পুস্তক পরিচয় ১...
মনটা খোলা রাখাই ভাল
প্রোফেসর শঙ্কুর শেষ ডায়রি, বিশ্বজিৎ রায়। লালমাটি, ১০০.০০
মাদের অনেকের মনেই বিজ্ঞান কী বা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি কাকে বলে তা নিয়ে বিশেষ কোনও সংশয় নেই। দৃশ্যগ্রাহ্য প্রমাণ বা গাণিতিক যুক্তি ছাড়া কোনও কিছু বিশ্বাস করাটাই অবৈজ্ঞানিক। এই দৃষ্টিভঙ্গির একটা গুরুগম্ভীর ইংরেজি নাম আছে পজিটিভিজম এবং যদিও ঊনবিংশ শতাব্দীর এই মতবাদটিকে আজ অনেক পেশাদার বিজ্ঞানী ও দার্শনিক অতি সরল ও সংকীর্ণ বলে মনে করেন, সাধারণ শিক্ষিত প্রগতিশীল মানুষের উপর পজিটিভিজম-এর প্রতিপত্তি একবিংশ শতাব্দীতেও অসীম, বিশেষ করে বাংলার বিদ্বৎসমাজে। গল্প উপন্যাস পড়ার সময়েও আমাদের পজিটিভিজম-এর বজ্র-আঁটন শিথিল হয় না। কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যে অনেক আপাত অসম্ভব ঘটনা আমরা মেনে নিই বটে, কিন্তু সাহিত্যিক যদি প্রাকৃতিক বিধানসমূহকে খুব প্রকট ভাবে লঙ্ঘন করেন, তা হলে অনেক পাঠকই সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠেন। শিশু ও কিশোর সাহিত্য হলে তো কথাই নেই। বিজ্ঞান সম্বন্ধে ছোটদের আজগুবি গপ্পো শোনানর চেয়ে বড় অপরাধ আর হয় না।
অনেকেই মনে করেন যে, এই অপরাধটি বারে বারে করেছেন বাংলা কিশোর সাহিত্যের দিকপাল সত্যজিৎ রায়। লীলা মজুমদার বলতেন যে, শঙ্কুর গল্প নেহাতই গাঁজাখুরি, ওতে কোনও বিজ্ঞান নেই। সোনার কেল্লা-য় জাতিস্মরবাদের সশ্রদ্ধ উপস্থাপনা দেখে হতচকিত হয়েছিলেন দুই মার্কসবাদী সেনসমর এবং মৃণাল। প্রশ্ন করেছিলেন, এটা কি আধুনিক মানসিকতার নিদর্শন? অন্যান্য, অপেক্ষাকৃত কম নামী সমালোচকও সত্যজিতের শঙ্কু-কাহিনির মধ্যে অবৈজ্ঞানিক মনোভাবের সন্ধান পেয়েছেন। নানান আড্ডায় বেশ কিছু বন্ধুকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলতে শুনেছি যে, সত্যজিতের মতো উদার, মানবিকতাবাদী শিল্পীর লেখা গল্পে ভূতপ্রেত, অলৌকিক ঘটনা ও নানাবিধ ‘কুসংস্কার’-এর উপস্থিতি শুধু দৃষ্টিকটু নয়, কিশোর পাঠকদের পক্ষে হানিকর।
সত্যজিৎ এই ধরনের সমালোচনার দুটি জবাব দিতেন। এক, যে তাঁর মনটা সব সময় খোলাঅনেকের জীবনেই অতিপ্রাকৃত ঘটনা ঘটে থাকে এবং সেগুলিকে সম্পূর্ণ উড়িয়ে দেওয়া যায় না। দুই, আজ যা আমাদের অলৌকিক বলে মনে হচ্ছে, কাল হয়তো বৈজ্ঞানিকরা তার রহস্য উন্মোচন করতে পারবেন। অর্থাৎ, আজ আমরা যাকে বৈজ্ঞানিক সত্য বলে ভাবছি তা ভবিষ্যতে অর্ধসত্য বা অসত্য বলে প্রমাণিত হতে পারে। সুতরাং মনটা খোলা রাখাই ভাল, বুদ্ধি দিয়ে যার ব্যাখ্যা হয় না তাকে চটজলদি কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দেওয়াটাই বোকামি।
সত্যজিৎ কি বিজ্ঞান বুঝতেন না, নাকি আমরাই বুঝতে পারিনি তাঁর বিজ্ঞানচেতনার চরিত্র? প্রোফেসর শঙ্কুর শেষ ডায়রি বইয়ে বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক বিশ্বজিৎ রায় এই দুরূহ প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন। বই শুরু হয় একশো বছর বয়স্ক শঙ্কুর বয়ানে। বৃদ্ধ বিজ্ঞানী সম্প্রতি স্বপ্ন দেখেছেন যে, সেই কোচাবাম্বার কেভম্যান তাঁকে বলছেন যে, জনপ্রিয়তা যেমন তাঁর বন্ধু, তেমনই তাঁর শত্রুও। তার পরপরই আসে নকুড়বাবু অর্থাৎ মাকড়দা নিবাসী আশ্চর্য মানসিক শক্তিসম্পন্ন নকুড়চন্দ্র বিশ্বাসের একটি সুদীর্ঘ চিঠি, যা পড়ে শঙ্কু জানতে পারেন যে, ভবিষ্যতের পণ্ডিতেরা প্রচুর উদাহরণ দর্শিয়ে বলবেন যে নানাবিধ অদৃশ্য শক্তিতে (এমনকী ভূতপ্রেত-এ) বিশ্বাসী শঙ্কু যতটা না বিজ্ঞানী তার চেয়ে ঢের বেশি, রাজশেখর বসুর ভাষায়, অপবিজ্ঞানী। তাঁর কীর্তিকলাপ পড়লে কিশোরদের মাথা চিরতরে বিগড়ে যাবে।
তাঁর ‘শেষ ডায়রি’তে শঙ্কু এই আক্রমণের জবাব দিয়েছেন প্রায় সত্যজিতের ভাষায়, ‘আমি জানি বিজ্ঞান আর সভ্য মানুষ সবজান্তা নয়... কাউকেই আমি সর্বশক্তিমান বলে ভাবতে চাই না, না ঈশ্বর না বিজ্ঞান।’ জ্ঞানের অহঙ্কার কমানোটা হল তাঁর জীবন ও বিজ্ঞানদর্শনের উদ্দেশ্য। মনটাকে ‘কেবল নিরেট যুক্তির দেওয়ালে আটকে’ রাখাটাকে তিনি মনে করেন বোকামি, এক ধরনের কুসংস্কার। কেমন করে যেন শঙ্কুর এই অন্তিম ডায়রি এসে পড়ে ফেলুদার হাতে, আর তিনি সেটা নিয়ে যান সিধুজ্যাঠার কাছে।
বইয়ের দ্বিতীয়, দীর্ঘতম অনুচ্ছেদ হল শঙ্কুর ডায়রির উপর সিধুজ্যাঠার টিপ্পনী, যার গোড়াতেই কবুল করা হয়েছে যে সত্যজিৎ কথিত শঙ্কুর কাহিনিতে বেশ কিছু তথ্যগত বিভ্রান্তি ও অসঙ্গতি আছে। কিন্তু সেগুলি স্বীকার করে নিলেও শঙ্কু-কাহিনিকে অপবৈজ্ঞানিক আখ্যা দেওয়া চলে না। রে ব্র্যাডবেরি ও আর্থার সি ক্লার্ক-এর গল্প পড়লেই বোঝা যায় যে, কল্পবিজ্ঞান সব সময় বর্তমানকালীন বিজ্ঞানের বিধান মেনে চলবে এমন কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। আরও নানান বিচিত্র প্রসঙ্গ এসেছে সিধুজ্যাঠার বক্তব্যে এবং সেই সব কথাবার্তার মধ্যে প্রায় খেলাচ্ছলে জ্যাঠা দেখিয়ে দেন যে, সত্যজিতের চিন্তাধারায় বিজ্ঞান ততক্ষণই মঙ্গলময় যতক্ষণ সে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে স্বাধীন ও নিজের শক্তির সীমা ও সীমাবদ্ধতা সম্বন্ধে সচেতন। মানব সভ্যতার ‘সরলরৈখিক অগ্রগতি’ যা পজিটিভিজম-এর একটি প্রধান বিশ্বাস সম্বন্ধেও সত্যজিৎ যে গভীর সন্দিহান ছিলেন সেটাও সিধুজ্যাঠা মনে করিয়ে দেন। কোচাবাম্বার কেভম্যান প্রাগৈতিহাসিক হলেও অসভ্য নন, কিন্তু আধুনিক ইয়োরোপীয় বিজ্ঞানীদের মধ্যে অনেকেই ইতর ও শয়তান।
সিধুজ্যাঠার টিপ্পনীকে কেন্দ্র করে আলোচনায় বসে ফেলুদা ও তপসে। এই অন্তিম পরিচ্ছেদে ফেলুদা দেখায় যে শঙ্কু একমাত্র সেই সব লোকের কাছে হার স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে যারা যন্ত্রসভ্যতার বাইরের মানুষযেমন হিন্দু সাধু বা চিনা জাদুকর। মানবতাবাদী সত্যজিৎ অনেকটা মুক্তধারা-র রবীন্দ্রনাথের মতো বিজ্ঞানের ভক্ত হয়েও সব সময় যন্ত্রসভ্যতার বিপক্ষে দাঁড়ান। তাঁর প্রতিবাদী সেই সত্তাটিকে অবৈজ্ঞানিক বা অপবৈজ্ঞানিক বলে উড়িয়ে দেওয়াটা শুধু ভুল নয়, মূর্খামি। এই যুক্তি সবাই বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নেবেন এমন আশা করা যায় না। কিন্তু এটা নিশ্চয়ই সবাই স্বীকার করবেন যে, সত্যজিতের বিজ্ঞানচেতনা তাঁর শিল্পী ও ব্যক্তিসত্তার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত। তাই সত্যজিৎকে বুঝতে গেলে তাঁর বিজ্ঞানচিন্তার চরিত্র অনুধাবন করতেই হবে। অথচ সত্যজিৎ-মানসে বিজ্ঞানের স্থান নিয়ে বিশ্বজিৎ রায়ের মতো তন্নিষ্ঠ ও গভীর বিশ্লেষণ কেউ কোনও দিন করেছেন বলে জানি না। এক কথায় বইটি সত্যজিৎ-চর্চার একটি মাইলস্টোন, কিন্তু যাঁরা সত্যজিৎ সম্বন্ধে নিরুৎসাহী, তাঁরাও এটি পড়লে সমৃদ্ধ হবেন। বিজ্ঞানের দার্শনিক ও সামাজিক চরিত্রের এত সুচিন্তিত প্রাঞ্জল আলোচনা বাংলায় বিরল। এই বইয়ের বক্তব্যকে কেন্দ্র করে যদি একটি সুস্থ বিতর্কের সূত্রপাত হয় ও তাতে বাঙালির বনেদি পজিটিভিজম-এর ইমারতে অন্তত কয়েকটি ফাটল ধরে তা হলে আমাদের সকলেরই মঙ্গল।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.