খোদ মুখ্যমন্ত্রী চিঠি লিখে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, এক বছরের মধ্যে যাবতীয় পরিকাঠামো গড়ে তোলা হবে। সেই সময়সীমা পেরোতে চলেছে। যে কোনও মুহূর্তে ফের পরিদর্শনে আসবে মেডিক্যাল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া (এমসিআই)-র প্রতিনিধি দল। কিন্তু এখনও প্রতিশ্রুত কাজের ৭০ শতাংশই বাকি রাজ্যের নতুন তিনটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। এরই মধ্যে স্বাস্থ্য ভবন থেকে সময়মতো টাকা না আসায় নির্মাণকাজ বন্ধ করে দিয়েছে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট সংস্থা। ফলে সব মিলিয়ে পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, তাতে এ বারও রাজ্যের মুখ পোড়ার আশঙ্কায় চিকিৎসক মহল। অনিশ্চয়তায় তিনটি কলেজের পড়ুয়াদের ভবিষ্যৎও।
এমসিআই কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, মুচলেকা দেওয়ার পরেও কথা রাখতে না পারা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। এক কর্তার কথায়, “নতুন কলেজের ক্ষেত্রে কিছু কিছু ছাড় দেওয়া হয়। কিন্তু তারও একটা সীমা আছে। একেবারে নেই-রাজ্য হলে সে ক্ষেত্রে ছাত্র-ভর্তির অনুমতি দেওয়া মেডিক্যাল শিক্ষা নিয়ে ছেলেখেলারই নামান্তর।”
এত কিছুর পরেও অবশ্য স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বলেন, “এমসিআই প্রতিনিধিদের সন্তুষ্ট করে ফেলতে পারব। সমস্যা হবে না।” কীসের ভিত্তিতে তিনি এই কথা বলছেন, যেখানে তিন কলেজের কর্তারাই স্বীকার করছেন পরিকাঠামো তৈরি নেই? এই প্রশ্নের কোনও উত্তর অবশ্য তিনি দেননি।
একটা মেডিক্যাল কলেজে যা যা থাকা দরকার বিভাগ এবং চিকিৎসক ও অন্যান্য কর্মীর নিরিখে কার্যত তার কিছুই নেই সাগর দত্ত, মালদহ ও বহরমপুর মেডিক্যাল কলেজে। গত বছর তাই পরিদর্শনে এসে ছাত্র-ভর্তি বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিল এমসিআই। শেষ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করেন। তাঁর চিঠির পরিপ্রেক্ষিতেই এমসিআই কর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন ওই তিন কলেজের কর্তৃপক্ষ। মুচলেকা দিয়ে জানানো হয়, এক বছরের মধ্যে পরিকাঠামো হবে।
কী হয়েছে এক বছরে? তিনটি কলেজ সূত্রের খবর, যা দরকার, হয়েছে বড়জোর তার ৩০ শতাংশ। বহরমপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে প্যাথোলজি, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ তৈরিই হয়নি। বায়োকেমিস্ট্রি, ফিজিওলজিতে এক জনও টেকনিশিয়ান নেই। অ্যাকাডেমিক বিল্ডিং পুরো শেষ হতে ঢের দেরি।
সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজ সূত্রে জানা গিয়েছে, এমসিআই-কে মুচলেকা দেওয়া হয়েছিল চারতলা পর্যন্ত কলেজ বিল্ডিং হবে। হয়নি। পৃথক ইমার্জেন্সি বিভাগ তৈরি হবে। তা-ও বিশ বাঁও জলে। ৪০০ অচিকিৎসক কর্মী প্রয়োজন। সরকার ৭৬টি পদ অনুমোদন করেছিল। সেখানে রয়েছেন মাত্র ছ’জন। কলেজ লাইব্রেরিতে পর্যাপ্ত বই কেনার কথা বলেছিল এমসিআই। সে কথা মেনে সাড়ে তিন হাজার বই কেনা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু কোনও গ্রন্থাগারিক এখনও আসেননি। চিকিৎসক পদের ৪০ শতাংশই শূন্য। রেসিডেন্সিয়াল মেডিক্যাল অফিসারের ৩০টি পদ খালি। সিনিয়র রেসিডেন্ট মেডিক্যাল অফিসার ৪১ জন থাকার কথা। এক জনও নেই।
মালদহ মেডিক্যাল কলেজে দোতলা বাড়ির কাঠামো তৈরি। কিন্তু দরজা-জানলা এখনও আসেনি। তৈরি হয়নি শৌচাগারও। চিকিৎসকদের বসার জন্য চেয়ার পর্যন্ত নেই। হস্টেল বিল্ডিংয়ে ক্লাস হচ্ছে। চিকিৎসক ও অন্যান্য কর্মীর অভাবে প্রয়োজনীয় বিভাগগুলি তৈরিই করা যাচ্ছে না। যে সংস্থা নির্মাণের কাজের দায়িত্বে, তারা সপ্তাহখানেক যাবৎ সমস্ত কাজ বন্ধ রেখেছে। কেন? ওই সংস্থার অভিযোগ, পাওনা টাকা মেটাচ্ছে না স্বাস্থ্য দফতর। যতক্ষণ না আগের কাজের টাকা আসবে, তত দিন পর্যন্ত তারা কাজ শুরু করবে না। বহু শ্রমিক এখনও টাকা পাননি। কলেজের এক শিক্ষক-চিকিৎসক বলেন, “যে কোনও মুহূর্তে এমসিআই-এর পরিদর্শকেরা আসবেন। তাঁদের সামনে যদি পাওনা টাকার দাবিতে বিক্ষোভ দেখানো হয়, তা হলে লজ্জার আর কিছু থাকবে না। কোনও কিছু তৈরি না করেই কেন যে মেডিক্যাল কলেজ চালু করার দুর্মতি হল স্বাস্থ্য দফতরের, তা কে জানে!”
কেন সময়মতো টাকা পাঠাচ্ছে না স্বাস্থ্য দফতর? স্বাস্থ্যকর্তারা জানিয়েছেন, এই কাজের দায়িত্বে রয়েছে মেডিক্যাল সার্ভিস কর্পোরেশন। গাফিলতি তাদের তরফেই। কর্পোরেশন সূত্রে খবর, বরাদ্দের তহবিল নিয়ে কিছু সমস্যা তৈরি হয়েছিল। দিন কয়েকের মধ্যে তা মিটে যাবে। কিন্তু তত দিনে তো এমসিআই-এর পরিদর্শন হয়ে যাবে, সেটা সামাল দেওয়া হবে কী ভাবে? তার কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি। |