পশ্চিমবঙ্গের প্রতি বঞ্চনার অভিযোগ নিয়ে ফের তরজায় জড়াল কেন্দ্র-রাজ্য। কেন্দ্র পশ্চিমবঙ্গকে বঞ্চিত করছে বলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে অভিযোগ করছেন, আজ তা সরাসরি খারিজ করে দিয়ে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম বলেন, পশ্চিমবঙ্গ নিয়ম মেনেই কেন্দ্রের কাছ থেকে টাকা পাচ্ছে। যার জবাবে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীকে সরাসরি ‘মিথ্যেবাদী’ বলে তৃণমূল নেতৃত্বের অভিযোগ, তৃণমূল ইউপিএ ছাড়ার প্রতিশোধ নিচ্ছে কেন্দ্র।
সব মিলিয়ে স্পষ্ট, কেন্দ্রীয় বঞ্চনার অভিযোগ নিয়ে ফের সুর চড়াতে তৈরি তৃণমূল। অথচ গত ক’দিন ধরে দু’পক্ষের কথাতেই কোথাও একটা কাছাকাছি আসার ইঙ্গিত ছিল। এ দিন মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগ খারিজ করার পাশাপাশি চিদম্বরম জানিয়ে দেন, রাজ্যের ঋণের ভার কমাতে চতুর্দশ অর্থ কমিশনের সুপারিশ না আসা পর্যন্ত কিছু করা সম্ভব নয়।
যার অর্থ, আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগে পশ্চিমবঙ্গের ঋণ সমস্যার পাকাপাকি সমাধানসূত্র মেলা কঠিন। কারণ সবে মাত্র জানুয়ারি মাসে চতুর্দশ অর্থ কমিশন গঠন হয়েছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর ওয়াই ভি রেড্ডির নেতৃত্বাধীন কমিশনকে ২০১৪ সালের অক্টোবরের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। ২০১৫ সালের ১ এপ্রিল থেকে ওই সুপারিশ কার্যকর হবে। তার আগে পর্যন্ত রাজ্যকে যে নিজের আয়ের কড়ি দিয়েই ঋণের বোঝা সামলাতে হবে, আজ তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন চিদম্বরম।
আগামী অর্থ বছরের জন্য পশ্চিমবঙ্গের যোজনা বরাদ্দ চূড়ান্ত করতে ৯ এপ্রিল দিল্লিতে মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়ার সঙ্গে বৈঠক করবেন মুখ্যমন্ত্রী। মহাকরণ সূত্রের বক্তব্য, ওই বৈঠকে রাজ্য সরকারের আয় বৃদ্ধির যুক্তি দিয়ে যোজনা বরাদ্দ বাড়ানোর জন্যও সওয়াল করবেন তিনি। ওই বৈঠকে পশ্চিমবঙ্গের ঋণের বোঝা নিয়েও আলোচনা হবে। তার ঠিক আগে এ দিন রাজ্যের প্রতি কেন্দ্রীয় বঞ্চনার অভিযোগ উড়িয়ে চিদম্বরম বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী যে বৈষম্যের কথা বলছেন, তা ভুল। আমি এই অভিযোগ অস্বীকার করছি।” তৃণমূলের সাংসদ তথা রাজ্যসভার মুখ্য সচেতক ডেরেক ও’ব্রায়েনের পাল্টা দাবি, “চিদম্বরম রাজনীতির খেলা খেলছেন। হাসতে হাসতে মিথ্যে বলছেন। তৃণমূল ইউপিএ থেকে বেরিয়ে আসার প্রতিশোধ তোলা হচ্ছে।”
রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই কেন্দ্রের কাছে রাজ্যের ঋণের ভার লাঘব করার দাবি জানিয়ে আসছিলেন মমতা। তিন বছরের সুদ মকুব বা মোরাটোরিয়ামের দাবিও তোলা হয়। কিন্তু বহু দর কষাকষিতেও কোনও সমাধানসূত্র মেলেনি। কেন্দ্রে সমর্থন প্রত্যাহারের পর থেকেই বঞ্চনার অভিযোগ তুলে আক্রমণের সুর চড়িয়েছে তৃণমূল। আগে বামফ্রন্ট যে ভাবে পশ্চিমবঙ্গের প্রতি বিমাতৃসুলভ আচরণের কথা বলত, সেই পথই নিয়েছেন মমতা।
কিন্তু চিদম্বরম মমতার অভিযোগ মানতে নারাজ। তাঁর বক্তব্য, কেন্দ্রীয় করের ভাগ থেকে শুরু করে সরকারি প্রকল্পে অনুদান বা কেন্দ্রীয় ঋণ, পশ্চিমবঙ্গের যেখানে যা প্রাপ্য, তা পশ্চিমবঙ্গ নিয়ম মেনেই পাচ্ছে। কোনও রাজ্য সম্পর্কে বিমাতৃসুলভ মনোভাব নেওয়া যেমন কেন্দ্রের পক্ষে সম্ভব নয়, তেমনই কাউকে বাড়তি সুবিধা পাইয়ে দেওয়ারও কঠিন। সংবিধান ও ত্রয়োদশ অর্থ কমিশনের বেঁধে দেওয়া সূত্র মেনেই রাজ্যকে টাকা দেয় কেন্দ্র।
চিদম্বরমের এই যুক্তি খারিজ করে দিয়েছে তৃণমূল। ডেরেকের পাল্টা অভিযোগ, “অর্থমন্ত্রী ভুল তথ্য দিচ্ছেন। ওঁকে অনুরোধ করব, দ্বাদশ অর্থ কমিশনের রিপোর্ট পড়ে দেখতে। সেখানে স্পষ্ট বলা হয়েছে, ঋণের সমস্যার অন্যতম সমাধান হল মোরাটোরিয়াম। দ্বিতীয়ত, অর্থ কমিশনই পশ্চিমবঙ্গ, কেরল ও পঞ্জাবকে ঋণগ্রস্ত রাজ্য বলে ঘোষণা করেছে। যার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে আয়ের তুলনায় ঋণের অনুপাত সবথেকে বেশি। এই রাজ্যগুলির জন্য অর্থ মন্ত্রকের বিশেষ কমিটি তৈরি হয়। কিন্তু একবারই তার বৈঠক হয়েছে। অর্থমন্ত্রী আসল তথ্য এড়িয়ে গিয়ে রাজনীতির খেলা খেলছেন। বাংলার মানুষ ক্ষমা করবেন না।”
তৃণমূলের বিদ্রোহী সাংসদ কবীর সুমন অবশ্য এই প্রশ্নে কেন্দ্রের পাশেই দাঁড়িয়েছেন। শনিবার তিনি বলেন, “ভারত সরকারের অনেক দোষ আছে। কিন্তু তারা কিপ্টে নয়।” পশ্চিমবঙ্গে সব ক্ষেত্রে সঙ্গত খরচ হচ্ছে না বলেও মন্তব্য করেন সুমন।
অর্থ মন্ত্রকের তরফে বলা হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গ যে ঋণগ্রস্ত, তা কেন্দ্র অস্বীকার করছে না। কিন্তু সেই ঋণের উপর সুদ মকুব করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ রাজ্যের ২ লক্ষ কোটিরও বেশি টাকা ঋণের অধিকাংশটাই বাজার থেকে নেওয়া। কেন্দ্রের সেখানে কোনও হাত নেই। উন্নয়নের জন্য অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে মনমোহন-সরকার কখনওই বৈষম্য করেনি। অর্থমন্ত্রী বাজেটে ঘোষণা করেছেন, ২০১৩-’১৪ অর্থ বছরে বিআরজিএফ থেকে রাজ্যগুলির জন্য ১১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হবে। যার মধ্যে বিহার, বুন্দেলখণ্ড, ওড়িশার পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের জন্যও নির্দিষ্ট অর্থ বরাদ্দ হবে। এ ছাড়া মাওবাদী অধ্যুষিত জেলাগুলির উন্নয়নে বাড়তি ১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। রাজ্যের তিনটি জেলাও এর ভাগ পাবে। পশ্চিমবঙ্গের জন্য বরাদ্দ নিয়ে আলোচনা করতে আগামী সোমবার দিল্লি আসছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র এবং অর্থসচিব এইচ কে দ্বিবেদী। যোজনা কমিশনের কর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন তাঁরা।
প্রণব মুখোপাধ্যায় অর্থমন্ত্রী থাকাকালীনই রাজ্যের ১১টি জেলাকে ‘অনগ্রসর’ বলে ঘোষণা করে বেশ কয়েক হাজার কোটি টাকার প্রকল্প মঞ্জুর হয়েছিল। দার্জিলিং ও কোচবিহারকেও অনগ্রসর জেলা হিসেবে ঘোষণা করে একই ভাবে অর্থসাহায্য দেওয়ার দাবি তুলেছেন মমতা। চিদম্বরম চাইছেন, অনগ্রসর এলাকা নির্ধারণ করার জন্য নতুন মাপকাঠি তৈরি হোক। বর্তমানে এলাকার ভৌগোলিক চরিত্র, জনঘনত্ব ও আন্তর্জাতিক সীমান্তের দৈর্ঘ্যের ভিত্তিতে অনগ্রসর এলাকা চিহ্নিত হয়। অর্থমন্ত্রীর মতে, একটি এলাকার মাথা পিছু আয়, সাক্ষরতার হার ও অন্যান্য মানব উন্নয়ন সূচকগুলিকে জাতীয় গড়ের সঙ্গে তুলনা করে অনগ্রসর এলাকা ঠিক করা প্রয়োজন। সোমবারের বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গে কোথায়, কোন প্রকল্পে কত অর্থ মঞ্জুর হবে, তা নিয়েও কথা হবে। এর পর ৯ এপ্রিল যোজনা কমিশনের উপাধ্যক্ষের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠকে যোজনা বরাদ্দ চূড়ান্ত হবে। গত বছর ২৫ হাজার ৯১০ কোটি টাকার যোজনা বরাদ্দ মঞ্জুর করেছিলেন মন্টেক। বৃদ্ধির হার ছিল ১৬.৫ শতাংশ। এ বার যোজনা বরাদ্দের পরিমাণ ১০ শতাংশেরও বেশি বাড়বে বলেই মনে করছেন যোজনা কমিশনের কর্তারা।
কিন্তু তাতে কি সমস্যা মিটবে? রাজ্য প্রতি বছর সুদ ও আসল মিলিয়ে ২৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ শোধ করে। চিদম্বরম বলেন, “আসলে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তার ঋণ সমস্যার মোকাবিলার জন্য বিশেষ সাহায্য চাইছে। রাজ্য নিজেই অতীতে ধার করে এই বোঝা বানিয়েছে। এখন তাদেরই নিজের আয় দিয়ে তা শোধ করতে হবে।” বর্তমানে কেন্দ্রের মোট রাজস্ব আয়ের ৩২ শতাংশ রাজ্যগুলির মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। পশ্চিমবঙ্গের ওই অর্থের ২.৩ শতাংশ পায়। অমিত মিত্রের দাবি, কেন্দ্রের মোট রাজস্ব আয়ের ৫০ শতাংশ রাজ্যগুলিকে দেওয়া হোক। তাতে পশ্চিমবঙ্গও বাড়তি রাজস্ব পাবে। অর্থ মন্ত্রকের বক্তব্য, ত্রয়োদশ অর্থ কমিশনের সুপারিশ মেনেই ৩২ শতাংশ রাজ্যগুলিকে দেওয়া হচ্ছে। তা বাড়াতে হলে চতুর্দশ অর্থ কমিশনের সুপারিশ আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। |