|
|
|
|
|
|
|
সিনেমা সমালোচনা... |
|
হাওয়া বদলানোর চেষ্টাটা পরম পাওয়া |
চিত্রনাট্যে একটা ম্যাজিকের প্রয়োজন ছিল। লিখছেন শঙ্করলাল ভট্টাচার্য |
পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের ‘হাওয়া বদল’কে বাংলায় এক হাওয়া বদল ছবি বললে খুব একটা অত্যুক্তি হবার না।
ছবিটাকে বলে ফেলার ধরনটার মধ্যেই একটা নতুন ঝাঁঝ আছে। পরমব্রত বেছে নিয়েছেন একটা কাট টু কাট স্টাইল। একটা উগ্র সমসাময়িক বৃত্তান্ত। দুটি চরিত্রের স্মৃতি-সত্তা-ভবিষ্যৎ অদলবদলের মতো আধুনিক ছোট গল্প বা অ্যাবসার্ড নাট্যঘেঁষা এক ঘটনা। মূলত সংলাপধর্মী বিস্তার। রঙ্গরসকৌতুকে আচ্ছন্ন সিকোয়েন্স এবং কোনও একটা স্তরে একটা সামাজিক মন্তব্যের ভঙ্গি। এক নিশ্বাসে এতটা বলে ফেলার পর আমাকে একটু জিরোতেই হবে।
এত উচ্চকাঙ্ক্ষী একটা প্রকল্পের পিছনে আমার ধারণা, পরমব্রতর ব্রিটেনে বৃত্তি নিয়ে বৎসরকাল সিনেমা-নাটক ইত্যাদি পড়াশুনোর কিছু হাত আছে। ওঁর বিষয়ভাবনা, চিত্রনাট্য এবং পরিচালনার মধ্যে অনেকখানি বিলিতিয়ানা ছেয়ে আছে। সেখানে প্রশ্ন হবে সেই বিলিতি মেজাজে কলকাতার জীবনকে কতটা মিলিয়ে দেওয়া গেল। তা দেখতে ‘হাওয়া বদল’য়ের কাহিনি-রেখার একটু আঁচ চাই। |
|
হাওয়া বদল পরমব্রত, রুদ্রনীল, রাইমা, নেহা, কৌশিক |
তরুণ, উদ্যমী ব্যবসায়ী জিৎয়ের (পরমব্রত) সঙ্গে হঠাৎ দেখা ছেলেবেলার বন্ধু ব্যান্ডশিল্পী রাজর্ষির (ছোট করে রাজ, অভিনয়ে রুদ্রনীল)। জিৎ ওর কোম্পানির মালিকের মেয়েকে বিয়ে করে কোম্পানির অংশীদার। রাজ গানের কেরিয়ার বানাতে বেশ কিছু কাল মুম্বই চষে আপাতত কলকাতায় থিতু তার ‘প্রহরী’ ব্যান্ড নিয়ে। কপাল এবং চরিত্র দুই দিক দিয়েই জিৎ এবং রাজ দুই মেরুর বাসিন্দা। রাজকে জিৎ ডেকে নিয়ে গেল অফিসে এবং সেখান থেকেই শুরু হয়ে গেল গল্প। কিংবা বলা চলে এর আরেকটু পর সন্ধেবেলা থেকে। যখন জিৎ রাজকে নিয়ে ব্যবসার কানেকশনে মিস্টার মানকোটিয়ার মেয়ের জন্মদিনের পার্টিতে হাজির হল।
পার্টিতে মদ কিছু কম খাওয়া হয়নি দু’জনের। সেখানে রাজ প্রায় পিছু নিয়ে আলাপও করে ফেলল মানকোটিয়ার (ওর বর্ণনায় মানকচু) ড্রাগাসক্ত কন্যা ইনকার (নেহা পন্ডা) সঙ্গে। তারপর বাড়ি ফেরার পথে রাজ ও জিতের নেশা চাপল আরও মদ্যপানের। মাঝরাত্তিরে জনশূন্য সাহেব পাড়ায় গাড়ি থামিয়ে দু’জনের গুলতানির বিষয় হল, বাস্তবে কে সত্যি কেমন আছে। এবং এরও পরের পরিস্থিতি হল দু’জনে খোলা রাস্তায় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে মূত্রত্যাগ করতে করতে ঠিক করল দু’জনে জীবন বদলাবদলি করবে। মনে মনে জিৎ হয়ে যাবে রাজ, আর রাজ হয়ে যাবে জিৎ। এবং হয়েও গেল।
সিনেমায় যার সংজ্ঞায় গোদার বলেছেন, ‘সিনেমা ইজ দ্য রিয়্যালিটি টোয়েন্টি ফোর টাইমস আ সেকেন্ড’ এই জীবন ও মনস্তত্ত্ব স্থানান্তর অবশ্যি তত সহজে হয় না। জিৎ হয়ে গেল রাজ এবং রাজ জিৎ, বললেই কিন্তু ওরা তা হয়ে যায় না। প্রতি মুহূর্তের এই টানাপোড়েনকে বাস্তব করে তোলা ইউরোপের কাল পরীক্ষিত অ্যাবসার্ড নাটকের সুদীর্ঘ সংগ্রাম। সিনেমায় (যা অ্যাবসার্ড নাটকের চেতনা ও ধর্ম থেকে ধার করতেই পারে) এ কাজ সফল করে তোলা জীবনের প্রথম টেস্টে ডবল সেঞ্চুরির মতো দুঃসাধন। পরমব্রত চেষ্টার ত্রুটি করেননি, কিন্তু তার পারা-না পারা নিয়ে দর্শকরা দিব্যি দু’ভাগে ভাগ হয়ে যাবেন। কিছু করার নেই। ‘হাওয়া বদল’য়ে দর্শক দেখছেন, বাড়ি ফিরে ভেতরে ভেতরে রাজ হয়ে যাওয়া জিৎ অদ্ভুত ব্যবহার করছে স্ত্রী তনুর (রাইমা) সঙ্গে। তনুর মাথায় খেলছে না, বরটার কী হল। দর্শকেরও মাথায় খেলছে না। দুনিয়ার যাবতীয় স্ল্যাংয়ে অভ্যস্ত রাজও যখন পরিশীলিত, পরিপাটি ভাষায় চলে যাচ্ছে, তার আশপাশের লোকজনের মতো দর্শকও বিশেষ তল পাচ্ছেন না হাওয়া বদলটার।
মিউজিক কোম্পানির মালিকের বৌ ফুর্তি করবে বলে ওকে ধাওয়া করে এসে দেখছে লোকটার হলটা কী, বিনি পয়সার সেক্সেও রুচি নেই! জিৎয়েরও দাম্পত্যে অনুরূপ সমস্যা একটা অনবদ্য ‘ভ্রান্তিবিলাস’ গড়ে উঠতে উঠতেও কেন হেলে পড়ল, এমনকী একটা অপরূপ প্রহসনও তৈরি হল না, এর কারণ একটাই নিছক ওদের অসংলগ্ন সংলাপের ভিত্তিতে সারাক্ষণ জিৎকে রাজ আর রাজকে জিৎ মনে করে নেওয়া কঠিন কাজ। চিত্রনাট্যে একটা ম্যাজিকের প্রয়োজন ছিল, যেটা নেই।
তবু ‘হাওয়া বদল’য়ের গুরুত্ব কমানো যায় না। সংলাপে জোর আছে, যদিও খিস্তাখিস্তির বেশ বাড়াবাড়ি। খুব পাকা অভিনয় রুদ্রনীলের। বিশেষ করে ও যখন নির্ভেজাল রাজ, যে সময় স্ল্যাং-ই ওর ফার্স্ট ল্যাংগোয়েজ। জিৎ হিসেবে পরমব্রত বিশ্বাসযোগ্য। রাজ হিসেবে, ভাষা ও শরীরী ভাষায় টান পড়েছে। বেশ লাগসই কাজ কমলিকা ও কৌশিকের। আর ইনকা চরিত্রে নবাগতা নেহা পন্ডা দিব্যি দুরন্ত। শুধু রাগ, রাগ আর রাগ করে যাওয়া তনু চরিত্রে বিশেষ কাজ নেই রাইমার। বেচারি! শেষে দুটো ঠোঁটে ঠোঁট চুমু দিয়ে ওঁকে হয়তো বুঝ মানানো গিয়েছে। ‘হাওয়া বদল’য়ের সত্যিকার সম্পদ ক্যামেরা, সঙ্গীত ও পরিচালনা। ক্যামেরায় সুপ্রিয় দত্তর নিপুণ অ্যাঙ্গেল এবং প্রবহমানতা আছে, ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তর সঙ্গীতে সময়টা ছবির মতো ধরা পড়ে। রোম্যান্টিক আধুনিক কম্পোজিশন ছাড়াও যে আটপৌরে ভাবেও রবীন্দ্রসঙ্গীত লাগিয়েছেন, তা খুবই কেরামতির কাজ। চিত্রনাট্যে যা আছে, সেটা অন্তত সেলুলয়েডে তুলতে বেশ দক্ষতা দেখিয়েছেন পরমব্রত। বাঙালি সিনেমায় কী নেয় বা না নেয় না, সেই নাড়ির জ্ঞান এত দিনে নিশ্চয়ই হয়েছে ওঁর এবং তার পরেও যে এ হেন বিষয় ও চলন নিয়ে হাওয়া বদলানোর চেষ্টায় নেমেছেন, এটাই কিন্তু কৃতিত্ব ওঁর। আশা করব, হট্কে কাজ করা থেকে তিনি বিরত হবেন না। |
|
|
|
|
|