আরও একটি দুঃসংবাদ: চলতি অর্থবর্ষের তৃতীয় ত্রৈমাসিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) বৈদেশিক লেনদেনের চলতি খাতে ঘাটতির পরিমাণ ভারতের মোট অভ্যন্তরীণ উত্পাদন বা জিডিপি’র ৬.৭ শতাংশে পৌঁছাইল। ঘাটতির অনুপাত ইতিপূর্বে কখনও এত বেশি হয় নাই। দেশ যত বিদেশি মুদ্রা উপার্জন করে এবং যতটা খরচ করে, দুইয়ের ফারাকই এই ঘাটতির অঙ্কে ধরা পড়ে। অস্যার্থ: ভারত যত ডলার আয় করিতেছে, ব্যয় করিতেছে তাহার অনেক বেশি, এবং অনেক ক্রমশই অনেকতর হইতেছে। চলতি খাতে ঘাটতির বৃহত্তম কারণ বাণিজ্য ঘাটতি, অর্থাত্ রফতানি ও আমদানির ফারাক। তাহা দেশের জিডিপি’র ১২ শতাংশেরও বেশি। আলোচ্য তৃতীয় ত্রৈমাসিকে গত অর্থবর্ষের তৃতীয় ত্রৈমাসিকের তুলনায়, আমদানির পরিমাণ নয় শতাংশ বাড়িয়াছে, কিন্তু রফতানি কার্যত একই জায়গায় রহিয়া গিয়াছে। অর্থাত্, আন্তর্জাতিক বাজারে টাকার দাম কমিবার কোনও সুবিধা রফতানি ক্ষেত্র লইতে পারে নাই, কিন্তু আমদানির ক্ষেত্রে তাহার বোঝা বহিতে হইতেছে। আমদানির বড় অংশ জুড়িয়া আছে পেট্রোলিয়াম এবং সোনা। এই দুইটি পণ্য অর্থমন্ত্রীকে গভীর উদ্বেগে রাখিবে। আরও একটি পণ্য ক্রমেই ‘বিপজ্জনক’ হইয়া উঠিতেছে। তাহার নাম কয়লা। ভারতে কয়লা আমদানির পরিমাণ বাড়িয়াছে, এবং আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম বাড়ায় আমদানির খরচও বাড়িয়াছে। ভারত যদি দ্রুত শিল্পায়নের পথে হাঁটে, তবে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা আরও বাড়িবে। সেই চাহিদা পূরণ করিতে আমদানির দিকে তাকাইয়া থাকিতে হইলে বিপদ। কয়লা বা লৌহ আকরিক উত্তোলনের গতি বৃদ্ধির জন্য সরকারকে যথার্থ নীতি গ্রহণ করিতে হইবে। চলতি খাতে ঘাটতি পূরণ করা ভিন্ন ভারতের উপায় নাই। সেই টাকা আসিবে কোন পথে? প্রথমত, ভারতের রফতানি ক্ষেত্রকে গা ঝাড়া দিয়া উঠিতে হইবে। মার্কিন অর্থনীতি ক্রমে বিপদ কাটাইয়া উঠিতেছে। ইউরোপেও আর্থিক স্থিতিশীলতা ফিরিবে বলিয়াই আশা। ভারতের রফতানি ক্ষেত্রকে এই বাজারে ভাগ বসাইতে হইবে। কিন্তু তাহা মূলত বিশ্ব বাজারের উপর নির্ভরশীল। ফলে, রফতানির গতিবৃদ্ধির আশায় বসিয়া থাকিলে চলিবে না। পেট্রোলিয়াম আমদানি করিতে যত খরচ পড়ে, তাহা সম্পূর্ণত ক্রেতার উপর চালান না করিয়া অর্থমন্ত্রীর আর উপায় নাই। রাজনৈতিক ভাবে যতই অপ্রিয় হউক, এই সিদ্ধান্ত তাঁহাকে করিতেই হইবে। দেশের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা রঘুরাম রাজন খানিক হতাশ কণ্ঠে জানাইয়াছেন, সোনার প্রতি সাধারণ মানুষের আকর্ষণ সাময়িক ভাবে হইলেও কমিবে কি না, তাহার উপরও পরিস্থিতির অভিমুখ নির্ভর করিবে। অর্থমন্ত্রী সোনা আমদানির পরিমাণ কমাইতে জানুয়ারি মাসেই কর বসাইয়াছিলেন। তাহার খানিক প্রভাব চতুর্থ ত্রৈমাসিকের ঘাটতির হারে দেখা যাইবে বলিয়াই আশা। কিন্তু অর্থমন্ত্রীও জানেন, যত ক্ষণ বিনিয়োগের বাজার যথেষ্ট লাভজনক না হইতেছে, তত ক্ষণ সোনার হরিণের মোহ ভাঙিবার নহে। আপাতত সমস্যার মোকাবিলার জন্য অর্থ মন্ত্রক যাহার পথ চাহিয়া আছে, তাহা বৈদেশিক বিনিয়োগ। কিন্তু সমস্যা হইল, ভারত যখন প্রাণপণে বৈদেশিক বিনিয়োগের সন্ধান করিতেছে, তখন গোটা বিশ্বেই সেই অর্থের ধারা অতি ক্ষীণ। ২০১২-১৩’র তৃতীয় ত্রৈমাসিকে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ ২০১১-১২’র তৃতীয় ত্রৈমাসিকের তুলনায় কমিয়াছে। স্বাভাবিক, কারণ অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগের হার যদি শ্লথ হইয়া পড়ে, বৈদেশিক বিনিয়োগেরও গতিভঙ্গ হইবে। রঘুরাম রাজন বলিয়াছেন, তিনি মুখ্যত প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ ও বিদেশি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগের ভরসাই করিতেছেন, ‘হট মানি’ অর্থাত্ ফাটকা কারবারের ক্ষণ-লগ্নি তিনি চাহেন না। তাঁহার প্রত্যাশা কত দূর পূরণ হইবে, বলা মুশকিল। চতুর্থ ত্রৈমাসিকে (জানুয়ারি-মার্চ) বিদেশি বিনিয়োগ তুলনায় বেশি আসিয়াছে বটে, কিন্তু তাহার সিংহভাগই সম্ভবত শেয়ার ও ঋণপত্রে স্বল্পমেয়াদি লগ্নি। অভ্যন্তরীণ বা আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে সামান্য দোলাচলের সৃষ্টি হইলেই সেই বিনিয়োগ বাজার ছাড়িবে। সুস্থায়ী বিদেশি বিনিয়োগ যাহাতে ভারতকে ফের তাহার স্বাভাবিক গন্তব্য জ্ঞান করে, তেমন পরিবেশ তৈরি করাই এখন কর্তব্য। |