, বিজেপি দিশাহীনতায় ভুগছে। দেশ সম্পর্কে মোদী ওয়াকিবহাল নন। শুধু প্রচার কৌশলের জোরেই পদ পেয়েছেন!”
গোবিন্দাচার্য এখন বিজেপিতে না থাকলেও সঙ্ঘের অনেকের সঙ্গেই তাঁর ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। উমা ভারতীর মতো নেত্রীর সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগ রয়েছে। গত কাল মোদীকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী করার বিষয়ে সরাসরি জবাব এড়িয়েছেন উমা। বলেছেন, “এটি দলের সংসদীয় বোর্ড ও জনতার দরবারে বিচার হবে।” দল ও সঙ্ঘের মধ্যে মোদীকে নিয়ে যে বিরোধ রয়েছে, তা বিলক্ষণ জানেন রাজনাথ। তাই আজ তিনি মোদীকে সংসদীয় বোর্ডে আনার সিদ্ধান্ত নিয়ে বিরোধীদের পাল্টা জবাবও দেন। বলেন, “সব দিক বিবেচনা করেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।” মোদী-ঘনিষ্ঠ নেতা অমিত শাহকে সংগঠনে আনার সিদ্ধান্তও ‘সঠিক’ বলে তিনি মন্তব্য করেন। রাজনাথ-ঘনিষ্ঠরা বলছেন, মোদীর জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে কংগ্রেস-বিরোধী হাওয়ায় পাল তুলতে চাইছেন দলের সভাপতি।
|