গল্পের টানে বাড়ছে কীর্তনের কদর
সুসজ্জিত এবং বিশাল এক নাটমন্দির। সাদা মার্বেলের মেঝে। তার উপরে ফরাস পাতা। উপরে বিরাট ঝাড় লন্ঠন। সামনে বলদেব জিউয়ের বিগ্রহ। তাঁকে বাঁ দিকে রেখে নিবেদিত কণ্ঠে শুরু হয়েছে কীর্তন--যদি গৌরাঙ্গ না হইত / রাধার মহিমা, প্রেমরসসীমা, জগতে জানাতো কে?
এরপরে সার্বভৌম ভট্টাচার্যের সঙ্গে চৈতন্যদেবের সাক্ষাৎপর্ব ঘিরে প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে গাওয়া হল গৌরলীলা। অগুরু চন্দনের সঙ্গে সুগন্ধী ধূপের ভারী ধোঁয়া পাক খেয়ে গোটা এলাকা মাতিয়ে তুলেছে। গোলাপ, রজনীগন্ধার মৃদু সুবাস, শ্রোতাদের কপালে অগুরু মেশানো জলে গোলা তিলক মাটির টিপ। সার্বভৌম যখন চৈতন্যকে অবতার বলে স্বীকার করে নিচ্ছেন, শ্রোতাদের চোখে জল আর বাধ মানে না।
এই গোটা কাহিনিটাই গাওয়া হয় কীর্তনে। তা শুনতে গ্রামে-গঞ্জে উপস্থিত থাকেন হাজারো শ্রোতা। এক একটি পালার জন্য নামী কীর্তনীয়ারা ১৫ থেকে ২০ হাজার পর্যন্ত টাকা পান। কলকাতাটুকুই শুধু বাদ। তার বাইরে রাজ্যের প্রায় সর্বত্র এবং পাশের অন্য রাজ্য থেকেও আসে আমন্ত্রণ। নামী কীর্তনীয়া শুক্লা হাজরা বলেন, “সেই কার্তিক-অগ্রহায়ণ থেকে জ্যৈষ্ঠ পর্যন্ত টানা চলে কীর্তনের মরসুম। আবার রথযাত্রার সময় থেকে ফের শুরু।”
নবদ্বীপে জমজমাট কীর্তনের আসর।—নিজস্ব চিত্র।
তা হলে কি কীর্তনের চাহিদাও আবার বাড়ছে? জন্মস্থান মন্দিরের কর্ণধার অদ্বৈত দাসের বক্তব্য, “কীর্তনের চাহিদা কোনওদিনই খুব কমেনি। গ্রামীণ বাঙালির জীবনে উমার ঘরে ফেরা এবং নিমাইয়ের লীলা বরাবরই খুব সম্মানের সঙ্গে স্মরণ করা হয়। তাই বহু ভাল শিল্পী কীর্তন লিখেছেন ও গেয়েছেন এবং তাই কীর্তনের গুণমান ও জনমানসে তার কদরও অম্লান। তা ছাড়া, কীর্তনের মধ্যে নাটকীয়তাও যথেষ্ট থাকে, তাই গ্রামে তার চাহিদা কমেনি তো বটেই বরং গত বছর দশেক ধরে দেখছি তা বাড়ছে।” শুভেন্দুবাবুর কথায়, “কীর্তনের আসর আয়োজন করাও সহজ। কয়েকশো বছরের চর্চায় গ্রামের মানুষের অভ্যাসে কীর্তন ঢুকে পড়েছে। রবীন্দ্রসঙ্গীত থেকে হালের বাংলা ব্যান্ডের গানের বদলে তাঁরা কীর্তনেই অনেক স্বচ্ছন্দ।” আর এক নামী কীর্তনীয়া সুমন ভট্টাচার্যের কথায়, “কীর্তনের প্রতি এই আকর্ষণ সত্যিই অবাক করে দিচ্ছে। গ্রামেও এখন স্যাটেলাইট টিভি এসে গিয়েছে--কিন্তু গ্রাম বাংলার মানুষ এখনও বছরের কোনও একটি বা দু’টি দিন কীর্তনের জন্য অপেক্ষা করেন।” তাঁর অভিজ্ঞতা হল, “অনেক গ্রামেই গিয়ে দেখেছি, এই আসর যেন গ্রামের নিজস্ব উৎসবের আকার পায়। এমন অনেক গ্রাম রয়েছে যেখানে দুর্গাপুজো হয় না, কিন্তু কীর্তনের আসর বছরে অন্তত একবার বসে।”
কিন্তু ভাটিয়ালি থেকে শুরু করে ভাওয়াইয়া পর্যন্ত দেশজ অন্য সঙ্গীত ঘরানা যখন ধুঁকছে, তখন কীর্তনের আকর্ষণ বাড়ছে কী করে? এর উত্তরে প্রবীণ কীর্তন শিল্পী সরস্বতী দাসের সোজা কথা, “কীর্তন যে প্রধানত কাহিনি নির্ভর। চৈতন্যের জীবনের নানা লীলা খুবই নাটকীয়ও বটে। শ্রোতারা সে কথা শুনতে শুনতে আকুল হয়ে কেঁদে চলেছেন, এ আমি বহুবার দেখেছি।”
শুভেন্দুবাবু মনে করিয়ে দেন, “কীর্তনে রয়েছে পুণ্য অর্জনের ঝোঁকও। এমন গ্রাম কমই রয়েছে, যেখানে হরিসভা নেই। সেখানেই সাধারণত কীর্তনের এই আসরগুলি বসে।”
কী কাহিনি থাকে সেই সব পদে? কীর্তনীয়ারা জানাচ্ছেন, প্রধানত গৌরলীলা অর্থাৎ চৈতন্যের সন্ন্যাস নেওয়ার আগের জীবনের কথা এবং চৈতন্যলীলা বা সন্ন্যাস নেওয়ার পরের জীবনের কথা খুবই জনপ্রিয়। কৃষ্ণের জীবনকথাও সমান আকর্ষণীয়। দোহা-তুক-ছুট-ঝুমুর-আখর এই পাঁচটি পর্বে সেই কাহিনিগুলিই গেয়ে শোনান কীর্তনীয়া। চণ্ডীদাস, জয়দেব, গোবিন্দদাস, বাসুদেব ঘোষের পদই এখনও মানুষ বেশি শুনতে চান। সেই সঙ্গে রয়েছে বিভিন্ন লীলাগীত। প্রবীণ কীর্তনীয়া দীনেন্দ্র নন্দীর কথায়, “সমস্যা হল, বিশুদ্ধ সঙ্গীত হিসেবে কীর্তনের যে কদর তা এখন কমে গিয়েছে। আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহারও শুরু হয়ে গিয়েছে গল্পের নানা আবহ তৈরি করার জন্য। এটা কীর্তন নয়।” তাঁর আক্ষেপ, এখন কীর্তনের আসরে থাকছে সিন্থেসাইজার বা অক্টোপ্যাডও। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কীর্তন শিখেছেন সুমনবাবু। তাঁর বক্তব্য, “বেণু, বীণা বা রবাব ব্যবহৃত হত আগে। এখন আবার তা ব্যবহার করা শুরু হয়েছে। সঙ্গে অন্য দেশজ যন্ত্রও ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে কীর্তনের মূল কথা হচ্ছে তার কথা।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.