পাখির গান নিয়ে, বিশেষ করে কোকিলের ডাক নিয়ে কাব্য না করলে বোধ হয় কিছু কাল আগেও কবিখ্যাতি পাওয়া যেত না। ধ্রুপদী খেয়ালের বন্দিশেই হোক আর আধুনিক বাংলা গানের লিরিকেই হোক, কোকিল ছিলেন আছেন থাকবেন। সমকালীন গীতিকারদের মধ্যে জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ও লিখেছেন: ‘বুকের মাঝে বোবা হয়ে ছিল কোয়েলা
বুঝিনি আমি যত দিন ছিলাম একেলা,
তুমি ফাগুন এনে না দিলে সেই কোকিলের ডাকা হত না।’
লক্ষ করা দরকার, জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায় ‘ডাকা’ লিখছেন। সাধারণত বাংলা গানে কোকিল বললেই ‘কুহুতান’, ‘গান’ এ সবই বেশি পাওয়া যায়। জ্ঞানকর্ণ ফোটার সঙ্গে সঙ্গে কোকিলের ডাক শুনে আমি কিন্তু এটুকু বুঝতে পেরেছিলাম যে, কোকিলের গলায় আর যা-ই থাক, সুর নেই। বরং একটা তীক্ষ্ন উ-কারান্ত আওয়াজ আছে, যা ধাপে ধাপে বাড়ে, ফলে ক্রমশ আরও বিরক্তিকর লাগে। কখনও তিন, কখনও চার ধাপ। তিনই হোক আর চারই হোক বেসুরো। আমার কথা বিশ্বাস না হয় রেকর্ড করে তার পর যে-কোনও যন্ত্রের সাহায্যে মিলিয়ে দেখুন। আজকাল তো সফ্টওয়্যারও পাওয়া যায়। দেখতে পাবেন, স্বরের গতি এমন, যেন সব মিলিয়ে সুরের একটা টুকরো শুনলাম। আসলে কিন্তু তা নয়। সুর-সুর ভাব আছে, খাঁটি সুর নেই। হুবহু স্বরলিপি করা যাবে না। প্রকৃতিতে যাঁরা সংগীত খুঁজে পান, আমি তাঁদের দলে নেই। আমার মধ্যে ওই ধরনের রোম্যান্টিকতা নেই। ঝরনায় বা নদীর স্রোতে আমি কোনও দিনই তেমন সুর-তাল খুঁজে পাইনি। স্রোতের শব্দ ভাল লাগে, বেশ লাগে হাওয়ার আওয়াজ, সে রকম অবস্থায় আবেশে ঘুমও আসে। কিন্তু তাদের ভাল লাগে সংগীতের ধ্বনি হিসেবেও নয়, উত্স হিসেবেও নয়। গানের কথা মনে আসে বরং ফেরিওয়ালাদের ডাক শুনে। কলকাতার রাস্তায় কত রকমের ফেরিওয়ালার ডাক শুনেছি। অনেকেই সুর করে ডাকেন। এঁর ডাকে ওঁর ডাকে কোনও মিল আছে কি? কী ধরনের সুর ব্যবহার করে থাকেন ফেরিওয়ালারা? সারা কলকাতার কোনও সমীক্ষা আমি নিইনি। বৈষ্ণবঘাটা বাই লেন-এ আমাদের বাড়িতে বসে কয়েক সকাল আমি নোট নিলাম, স্বরলিপি করলাম। আগাগোড়া একটি ইলেকট্রনিক তানপুরা চালিয়ে রেখেছিলাম, যার সাহায্যে ফেরিওয়ালাদের ডাকের পরদাটা (ইংরিজিতে key) আমি চট করে বুঝে নিতে পারছিলাম। টের পাচ্ছিলাম, রাস্তায় রাস্তায় ফেরি করে করে আর চেঁচিয়ে ডেকে ডেকে প্রায় সকলেরই একটা আন্দাজ হয়ে গিয়েছে, যার ভিত্তিতে কারওরই পরদা ‘জি শার্প’-এর ওপরে নয়। ওই পরদার বা ‘এ’-র তার সপ্তকের সা-তে তাঁরা বেশির ভাগ ডাক দেন। এতে বেশি চেঁচাতে হয় না অথচ ডাক পৌঁছে যায় আশেপাশে। কেউ অবশ্য বলতে পারেন, যে-পরদা থেকে শুরু করার প্রবণতা বেশির ভাগের মধ্যেই দেখা যাচ্ছে, সেটাকে তার সপ্তকের ষড়জ বা সা না ভাবলেও চলে। ওই পরদাটাকে যদি পঞ্চম ভাবা হয়? |
চাইলে ভাবতেই পারেন। এই আপেক্ষিকতা তো থেকেই যায়। এই আলোচনায় আমরা শুরুর পরদাটাকে তার সপ্তকের সা মানছি।
যা দেখলাম, কাগজওয়ালারাই সংখ্যায় বেশি। এক জন হাঁক পাড়ছেন এ...খাতা বই পেপার। গাইছেন: র্সা-/ ণা র্সা ঋা র্সা। সংগীত নিয়ে আলোচনা স্বরলিপি ছাড়া অসম্পূর্ণ, মায় ক্ষেত্রবিশেষে অসম্ভব। আর-এক কাগজওয়ালা হাঁক পাড়ছেন খাতা বই বিক্রি কাগজওলা। সুর লাগাচ্ছেন: র্সা র্সা র্সা র্সণা/- র্সা র্সা পা/ পা পা ণা ণা র্সা। মাঝের কোমল নি থেকে মিড় দিয়ে তারার সা। লক্ষ করা দরকার, এক জনও তারের সা থেকে শুদ্ধ নি-তে আসছেন না। কয়েক দিন ধরে আমাদের এলাকার ফেরিওয়ালাদের ডাক রেকর্ড করে দেখেছি, এক জনও সা থেকে শুদ্ধ নি বা শুদ্ধ নি থেকে সা-তে গেলেন না। ‘নি’ মানেই যেন কোমল। যে পরদাটিকে আমি সা মেনেছি, সেটিকে কেউ পা মানলে স্বরলিপিতে দেখা যাবে পা থেকে শুদ্ধ মা। এক বারও তীব্র বা কড়ি মা নয়। শুরুর পরদাটিকে আমি সা মানছি নেহাত নিজের খেয়ালে নয়। যে কোনও কথাই হাঁকিয়ে বলতে গেলে যেমন, স্লোগান দিতে গেলে উঁচু গ্রামে যে পরদাটি মানুষ লাগায়, সেটিই তার সপ্তকের ষড়জের, key-note-এর গুরুত্ব পায়।
আর এক কাগজওলা স্পষ্ট সুর লাগাচ্ছেন: মধ্য পা, তারার সা/ সা সা শুদ্ধ রে। ইনি বলছেন কাগজওলা খাতা বই। বই শব্দটি ইনি বলছেন শুদ্ধ রে পরদায়। দু’বার এই লাইনটি হাঁকার পর ইনি আনছেন স্পষ্ট সুরগত বৈচিত্র: তারার সা তিন বার; দুই মাত্রায় মধ্য পা ও কোমল নি; দুই মাত্রায় মধ্য সপ্তকের কোমল নি ও তার সপ্তকের শুদ্ধ রে। বৈচিত্রটা ছন্দের দিক দিয়েও। তিন মাত্রা/ দুই মাত্রা/ দুই মাত্রা। সাত মাত্রা। এই সাত মাত্রায় আর এই সুরে তিনি আর ‘কাগজওলা খাতা বই’ বলছেন না, বলছেন ‘বই ওলা/ কাগাজ ওলা/ কাগুজ’। কাগজ নয়, কাগুজ। সা, পা, মা, গা-এর যে-কোনও একটি পরদায় সুরের ফ্রেজ শেষ হলে সাধারণত মানুষের মনে যে সম্পূর্ণতাবোধ জাগে, শুদ্ধ রে-তে শেষ হলে তা জাগে না। বরং আধা-খ্যাঁচড়া লাগে। এই বিশেষ বিক্রেতাটি মধ্য সপ্তকের নি থেকে তার সপ্তকের শুদ্ধ রে-তে শেষই শুধু করলেন না, কাগজের বদলে কাগুজ বললেন। এই দু’টি খটকার কারণে তাঁকে কিন্তু আলাদা ভাবে মনেও থাকল।
ফেরিওয়ালাদের ডাক ও সুর নিয়ে চর্চা করে আমি এটুকু বুঝেছি যে, ওই ডাকের সঙ্গে সংগীতের যোগ আছে; ফেরিওয়ালারা সুর লাগান স্পষ্ট ভাবে; যে-পরদাই তাঁরা লাগান, সেটা সম্পূর্ণ সুরে। এই কাগজওয়ালাদের মধ্যে এক জনকে পেলাম, যিনি কোমল রে ব্যবহার করেন; আর এক জনকে পেলাম, যিনি মিড় দিয়ে সুর লাগান। একটি ব্যাপারে সকলের মিল: নি মানে কোমল নি। সত্যি বলতে, অনেকের নমুনা সংগ্রহ করেছি কয়েক দিন ধরে। বাংলা উচ্চারণ শুনে যাঁদের বাঙালি মনে হয়েছে, তাঁদের কেউই শুদ্ধ নি প্রয়োগ করেননি। আমাদের জাতীয় সংগীতবোধে ও সম্মিলিত অবচেতনে কোমল নি-র গুরুত্ব কি এর একটা কারণ হতে পারে? বাঙালির নানান পল্লিগীতিতে কোমল নিখাদের প্রয়োগই বেশি।
প্রথম দিনেই, শীত তখনও জারি, বিশাল সেফ্টি-পিনের মতো দেখতে তুলো-ধোনার যন্ত্রে মন্দ্র সুর তুলে যিনি ডাক দিলেন, আশ্চর্য, তিনি কোমল গান্ধারও লাগালেন: সা সা জ্ঞা রা সা। ওই পরদাগুলিতে তিনি বলেছিলেন: বালিশের তুলা/ তুলা বালিশ; এ-তুলো এ-তুলো। এই ‘এ-তুলো’টাই তিনি গাইছিলেন: কোমল গা, শুদ্ধ রে, সা। এর পর ‘এ-তুলো’ বলার সময় তিনি তারার সা, মাঝের কোমল নি, তারার সা লাগালেন। ফেরিওয়ালাদের গলা থেকে কোমল নি ঘোচার নয়। আর, কী আশ্চর্য, ঠিক ওই সময়ে এক সাইকেলরিকশা-চালক ধুনুরির পাশ দিয়ে যেতে-যেতে হর্ন টিপে-টিপে যা বাজালেন, তা এক টুকরো সুরই। তাতে কোমল নি পরদাটা সা-এর অনুষঙ্গে দু’বার ছিল। |