স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বের অত্যুৎসাহে ফের বিড়ম্বনায় রাজ্য সরকার এবং শাসক দল। এ বারের ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে গেল টাটার নাম।
কলকাতায় টাটা গোষ্ঠীর পাঁচ তারা হোটেলের কর্মীদের নিয়ে রবিবার আত্মপ্রকাশ করল তৃণমূল শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসি-র নতুন ইউনিট! আলিপুরে ওই হোটেলের সামনে তৃণমূলের পতাকা নিয়ে রীতিমতো সভা করে ঘোষণা করা হল সেই আত্মপ্রকাশ! তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের নির্দেশ দিলেন, ঝান্ডা নামিয়ে আজ, সোমবার সকালের মধ্যেই গুটিয়ে নিতে হবে ওই ইউনিয়ন। পার্থবাবু একই সঙ্গে তৃণমূলের মহাসচিবও বটে। তাঁর নির্দেশ পেয়ে রাতেই দক্ষিণ কলকাতার স্থানীয় তৃণমূল ও শ্রমিক সংগঠনের নেতৃত্ব মেনে
|
শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় |
নিয়েছেন, তাঁদের ভুল হয়েছিল। দ্রুতই তা সংশোধন করা হবে।
পাশাপাশিই এ দিন সন্ধ্যাতেই হোটেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছেন শিল্পমন্ত্রী। আশ্বাস দিয়েছেন, তাঁদের ব্যবসায় কোনও ক্ষতি যাতে না হয়, তা দেখা হবে।
শিল্পমন্ত্রীর কথায়, “পর্যটন ব্যবসায় এ ভাবে ঝান্ডা তুলে রাজনীতি করার চেষ্টা মানা হবে না। দল এবং শ্রমিক ইউনিয়নের স্থানীয় ও রাজ্য নেতৃত্বকেও এ কথা পরিষ্কার বলে দেওয়া হয়েছে। হোটেল কর্তৃপক্ষকে বলেছি, কোনও সমস্যা হয়ে থাকলে আলোচনা করেই মেটাতে হবে। ওখানে কর্মচারীদের দাবি-দাওয়া নিষ্পত্তির যে স্বীকৃত পদ্ধতি আছে, তার বাইরে যাওয়া উচিত হবে না।”
পার্থবাবুই জানিয়েছেন, ওই হোটেলে এখন কোনও দলেরই এই রকম ইউনিয়ন নেই। বস্তুত, টাটা গোষ্ঠীর কোনও অভিজাত হোটেলেই স্থায়ী কর্মীদের নিয়ে এই রকম ইউনিয়ন নেই। বিশেষত, মুম্বইয়ের হোটেলে সন্ত্রাসবাদী হানার (২৬/১১) পর থেকে নিরাপত্তার খাতিরেই টাটা গোষ্ঠী এই বিষয়ে বেশ কড়া। কোথাও কোনও সমস্যা হলে কর্মচারীদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করে মিটিয়ে নেওয়া হয়। তৃণমূলের কিছু নেতা-কর্মীর অত্যুৎসাহে এই পদ্ধতি ভেঙে গিয়ে এ রাজ্যে ব্যবসার পরিবেশ সম্পর্কেই ভুল বার্তা যাক রাজ্য সরকার তা চায় না বলেই ইঙ্গিত দিয়েছেন পার্থবাবু।
শাসক দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের দাপটে ব্যবসা করতে সমস্যায় পড়ছে কোনও কারখানা বা গোষ্ঠী রাজ্যের নানা প্রান্তে এই রকম একের পর এক ঘটনা ঘটছে। হলদিয়া থেকে বিদায় নিতে হয়েছে এবিজি গোষ্ঠীকে। অন্যান্য জেলাতেও বিপাকে পড়েছেন একাধিক শিল্পপতি। আলিপুরের হোটেলের ঘটনায় আরও বেশি চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছিল টাটা-তৃণমূল সমীকরণের খাতিরে। সিঙ্গুর থেকে টাটারা ন্যানো কারখানা সরিয়ে নেওয়ায় আন্দোলনকারী তৃণমূলের গায়ে যে কালি লেগেছে, সুকৌশলে তারই বদলা নেওয়ার জন্য ওই সংস্থার হোটেলে ইউনিয়ন চালু করা হল কি না এমন জল্পনা শুরু হয়েছিল। ইউনিয়ন খোলার চেষ্টার খবর পেয়ে আগেই রাজ্য সরকারের দ্বারস্থ হয়েছিলেন হোটেল কর্তৃপক্ষ। তা সত্ত্বেও এ দিন ওই হোটেলের ১৭০ জন কর্মীর নাম নতুন ইউনিটে নথিভুক্তি উপলক্ষে আলিপুরে সভা করে তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসি। নেতৃত্বে ছিলেন, তৃণমূলের স্থানীয় ৭৪ নম্বর ব্লক সভাপতি বিপ্লব মিত্র। সভায় ছিল দলীয় পতাকা, ব্যানার। যাঁদের নিয়ে ইউনিয়ন করা হল বলে তাদের দাবি, তাঁদের মধ্যে হোটেলের কিছু স্থায়ী কর্মীও ছিলেন। |
টাটা গোষ্ঠীর হোটেলের সামনে তৃণমূলের পতাকা। —নিজস্ব চিত্র |
এর পর টাটা গোষ্ঠীর হোটেল ব্যবসা দেখভালের ভারপ্রাপ্ত সংস্থা আইএইচসিএল-এর তরফে বলা হয়, “রাজ্যে যে কোনও শিল্পে ইউনিয়নের স্বীকৃতি দেওয়া বা তা বাতিল করার জন্য আইনি প্রক্রিয়া আছে। আমরা সেই প্রক্রিয়াই মেনে চলব।”
অন্য দিকে, আইএনটিটিইউসি-র রাজ্য সভানেত্রী দোলা সেন বলেন, “আমাকে ১০ হাজার ইউনিট পরিচালনা করতে হয়। কে কোথায় কোন ইউনিট খুলল, তার খুঁটিনাটি জানা সম্ভব নয়! জেলা সভাপতির কাছ থেকে জেনে নিন।”
দক্ষিণ কলকাতা জেলা আইএনটিটিইউসি সভাপতি মেঘনাথ পোদ্দারও এ দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত বিষয়টি জানেন না বলেই দাবি করছিলেন। পরে তিনি বলেন, “স্থানীয় নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, ইউনিটটি খোলার জন্য গত কাল (শনিবার) সরকারের শ্রম দফতর থেকে ওঁরা রাজ্য সরকারের অনুমোদন পেয়েছেন। দোলের পরে আমার সঙ্গে দেখা করবেন ওঁরা। তখনই দলের অনুমোদনের জন্য সুপারিশ করব।”
হোটেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কর্মীদের দাবি-দাওয়ার মীমাংসা করতে এর আগে আলোচনায় গিয়েছিলেন ক্রীড়ামন্ত্রী মদন মিত্র। হোটেলটি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিধানসভা কেন্দ্র ভবানীপুরের মধ্যে পড়ে এবং মদনবাবু সেখানকার বাসিন্দা। ক্রীড়ামন্ত্রীর বক্তব্য ছিল, “ওই তৃণমূল কর্মীরা আমার পরিচিত। আমি হোটেল কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছিলাম, আলাপ-আলোচনা করে সমস্যা মিটিয়ে নিতে। তৃণমূলের কর্মীদেরও একই কথা বলেছিলাম। যাতে কোনও অপ্রীতিকর পরিস্থিতি ওখানে তৈরি না হয়।”
পার্থবাবুর হস্তক্ষেপের আগে বিপ্লববাবু বলেছিলেন, “গত দু’তিন মাস ধরে ওই হোটেলে ইউনিট খোলার চেষ্টা চালাচ্ছিলাম। ওখানকার স্থায়ী কর্মীরাই আইএনটিটিইউসি-তে যোগ দিতে ইচ্ছুক ছিলেন। শেষমেশ ইউনিট খুলতে পারলাম।” পরে রাতে তিনি বলেন, “এত দিন মুখ্যমন্ত্রী বা আইএনটিটিইউসি-র কোনও নেতাকেই ব্যাপারটি জানাইনি। দলের উচ্চতর নেতৃত্বকে না-জানিয়ে এমন কাজ করতে যাওয়া ভুল হয়েছিল!” কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী অজ্ঞাতসারে এত বড় ঘটনা ঘটেছে বলে মানতে নারাজ তৃণমূলেরই একটি অংশ। তাদের প্রশ্ন, পার্থ চট্টোপাধ্যায় শিল্পমন্ত্রী হয়ে কোনও শিল্প প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক সংগঠন হবে কি হবে না, সেটা বলার কে? সংগঠন করার অনুমতি তো দিয়েছে শ্রম দফতর। ফলে শিল্পমন্ত্রীর নিষেধাজ্ঞার পরেও টাটার জল আরও বহু দূর গড়াবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় থেকে যাচ্ছে বলেই শাসক দলের একাংশের মত। |