বাবা জ্ঞান দিয়ো না
বন্ধু তোমায়...
গের বার লিখেছিলাম সেই ছোটবেলার বন্ধুদের নিয়ে যারা এখনও সত্যিই বন্ধু থেকে গিয়েছে। আজ লিখছি বড়বেলার বন্ধুদের নিয়ে।
এদের কথা বলতে গেলে প্রথমেই যার নাম করতে হয় তার নাম শ্রীযুক্ত রুদ্রনীল ঘোষ। অতীতে অনেক ছবির মতো সাম্প্রতিক ‘হাওয়া বদল’-এও আমার সহ-অভিনেতা।
অনেকেই ইদানীং আমাকে জিজ্ঞেস করেন, এমনকী এই আনন্দplus-এও এই প্রশ্নটা উঠে এসেছে যে আমার আর রুদ্রর মধ্যে কোনও মনোমালিন্য হয়েছে কি না। আমাদের বন্ধুত্ব এখনও আগের মতোই আছে কি না? আমি সাধারণত এড়িয়ে যাই প্রশ্নটা। কিন্তু আজ এখানে বলছি, হ্যাঁ, একটা ‘হাওয়া বদল’ হয়তো সত্যি ঘটেছে আমাদের সম্পর্কে! আমরা প্রত্যেক দিন বড় হই। জীবন সম্পর্কে আমাদের ধারণাগুলো বদলায়। আমরা মানুষ হিসেবে একটু একটু করে বদলে যেতে থাকি। এই পরিবর্তনের হাত ধরে আজ আমার হয়তো রুদ্রর কাজ করার পদ্ধতি অনেক ক্ষেত্রে পছন্দ হয় না। ওর জীবনযাপন করার পন্থাও পছন্দ হয় না অনেক ক্ষেত্রে। হয়তো ওরও আমার ক্ষেত্রে তাই। মতপার্থক্য নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু “তা বলে কি বন্ধু থাকবে না?”
আমাদের পরিচয় আজ থেকে প্রায় এগারো বছর আগে। রুদ্র আমার থেকে বয়সে বেশ কিছুটা বড় হলেও, আমরা দু’জনেই তখন এই ইন্ডাস্ট্রিতে নবাগত। সেই সময় থেকে কিছু ভাবনা, কিছু স্বপ্ন, কিছু মুহূর্ত আমাদের বন্ধুত্বটাকে তৈরি করেছে আর টিকিয়ে রেখেছে। কখনও একই মেয়ের প্রেমে পড়া। কখনও একই গল্প নিজের বলে আলাদা ভাবে পিচ করা। তাই নিয়ে তুমুল অশান্তি। তা সত্ত্বেও, কোথাও লুকিয়ে থাকা একটা টান আমাদের বন্ধুত্বটাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। আমরা চলন বলনে একে অন্যের থেকে খুবই আলাদা। সে জন্যই হয়তো বন্ধুত্বটা তৈরি হয়েছিল খুব তাড়াতাড়ি। আমরা ভবিষ্যতে একসঙ্গে কাজ করি বা না করি, বন্ধুত্বটা তাও টিকেই যাবে, এটা আমার বিশ্বাস। তার কারণ আমি ওই অসামান্য অভিনেতা রুদ্রনীলকে, আর খুব কাছ থেকে দেখা একটা নিখাদ ভালমানুষ রুদ্রকে খুব শ্রদ্ধা করি। আর কোথাও খুব ভালবাসি। আমার বিশ্বাস রুদ্রও তাই করে।
‘হাওয়া বদল’ ছবির দৃশ্যে রুদ্রনীল ও পরমব্রত
আমি কখনওই টানা খুব বেশি দিন কলকাতার বাইরে থাকিনি। তাই মাত্র দেড় বছরের বিলেত-বাস যেমন উপভোগ করেছিলাম, তেমনই আবার ‘কলকাতা কলকাতা’ মন-কেমনও করেছিল। ভেবে দেখেছি, এই মন কেমনটা যেমন আমার মায়ের জন্য, যেমন এই নোংরা কিন্তু ভীষণ সুন্দর শহরটার গলিঘুঁপচির জন্য, তেমনই আমার ফেলে যাওয়া বন্ধুগুলোর জন্যও বটে। সত্যি কথা বলতে কী ছোটবেলার থেকে আমার বড়বেলার বন্ধুর সংখ্যা বেশি। রোজকার কাজের জগতে যাদের সঙ্গে আলাপ বা ওঠা বসা হয়, তাঁদের মধ্যে খুব কম মানুষই ‘বন্ধু’ হয়ে ওঠেন।
আমার মনে হয় সত্যিকারের বন্ধু হয়ে তারাই শেষমেশ থেকে যায়, যাদের সঙ্গে সত্যিকারের ঝগড়া হয়! সিরিয়াস ঝগড়া। মুখ দেখাদেখি বন্ধ টাইপের। পরিচালক বিরসা দাশগুপ্তের সঙ্গে আমার বোধ হয় গত তিন বছরে বার চারেক কথা বন্ধ থেকেছে। আবার শুরুও হয়েছে! ওর স্ত্রী বিদীপ্তাও আমার খুব বন্ধু। আর ওদের দুই ছানা সোমরি আর ইদার সঙ্গে কিছু ক্ষণ কাটালে বেশ অনেকটা টাটকা দমকা বাতাস ফুসফুসে ভরে নেওয়া যায়। অদিতি মজুমদার, পেশায় চিত্রনাট্যকার। আমার প্রথম ছবি ‘জিও কাকা’ লিখেছিলেন। তাঁর সঙ্গে পরে কখনও কাজ করিনি। কিন্তু গত দশ বছর তিনি, তাঁর স্বামী অভিজিৎ, তাঁর দাদা, আমার অধ্যাপক অভীকদা, আর তাঁদের আড়াই বছরের পুত্রসন্তান রঙ্গ, আমার বেজায় বন্ধু। সপ্তাহে এক দিন ওঁদের বাড়ি না গেলে আমার মনে হয় কী একটা যেন করা হয়নি এই সপ্তাহে।
সৃজিত আমার ছোটবেলার স্কুলের চার বছরের সিনিয়র। ২০০৮ সালে হঠাৎ পুনরাবির্ভাব। আমাদের বন্ধুত্ব শুরু। ও যখন ‘অটোগ্রাফ’ বানানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছে, সেই সময়টাতে আমি বিদেশে। আমি ফেরার ঠিক পরে ‘অটোগ্রাফ’ রিলিজ করে, আর ও ‘সৃজিত মুখার্জি’ হয়ে ওঠে। তার পর অনেকটা পথ আমরা হেঁটেছি একসঙ্গে ‘বাইশে শ্রাবণ’ আর ‘হেমলক সোসাইটি’র মধ্যে দিয়ে। ঠিক রুদ্রর মতোই ওকে নিয়েও অনেকে আমাকে প্রশ্ন করেন, আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব আগের মতোই আছে কি না। সন্দেহের কারণটা বলা বাহুল্য, উল্লেখ করছি না আর। বোঝাতে পারি না যে আমরা তো দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ। যদি কোনও খারাপ-ভাল লাগা জন্মে থাকে, সেটা নিজেদের সঙ্গে কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে বুঝে নেব! বড়বেলার বন্ধুত্বের একটা দিক হলযে আমাদের পেশাগত এবং ব্যক্তিগত জীবনগুলো মাঝে মাঝে একে অন্যের রাস্তায় এসে দাঁড়ায়। বন্ধুত্বটাও একটা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি এসে পড়ে। সেগুলো পেরোতে পারলে তবেই বন্ধুত্ব ব্যক্তিগত সঙ্কীর্ণতার উর্ধ্বে উঠতে পারে।
বিলেত থেকে ফেরার পরে পূর্বপরিচিত কিছু মানুষের সঙ্গে সখ্য বেড়েছে। বন্ধুত্ব গভীর হয়েছে। হয়তো কাজের সূত্রেই। কিন্তু সেটাও অনেক পাওনা। শ্রীকান্ত মোহতা, মহেন্দ্র সোনি, শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, শিবাজি পাঁজা, অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী এঁরা আমার থেকে অভিজ্ঞতায় এবং প্রতিভায় অনেক বড়। কিন্তু কাজ এবং আমাদের নিজস্ব ব্ল্যাকবেরি কমিউনিটি বিএফটিআই সূত্রে এঁরা সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত তাঁদের সান্নিধ্যে ভরিয়ে রাখেন। চরম ব্যস্ততার মধ্যেও এঁদের কিশোর-সুলভ আচরণ, একে অন্যের পিছনে লাগা আর আবেগের প্রকাশ, কোথাও যেন একটা বন্ধন তৈরি করে দেয়। কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে বহু দিনের আলাপ। কিন্তু এখন এসে একটা বন্ধুত্বের চেহারা নিচ্ছে বলে মনে হয়। সে রকমই, ‘হাওয়া বদল’-এর গান তৈরি করতে গিয়ে আলাপ পরিচিতি বদলে গিয়ে জমাট বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে সঙ্গীত পরিচালক ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তর সঙ্গে। আছেন ‘হাওয়া বদল’-এর গীতিকার, এমনিতে চিত্রনাট্যকার অংশুমান চক্রবর্তী। ‘হাওয়া বদল’-এর চিত্রনাট্যকার অনিন্দ্য বসু, প্রযোজক কর্ণ রায় এবং কৃষ্ণেন্দুদা, পদ্মনাভ দাশগুপ্ত, রানাদা, সুদেষ্ণাদি, সম্পাদক বুধাদিত্য, এ রকম আরও বেশ কিছু মানুষ।
বন্ধুবান্ধব যখন সবাই একই পেশায়, পরস্পরের কলিগ কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে কাজ করতে আরম্ভ করি, তখন বন্ধুত্বের মানেতে একটা বদল হয় বইকী! সময়ের দৌড়ে কেউ আমরা হয়তো একসঙ্গে থেকে যাই, কেউ আলাদা হয়ে যাই। কিন্তু আদানপ্রদান যেটা হয় সেটা আমাদের আর একটু বড় করে তোলে। আরও সমৃদ্ধ করে। এইটুকু তো আমাদের কাজের জগৎ, এই ক’জন তো বন্ধুবান্ধব। এদের মধ্যে হাওয়াটা বদলে গেলে এক দিন সবাই একসঙ্গে বসে আড্ডা দিয়ে, গানবাজনা করে সব খারাপ লাগা ভুলিয়ে দিতে পারব না? না পারলে আর আধুনিকতার মান রাখতে পারলাম কই?
আমার এক বান্ধবী একটা খুব দামি কথা এক বার বলেছিলেন। আত্মীয়স্বজন, পরিবার নিয়েই মানুষ জন্মায়। কিন্তু বন্ধু মানুষ বেছে নেয়, নিজে বানায়। আজ ‘ছেলে’ থেকে ‘লোক’ হয়ে ওঠার পথ চলতে চলতে বুঝতে পারি কথাটা খুব ঠিক। কারণ আমাদের এই আপসে ভরা দুনিয়ায় তারাই বন্ধু যাদের সঙ্গে সব কিছু ভুলে আপসের দুঃখ আর আপস পেরিয়ে জেতার আনন্দ দু’টোই ভাগ করে নেওয়া যায়।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.