|
|
|
|
দু’দশক পার, দিল্লি আজও দাউদ-সাম্রাজ্যের দর্শকমাত্র
প্রেমাংশু চৌধুরী • নয়াদিল্লি |
তখনও ‘মুন্নাভাই’ সঞ্জয় দত্তকে নতুন করে জেলে পাঠানোর আদেশ দেয়নি সুপ্রিম কোর্ট। তাইল্যান্ডে ধরা পড়ল মুম্বইয়ের মুন্না ঝিঙ্গাড়া। ডি-কোম্পানির অন্যতম পাণ্ডা। দাউদ-ঘনিষ্ঠ ছোটা শাকিলের ডান হাত। তাকে ভারতে নিয়ে আসার বন্দোবস্ত করতে সিবিআই ও গোয়েন্দা অফিসাররা ব্যাঙ্কক রওনা হলেন। মুন্নার ঠিকুজি-কুষ্ঠি আগেই ইন্টারপোলকে দেওয়া ছিল। এ বার তাইল্যান্ড পুলিশের হাতে সরাসরি সে সব তুলে দিয়ে প্রত্যর্পণের প্রক্রিয়া শুরু করাটাই উদ্দেশ্য। কিন্তু ব্যাঙ্ককে পৌঁছে তাঁরা অবাক। ইসলামাবাদ আগেই দাবি জানিয়ে রেখেছে, মুন্নাকে পাকিস্তানের হাতে তুলে দিতে হবে। সে নাকি পাকিস্তানের নাগরিক! প্রমাণ হিসেবে একটি পাসপোর্টও জমা দিয়েছে তারা।
সত্যিই কি তাই? কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার এক অফিসার ঝাঁঝিয়ে উঠে বললেন, “ডাহা মিথ্যে! ওটা ভুয়ো পাসপোর্ট। পাক পাসপোর্টে নাম রয়েছে মহম্মদ সালিম। কিন্তু মুন্নার আসল নাম তো মুদাস্সর হুসেন সইদ। জন্মকর্ম সবই মুম্বইয়ে। ওর বার্থ সার্টিফিকেট থেকে শুরু করে স্কুলের কাগজপত্র, আত্মীয়স্বজনদের নামধামও আমাদের কাছে রয়েছে। ১৯৯৭ সালে পুলিশের হাতে ধরাও পড়েছিল। দু’বছর পরে জামিন পেয়ে করাচি পালিয়ে যায়।”
একে নিয়ে পাকিস্তান মাথা ঘামাচ্ছে কেন? “বুঝলেন না? কারণটা দাউদ ইব্রাহিম। মুন্না করাচিতে দাউদের সঙ্গেই কাজ করত। ২০০১-এ ও ছোটা রাজনের উপর গুলি চালায়। মুন্নাকে হাতে পেলে আমরা প্রমাণ করে দেব, দাউদ পাকিস্তানে রয়েছে। করাচিতে বসেই নিজের সাম্রাজ্য চালাচ্ছে। সেই কারণেই পাকিস্তান, বিশেষ করে আইএসআই এমন খেপে উঠেছে।”
|
|
দুই দশক পর সুপ্রিম কোর্ট রায় শুনিয়েছে মুম্বই বিস্ফোরণের। অস্ত্র রাখার দায়ে সঞ্জয় দত্ত ফের জেলের মুখে। কিন্তু সন্ত্রাসের দায়ে শাস্তি ঘোষণা হয়েছে যাদের, তাদের মধ্যে অধরার সংখ্যাটাই বলে দেয় পাক মদতপুষ্ট সন্ত্রাসের পরিকাঠামোয় কতটুকু দাঁত বসাতে পেরেছে দিল্লি। সেই সঙ্গে মুন্না ঝিঙ্গাড়াকে নিয়ে বছরখানেক ধরে নয়াদিল্লি-ইসলামাবাদ টানাপোড়েন ফের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, এখনও পুরোপুরি অটুট দাউদ-সাম্রাজ্যের প্রভাব-প্রতিপত্তি। ভারতে সন্ত্রাসবাদের মানচিত্রে হয়তো ডি-কোম্পানি আর তেমন গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র নয়। লস্করকে দিয়ে আইএসআই নিজেদের নতুন বি-টিম তৈরি করে ফেলেছে ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন। ইব্রাহিম কাস্কর ভাইদের বদলে এখন আইএসআই-এর হাতের পুতুল ভটকল ভাইয়েরা। দাউদের মতোই মুজাহিদিনের প্রতিষ্ঠাতা রিয়াজ ও ইকবাল ভটকলও করাচিতে আইএসআই-এর নিরাপদ আশ্রয়ে রয়েছে। কিন্তু গোয়েন্দা অফিসাররা এক কথায় মানছেন, ভারতে ড্রাগ-হেরোইন-মাদকের চোরাকারবারের বিরাট সাম্রাজ্য এখনও ডি-কোম্পানির হাতে। এশিয়ার গণ্ডি পেরিয়ে যার বিস্তৃতি ইউরোপ ও পশ্চিম আফ্রিকা পর্যন্ত। দাউদের বন্ধু থেকে শত্রু হয়ে ওঠা ছোটা রাজন এই সাম্রাজ্যে কিছুটা ভাগ বসিয়েছেন। নারকোটিক্স কন্ট্রোল ব্যুরোর কর্তারা সবই আঁচ করতে পারেন। কিন্তু এখনও এই মাদক পাচারের বিশাল জালের একটি সুতো ধরেও টান মারতে পারেননি। তার সঙ্গে রয়েছে মুম্বইয়ের রিয়েল এস্টেট, গুজরাতের জাহাজ ভাঙা এবং বিদেশে বিমান ব্যবসা। টাকা খাটছে শেয়ার বাজারেও। যা নিয়ে রোমে ইন্টারপোলের সম্মেলনে দুশ্চিন্তা প্রকাশ করে এসেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীলকুমার শিন্দে।
কয়েক লক্ষ কোটি টাকার এই ব্যবসা ফুলেফেঁপে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই বেড়েছে পাকিস্তানে দাউদের প্রভাব। শোনা যায়, পাক-ক্রিকেট বোর্ডে জাভেদ মিঁয়াদাদের প্রত্যাবর্তনের পিছনেও রয়েছে দাউদের হাত। নয়াদিল্লি দাউদের বেয়াইয়ের ভারতে আসা ঠেকাতে পারে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। তিন বছর আগে করাচিতে ধুমধাম করে দাউদের ভাই আনিস ইব্রাহিমের মেয়ের সঙ্গে ডি-কোম্পানিরই আর এক পাণ্ডা সালিম চিপলুনের ছেলের নিকাহ হয়েছে। আবু ধাবি থেকে এসেছিল দাউদ-পুত্র মইন। দক্ষিণ এশিয়ার নানা শহরে ছড়িয়ে থাকা ডি-কোম্পানির পাণ্ডাদের উড়িয়ে আনা হয়েছিল করাচিতে। আইএসআই, পাক-সেনা, প্রশাসনের হর্তাকর্তারা কব্জি ডুবিয়ে বিয়ের ভোজ খেয়েছেন। নয়াদিল্লি সবই জেনেছে। কিছুই করতে পারেনি। সাম্প্রতিক গোয়েন্দা রিপোর্টও বলছে, করাচির ফৌজি এলাকা, ক্লিফটন এনক্লেভে দাউদ ইব্রাহিম কাস্করের প্রাসাদোপম বাংলোর বাইরে এখনও আইএসআই ও পাকিস্তানি রেঞ্জার্স পাহারা দেয়। মাঝেমধ্যে বেরোয় তাঁর কনভয়। বুলেটপ্রুফ কাচওয়ালা অন্তত গোটা দশেক এসইউভি। প্রতাপ সেই একই থাকলেও ৫৭ বছরের শরীরটায় বাসা বেঁধেছে নানা রকম রোগ। ইদানীং তাই দুবাই যাওয়াও কমিয়ে দিয়েছেন। তাতে কী? দাউদের মাদক-ব্যবসার শিরা-ধমনীতে এখনও রক্তচাপ কমার কোনও লক্ষণ নেই। তোলাবাজি, সিনেমার প্রযোজনা, সুপারি নিয়ে খুন, হাওয়ালা-র কারবার কমে গিয়ে মাদক পাচারটাই হয়ে উঠেছে আসল ‘ধান্দা’। নারকোটিক্স কন্ট্রোল ব্যুরোর এক শীর্ষকর্তার মন্তব্য, “আমরা হেরোইন, ড্রাগ, নানা ধরনের মাদক আটক করি। কিন্তু যারা এ সবের ক্যুরিয়রের কাজ করে, তাদেরই কেবল ধরা যায়। কোন পথে কী ভাবে এ সব আসছে, কী ভাবেই বা তা এ দেশের বা বিদেশের বাজারে পৌঁছে যাচ্ছে, সেই নেটওয়ার্কের কোনও হদিস নেই।” তাঁর বক্তব্য, পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে আফিমের চাষ হয়। তার পর তা সড়কপথে চলে আসে করাচিতে। সেখানেই আফিম থেকে হেরোইন তৈরি হয়। নব্বইয়ের দশকে করাচি থেকেই রাজস্থান, গুজরাত হয়ে মুম্বইয়ে হেরোইন পৌঁছত। তার পর এজেন্টদের মাধ্যমে গোটা ভারতে ছড়িয়ে দেওয়া হত। জাহাজ বা বিমানে হেরোইন পাঠানো হত ব্রিটেন-ফ্রান্স-জার্মানিতে। গুজরাত থেকে ড্রাগ যেত ঘানা, নাইজেরিয়ার মতো পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলিতে।
আর এখন? নারকোটিক্স কন্ট্রোল ব্যুরোর ওই কর্তার জবাব, “এখন বোধহয় আরও ঘুরপথ ধরছে ওরা। নেপাল, বাংলাদেশ, মায়ানমার থেকেও পাচারের কাজ হচ্ছে। কলকাতা, শিলিগুড়ি করিডর, উত্তর-পূর্বাঞ্চল, বিশেষ করে নাগাল্যান্ড-মণিপুর বড় চিন্তার কারণ। দু’বছর আগেও কলকাতার বিভিন্ন ক্যুরিয়র সংস্থার প্যাকেটে হোয়াইট সুগার মিলেছে। কোনওটা যাচ্ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা, কোনওটা অস্ট্রেলিয়া। ইদানীং সে সব কমেছে। কিন্তু ড্রাগ কম ধরা পড়ছে বলেই কারবারও কমেছে, এমন দাবি করতে পারি না।”
ড্রাগের পাশাপাশি আর একটি মাথাব্যথার কারণ হল গুজরাতের জাহাজ ভাঙার ব্যবসা। ভাবনগরের আলং শহরে পৃথিবীর বৃহত্তম ‘শিপ-ব্রেকিং ইয়ার্ড’। কোটি কোটি টাকার ব্যবসা। সেখানেও পৌঁছেছে দাউদের কালো হাত। গোয়েন্দা রিপোর্ট বলছে, দাউদের ভাই আনিস মূলত এই সব ব্যবসা দেখাশোনা করে। এই আনিসের থেকেই সঞ্জয় দত্তের হাতে একে-৫৬ পৌঁছেছিল। সে-ই দাউদের উত্তরসূরি। ড্রাগের কারবার চালায় ছোটা শাকিল ও টাইগার মেমন। গত বছর মে মাসে মার্কিন প্রশাসন আনুষ্ঠানিক ভাবে এই দু’জনকে বিশ্ব জুড়ে ড্রাগ পাচারের ‘কিংপিন’-এর তকমা দিয়েছে। ব্রিটিশ গুপ্তচর সংস্থা এমআই-ফাইভের রিপোর্টও বলছে, দুবাই নয়। করাচি থেকেই ড্রাগ পাচারের কারবার নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে। মেমন ও ছোটা শাকিলও করাচিতে দাউদের প্রতিবেশী। আর এ দেশে ডি-কোম্পানির মুখ দাউদের ভাই ইকবাল কাস্কর। দক্ষিণ মুম্বইয়ের ভিন্ডি বাজারের পাকমোড়িয়া স্ট্রিটে যে বাড়িতে দাউদ-ভাইদের বড় হওয়া, সেই পাড়াতেই থাকে ইকবাল। তার হয়ে অপরাধ জগতের কাজকর্ম চালায় ইকবালের শালা জানজেব খান ওরফে গুড্ডু পাঠান। দাউদের দিদি, হাসিনা পার্কার রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা চালান বলে অভিযোগ। এলাকার লোকে যাকে ‘বড়ি আপা’ বলেই চেনে।
পাকমোড়িয়া স্ট্রিট থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরের ক্রফোর্ড মার্কেটে মুম্বই পুলিশের সদর দফতর। কিন্তু পুলিশ কোনও দিনই ইকবাল বা হাসিনার নাগাল পায়নি। প্রমাণের অভাব তো বটেই। তার থেকেও বড় কথা, পাকমোড়িয়া স্ট্রিটে আজও বহিরাগতদের প্রবেশ নিষেধ। অতি উৎসাহে কেউ দাউদের বাড়ি দেখতে গেলে বা ছবি তুললে কপালে নির্ঘাত মারধর। আর পুলিশ বা অন্য গ্যাংয়ের লোক হলে?
খাল্লাস! |
|
|
|
|
|