|
|
|
|
নন্দীগ্রাম উস্কে পুলিশের শাস্তি চেয়ে আসরে এ বার শুভেন্দু |
সন্দীপন চক্রবর্তী • মেদিনীপুর |
পাঁচ বছর আগে পঞ্চায়েত জয়ে তিনিই ছিলেন মুখ্য কারিগর। রাজ্যে পরিবর্তনের পরে এ বার পূর্ব মেদিনীপুরে পঞ্চায়েতের দুর্গরক্ষায় নতুন ঘুঁটি সাজাচ্ছেন শুভেন্দু অধিকারী। যা কার্যক্ষেত্রে তাঁকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে দলনেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরই বিপরীতে!
পঞ্চায়েত ভোটের ঠিক আগে আবার নন্দীগ্রামের স্মৃতি সামনে নিয়ে আসতে চলেছেন তমলুকের তৃণমূল সাংসদ। যার জন্য আবার জিইয়ে তোলা হচ্ছে নন্দীগ্রামের ‘ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি’কে। নন্দীগ্রামে ২০০৭ সালের ১৪ মার্চ পুলিশের গুলি চালনার ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত ও দোষীদের শাস্তির ক্ষেত্রে সিবিআইয়ের নিষ্ক্রিয়তার প্রতিবাদে আগামী ৮ এপ্রিল বিধাননগরে সিবিআই দফতরের কাছে ধর্না-অবস্থান করবে কমিটি। নেতৃত্বে থাকবেন শুভেন্দুই। তার আগে ১ এপ্রিল কলকাতা প্রেস ক্লাবে তাদের বক্তব্য ঘোষণা করার কথা প্রতিরোধ কমিটির।
নামে এই আন্দোলন সিবিআইয়ের উপরে চাপ বাড়াতে। কিন্তু তার আড়ালে বার্তা আসলে তৃণমূল নেত্রীর নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকারের প্রতিও। জমিরক্ষায় সেই সময়ের আন্দোলনকারীদের ক্ষোভ, নন্দীগ্রাম-কাণ্ডে অভিযুক্ত কয়েক জন পুলিশ অফিসার মমতা জমানায় ‘প্রাইজ পোস্টিং’ পেয়েছেন। সিবিআই যাঁদের নাম চার্জশিটে রেখেছিল, তাঁদের বিচার শুরু হয়নি। আবার বেশ কিছু অফিসারের নাম চার্জশিটে আসেইনি। তাঁরা এখন দিব্যি পরিবর্তনের সরকারের ‘গুড বুকে’ রয়েছেন! তৃণমূল সূত্রেই ব্যাখ্যা, এই পরিস্থিতিতে নন্দীগ্রামের জন্য বিচার চেয়ে ময়দানে নেমে প্রচ্ছন্ন ভাবে নিজেদের সরকারকে ‘হুঁশিয়ারি’ও দিয়ে রাখতে চাওয়া হচ্ছে পঞ্চায়েত ভোটের আগে। বিশেষত, পুলিশ দফতর যখন রয়েছে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর হাতেই!
তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের একাংশের সঙ্গে তমলুকের সাংসদের ‘দূরত্ব’ এখন শাসক দলের অন্দরে অন্যতম চর্চার বিষয়। কিছু দিন আগেই পশ্চিম মেদিনীপুরের বিনপুরে মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি সভায় ভিড় না-হওয়ার পিছনে শুভেন্দুর ‘নিষ্ক্রিয়তা’কেই অন্যতম কারণ হিসাবে দায়ী করা হয়েছিল তৃণমূলের একাংশের তরফে। পঞ্চায়েত ভোটের আগে পশ্চিম মেদিনীপুরে দলের প্রস্তুতিতে তেমন গা ঘামাতেও দেখা যাচ্ছে না তরুণ সাংসদকে। শুভেন্দুর ঘনিষ্ঠ মহল অবশ্য বলছে, দল পশ্চিম মেদিনীপুরে তাঁকে দায়িত্ব না-দিলে তাঁর কী-ই বা করণীয় আছে! সেই শুভেন্দুই এ বার নন্দীগ্রামের স্মৃতিকে উস্কে দিয়ে এবং প্রতিরোধ কমিটিকে সামনে রেখে পুলিশ-প্রশ্নে আসরে নামতে চাওয়ায় দলের মধ্যে জল্পনা জোরদার হচ্ছে।
শাসক দলের এক প্রথম সারির নেতা অবশ্য বলছেন, “নন্দীগ্রাম প্রসঙ্গে এই দাবি আপাতদৃষ্টিতে রাজ্য সরকারের পক্ষে অস্বস্তিকর মনে হতে পারে। তবে আখেরে তাতে পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূলেরই লাভ হতে পারে। আবার মুখ্যমন্ত্রীও বলতে পারবেন, দায় তাঁর নয়। তদন্তকারী সংস্থার।” জেলা পরিষদ এবং অধিকাংশ গ্রাম পঞ্চায়েত হাতে পাওয়ার পরে দুর্নীতির অভিযোগ এবং অন্তর্দ্বন্দ্বে পূর্ব মেদিনীপুরে তৃণমূল এখন যথেষ্টই বিড়ম্বনায়। এই অবস্থায় কিছু পুলিশ-কর্তার বিরুদ্ধে তোপ দেগে দলকে এককাট্টা করে ময়দানে নামাতে পারলে তাতে লাভ বই লোকসান দেখছে না শাসক দলের একাংশ।
বিগত জমানায় বাম সরকারের ‘কাছের লোক’ বলে পরিচিত ছিলেন যে পুলিশ-কর্তারা, রাজ্যপাটে পরিবর্তনের পরেও তাঁরা কেন স্বমহিমায় বহাল এই প্রশ্নই তুলতে শুরু করেছে প্রতিরোধ কমিটি এবং তৃণমূলেরই একাংশ। পঞ্চায়েত ভোটের আগে অন্তত তিন জেলার পুলিশ সুপারের অতীত ভূমিকার জন্য গুরুতর উষ্মা দেখা দিচ্ছে শাসক শিবিরের অন্দরে। বিরোধী নেত্রী হিসাবে যাঁদের ভূমিকার বিরুদ্ধে ময়দানে নামতে দেখা গিয়েছিল মমতাকে, মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে তাঁরই বরাভয় কী ভাবে পেয়ে যাচ্ছেন এক শ্রেণির পুলিশ অফিসার বিস্মিত তৃণমূলের কিছু নেতা-কর্মী! আর এই উষ্মাকেই কাজে লাগাতে চাইছেন শুভেন্দুরা।
প্রতিরোধ কমিটির নেতাদের বক্তব্য, সেই ১৪ মার্চ নন্দীগ্রামে গুলি চলেছিল গোকুলনগর অধিকারীপাড়া এবং ভাঙাবেড়া দু’টি জায়গা থেকে। অধিকারীপাড়ায় দায়িত্বে-থাকা অফিসারদের মধ্যে তিন জনের নাম সিবিআইয়ের চার্জশিটে ছিল। অথচ তাঁদের মধ্যে এক জন নতুন জমানায় কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার স্তরে উন্নীত হয়েছেন, এক জন খড়গপুরে ‘ভাল পোস্টিং’ পেয়েছেন! প্রতিরোধ কমিটির এক নেতার কথায়, “ভাঙাবেড়ার দিকে রোদচশমা পরে যে অফিসার ঘোষণা করেছিলেন সরে না-গেলে এ বার গুলি চালাব, তিনি এখন দক্ষিণবঙ্গের একটা বড় জেলার পুলিশ সুপার!” নন্দীগ্রামের অভিযানের সময় ডিআইজি (মেদিনীপুর) ছিলেন যে দক্ষিণী আইপিএস, তিনিও এখন এডিজি র্যাঙ্কে কাজ করছেন।
তৃণমূলেরই এক বিধায়কের ক্ষোভ, “জমি-আন্দোলন তুঙ্গে থাকাকালীন তৎকালীন বিরোধী নেত্রী এবং দক্ষিণ কাঁথির বিধায়ককে (শুভেন্দু) ঘিরে ফেলে মেরে ফেলার চক্রান্তে যে অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল, তিনি এখন সরকারের আস্থাভাজন হয়ে উত্তরবঙ্গের একটি জেলার পুলিশ সুপার!” দলের এক নেতার আরও বক্তব্য, “২০০৯-এর অগস্টে মঙ্গলকোটে শুভেন্দু অধিকারী, মদন মিত্রের মিছিলে লাঠি, কাঁদানে গ্যাস চালিয়েছিলেন বর্ধমানের তৎকালীন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (গ্রামীণ)। তার প্রতিবাদে বর্ধমানে সভা করতে হয়েছিল রেলমন্ত্রী মমতাদি’কে। কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলার এসপি-র দায়িত্বে এখন সেই অফিসার!” প্রতিরোধ কমিটির নেতারা বলছেন, নন্দীগ্রাম-কাণ্ডে অভিযুক্ত পুলিশ-কর্তাদের শাস্তি আটকাতে সুপ্রিম কোর্টে স্পেশ্যাল লিভ পিটিশন দাখিল করেছিল বাম সরকার। বর্তমান সরকার সেই আবেদন প্রত্যাহার করে নেয়। তার পরে আর অভিযুক্ত অফিসারদের বিরুদ্ধে তদন্তের প্রক্রিয়া শেষ করতে কোনও বাধা থাকার কথা নয় বলেই তাঁদের দাবি।
খোদ শুভেন্দু শুধু বলছেন “১৪ মার্চের গণহত্যার বিষয়ে নন্দীগ্রামের মানুষের দাবি যুক্তিসঙ্গত। এই দাবির জন্য যত দূর যেতে হয়, যেতে আমি প্রস্তুত!” বার্তা সংক্ষিপ্ত। কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ! |
|
|
|
|
|