|
|
|
|
|
|
|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
বারবার প্রতিধ্বনিত হয় ‘নষ্ট’ সময়ের আর্তনাদ |
স্টুডিয়ো ২১-এ অনুষ্ঠিত হল সৌগত দাসের একক প্রদর্শনী। লিখছেন মৃণাল ঘোষ। |
সম্প্রতি স্টুডিয়ো ২১-এ অনুষ্ঠিত হল তরুণ শিল্পী সৌগত দাসের একক প্রদর্শনী। সৌগত ২০০২ সালে রবীন্দ্রভারতী থেকে চিত্রকলায় স্নাতকোত্তর শিক্ষা শেষ করেছেন। তার পর থেকে নিয়মিত কাজ করে জীবনবোধ ও সামাজিক দায়বোধে দীপ্ত নিজস্ব এক আঙ্গিকপদ্ধতি গড়ে তুলেছেন। ১৮টি বড় ক্যানভাস নিয়ে আলোচ্য প্রদর্শনীটিতে প্রতিবাদী চেতনাদীপ্ত বিকল্প রূপকল্পের সঙ্গে শিল্পী দেশীয় পরম্পরাগত রূপরীতিকে সমন্বিত করেছেন প্রজ্ঞাদীপ্ত ভাবে।
প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘স্ক্রিম’। আমরা জানি ‘দ্য স্ক্রিম’ নরওয়ের প্রখ্যাত শিল্পী এডওয়ার্ড মুঙ্খ-এর (১৮৬৩-১৯৪৪) শিল্পের জগতে আলোড়ন সৃষ্টিকারী অত্যন্ত সুপরিচিত ছবি। ছবিটির ভিতর ধরা আছে মানব মনস্তত্ত্বের তীব্র আর্তি ও ক্রন্দন। তেলরং মাধ্যমে ছবিটি আঁকা হয়েছিল ১৮৯৩ সালে। ১৮৯৫তে এর একটি সাদা-কালো লিথোগ্রাফ সংস্করণ করা হয়। ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে সূর্যাস্তের রক্তিম আকাশের প্রেক্ষাপটে নদীর উপরের একটি সেতুর উপর একজন মানুষের ভয়ার্ত চিৎকার। মুঙ্খ-এর অধিকাংশ ছবিতেই প্রতিফলিত হয় মানুষের এই আত্মিক সংকট। তবু ‘দ্য স্ক্রিম’ ছবিটিই সব চেয়ে বেশি পরিচিত আধুনিকতা ও উত্তর-আধুনিকতার কালপর্বে সভ্যতার সংকটের প্রতীক হিসেবে। ১৯০৫ সাল থেকে ইউরোপীয় চিত্রকলায় শুরু হয়েছিল যে অভিব্যক্তিবাদী আন্দোলন, মুঙ্খ ছিলেন তারই প্রধান পূর্বসূরি। |
|
শিল্পী: সৌগত দাস |
সৌগত এই ছবিটিকে সভ্যতার সংকটের প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করে আজকের সামাজিক ও আত্মিক বিপর্যয়কে তাঁর ছবিতে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছেন। এই আত্মিক শূন্যতাকেই শিল্পী তাঁর ছবিতে রূপায়িত করেছেন অত্যন্ত উচ্চকিত চিত্রভাষায়। বৈদ্যুতিন প্রযুক্তির উন্নতির ফলে আজকের জীবন ও প্রকাশভঙ্গি নানা রকম চিহ্ন ও প্রতীকে সমাকীর্ণ। এই চিহ্ন ও প্রতীককে পরিস্ফুট করার জন্য নানা রকম চিহ্ন-প্রতিমা বা ‘আইকন’ ব্যবহৃত হয়। সৌগত দেখিয়েছেন কী ভাবে এই ‘আইকন’ মানুষের শরীর, মন বা সমগ্র অস্তিত্বকে প্লাবিত করে তার আত্মপরিচয়কে ধ্বংস করছে।
অবয়বের উপর এই ‘আইকন’গুলিকে ঘনসংবদ্ধ ভাবে প্রতিস্থাপিত করেছেন শিল্পী। অলঙ্করণময়তা জেগে উঠেছে তা থেকে। এই অলঙ্করণময়তা আমাদের পরম্পরাগত শিল্পের একটি বৈশিষ্ট্য। আমাদের বস্ত্রশিল্পে, ধাতু বা দারুশিল্পে, লোকশিল্পের বিভিন্ন শাখাপ্রশাখায় এই অলঙ্করণের ব্যাপক প্রকাশ আমরা দেখে থাকি। এই অলঙ্করণ পদ্ধতিকে তাঁর ছবিতে ব্যবহার করেছেন শিল্পী। কিন্তু স্বভাবতই তার চরিত্র পালটেছে। পরম্পরায় যা ছিল নিছকই সৌন্দর্য, নিছকই ছন্দ, এখানে তা তির্যক ভাবে ব্যক্তিগত ও সামাজিক সংকটকে প্রতিধ্বনিত করেছে। পাতলা অ্যালুমিনিয়ামের পাত ব্যবহার করেছেন ক্যানভাসের উপর। তার উপর স্বচ্ছ ও অস্বচ্ছ অ্যাক্রিলিক রঙে এঁকেছেন। সমস্ত ছবিরই প্রেক্ষাপটে রয়েছে তীব্র অন্ধকার। সেই কালোও নানা রকম ভাবে অলঙ্কৃত। তার উপর প্রতিমাকল্প গড়ে উঠেছে উজ্জ্বল সোনালি, রুপোলি, লাল, নীল ইত্যাদি বর্ণে। কিন্তু প্রয়োগ ও অভিব্যক্তির পদ্ধতিতে এই ঝংকার আর্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে। ‘ফ্যানাটিক’ ছবিটিতে দৌড়ের প্রতিমাকল্প। মানুষের অস্তিত্ব নেই। শুধু হাত ও পায়ের গতিবিভঙ্গে লক্ষ্যহীন ছোটার ঝংকারটুকু আছে। সেই অবয়বের ভিতর জমাট বেঁধে ছড়িয়ে আছে পিস্তল, রাইফেল, বুলেট ইত্যাদি মারণাস্ত্রের চিহ্ন-প্রতিমা। ‘ডিকমপোজড’ ছবিটিতে মৃত এক যুবকের উলটোনো শবদেহ পড়ে আছে। দেহটি গড়ে উঠেছে অজস্র পোকার সন্নিবেশে। পোকাগুলি ঘনসংবদ্ধ হয়ে গড়ে তুলেছে লোকটির শরীর। ‘লিকড আপ’ ছবিটিতে মা কালীর প্রতিমাকল্প ব্যবহার করেছেন। রয়েছে শুধু মুখবিবর থেকে বেরিয়ে আসা প্রসারিত লাল জিহ্বা। সেই জিহ্বার ভিতর সন্নিবিষ্ট হয়েছে অজস্র ছুটন্ত বিপর্যস্ত মানুষের প্রতিমাকল্প। ‘টু লাউড’ ছবিটিতে বিরাট হাঁ করে আছে বিশাল একটি মুখ। চোখদু’টি লাল। আর্তনাদেরই এক প্রত্যক্ষ প্রতীক গড়ে উঠেছে যেন। ‘ডাউনপোর’ ছবিতে একটি খোলা কলের জল থেকে অপ্রয়োজনে জল পড়ে প্লাবনের সৃষ্টি করছে। সেই প্লাবনে ভেসে যাচ্ছে মানুষের ব্যবহার্য সমস্ত উপকরণ। এই ভাবে ছবিতে শিল্পী এই নষ্ট সময়ের আর্তনাদকে প্রতিধ্বনিত করেছেন। |
|
|
|
|
|