তাঁর রাজনীতির কর্মক্ষেত্র এত দিন ছিল মুর্শিদাবাদ থেকে দিল্লি। এ বার খোদ তৃণমূল নেত্রী তথা প্রাক্তন রেলমন্ত্রীর ডেরায় ঢুকে তাঁকে চ্যালেঞ্জ জানাতে কোমর বাঁধছেন রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরী। মুর্শিদাবাদের পর এ বার শিয়ালদহ স্টেশনে বসতে চলছে অধীরের দরবার।
কলকাতা নিয়ে এত দিন খুব একটা আগ্রহী মনে হয়নি মুর্শিদাবাদের কংগ্রেস সাংসদকে। হয় তাঁর নিজের জেলা, বড়জোর উত্তরবঙ্গের লাগোয়া জেলাগুলিতেই তাঁর যাবতীয় প্রভাব-প্রতিপত্তি। কিন্তু পঞ্চায়েত নির্বাচনের ঠিক আগে তৃণমূল নেত্রীর কট্টর বিরোধী বলে পরিচিত অধীর তাঁর সঙ্গে টক্কর দিতে বেছে নিলেন রাজ্যের রাজধানীকেই। হাতিয়ার রেল মন্ত্রক (মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে পর্যন্ত যে মন্ত্রকের সিংহভাগ কাজ তিনি করে দিয়ে এসেছেন বলে মমতা দাবি করেন)।
রেল মন্ত্রক জানিয়েছে, আগামী সপ্তাহে শিয়ালদহ স্টেশনে রেল প্রতিমন্ত্রীর একটি দফতর চালু হওয়ার কথা রয়েছে। সেখানে যাত্রী সমস্যা শোনা ছাড়াও রাজ্যের রেল প্রকল্পগুলির অগ্রগতিও নিয়মিত তদারক করা হবে। প্রথমে আগামী সোমবার ওই দফতরটির উদ্বোধন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু গত কাল রাজ্য সরকার পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিন ঘোষণা করে দেওয়ায় আপাতত উদ্বোধন অনুষ্ঠানটি বাতিল করা হয়েছে। তবে অধীর আগামী সপ্তাহের শুরু থেকেই ওই দফতরে বসতে চলেছেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে দফতর সামলাবেন রেলের অফিসারেরা।
যদিও কেউ কেউ মনে করছেন, দফতর খুলে রেলের কাজ তদারক করাটা অধীরের উপলক্ষ মাত্র। শুধু পঞ্চায়েত নয়, লোকসভা ভোটের কথা মাথায় রেখেও কলকাতাকে নতুন ঘাঁটি বানাতে চাইছেন অধীর। তার আগে লড়াইটা পৌঁছে দিতে চাইছেন মমতার চৌহদ্দিতে। তৃণমূল ইতিমধ্যেই অধীরকে একপ্রস্ত আক্রমণ করেছে। তাদের বক্তব্য, রেল বাজেটে বাংলাকে বঞ্চনা করার পর কংগ্রেস এখন এই সমস্ত পন্থা নিয়ে অবস্থা সামাল দিতে চাইছে। তৃণমূলের রাজ্যসভা সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েন বলেন, “রেল বাজেটে বাংলাকে উপেক্ষার প্রতিবাদে লোকসভা ও রাজ্যসভার বাজেট বিতর্ক থেকে দল ওয়াকআউট করেছে। আমরা রাজ্যের স্বার্থে সংসদে সরব রয়েছি।” অধীরের দফতর খোলা নিয়ে ডেরেকের মন্তব্য, “প্রধানমন্ত্রী বা কোনও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী দফতর খুললে আমার কিছু মন্তব্য করার থাকত।”
শিয়ালদহ-অস্ত্রে তৃণমূলের এই বঞ্চনার অভিযোগের জবাবও অধীর দিতে চাইছেন বলে অনেকের মত। যদিও রেল প্রতিমন্ত্রী বলছেন, “আমজনতার অভাব-অভিযোগ শোনার জন্য এই ব্যবস্থা চালু করা হচ্ছে। এর মধ্যে কোনও রাজনীতি খুঁজতে যাওয়া অর্থহীন।” তবে তাঁর উদ্যোগ যে কার্যত নজিরবিহীন, তা মেনে নিচ্ছেন অনেকেই। গত চার বছরে মমতা, দীনেশ ত্রিবেদী, মুকুল রায় বাংলা থেকে রেলমন্ত্রী হয়েছেন তিন জন। কিন্তু রাজ্যের মানুষের অভাব-অভিযোগ শোনার জন্য সেই অর্থে কোনও মন্ত্রীই কলকাতায় আলাদা দফতর খোলার কথা ভাবেননি। প্রাক্তন রেলমন্ত্রী বরকত গনি খান চৌধুরী বা বিহারের লালু প্রসাদ রেলমন্ত্রী থাকাকালীন নিজেদের বাড়িতে দরবার বসাতেন। নীতীশ কুমার রেলমন্ত্রী হিসেবে না হলেও মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর নিজের বাড়িতে নিয়মিত ভাবে প্রতি সোমবার জনতার দরবার চালু রেখেছেন। কিন্তু মন্ত্রীর এ ভাবে কোনও স্টেশনে বসে যাত্রীদের অভাব-অভিযোগ শোনার ব্যাপার এর আগে হয়েছে বলে মনে করতে পারছেন না রেল কর্তারাও। মন্ত্রক জানিয়েছে, আপাতত স্টেশনের মূল ভবনের দ্বিতলে, সংরক্ষিত টিকিট কাউন্টারের পাশে একটি জায়গা মন্ত্রীর বসার জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে।
কী ধরনের অভাব অভিযোগ শোনা হবে ওই দরবারে?
মন্ত্রক জানিয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যাত্রীরা সরাসরি মন্ত্রী বা রেলের শীর্ষ কর্তাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে সমস্যা জানাতে পারেন না। পরিষেবা থেকে অতিরিক্ত স্টপেজ কিংবা নতুন ট্রেনের জন্য যাত্রীদের ন্যায্য দাবি রয়েছে, যা মন্ত্রক জানতেও পারে না। তাই প্রাথমিক ভাবে ঠিক হয়েছে, সপ্তাহের কোনও এক বা দু’দিন নিয়মিত ভাবে নিজের দফতরে বসবেন রেল প্রতিমন্ত্রী। সাধারণত প্রতি সপ্তাহে রেল মন্ত্রকে যাত্রীদের কয়েকশো অভিযোগ জমা পড়ে। সেগুলির মধ্যে থেকে গুরুত্ব অনুযায়ী বেছে নিয়ে নির্দিষ্ট কিছু যাত্রীকে শিয়ালদহের দফতরে ডাকা হবে। প্রয়োজনে অধীর নিজে নিত্যযাত্রীদের সঙ্গেও কথা বলবেন। তবে শিয়ালদহ স্টেশনে অধীর বসতে শুরু করলে সেখানে তৃণমূল সমর্থকদের বিক্ষোভ দেখানোর আশঙ্কাও একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছে না রেল মন্ত্রক। ফলে ভাবতে হচ্ছে এ দিকটি নিয়েও।
আসলে অধীর এখন আগামী বছরের লোকসভা ভোট পর্যন্ত কলকাতার দফতর থেকে নিয়মিত ভাবে তৃণমূল নেতৃত্বকে আক্রমণ শানাবেন বলে মনে করছেন অনেকেই। ফলে তাঁর এই ‘দরবারি রাগ’ তৃণমূল কী ভাবে সামলায়, সেটাই এখন দেখার। |