|
|
|
|
|
|
|
আলোর অভিশাপ |
ভারত সফরে এসে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জানালেন, কোহ-ই-নুর নেওয়ায় তাঁরা লজ্জিত।
লজ্জার কিছু নেই। ওই হিরে যার কাছে গেছে, তারই ঝঞ্ঝাট হয়েছে। অরুণাভ পাত্র |
দাক্ষিণাত্যের প্রিক্যাম্ব্রিয়ান পাথরের তৈরি পাহাড়ি এলাকা। অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত পৃথিবীর একমাত্র হিরের খনি। খনির ভেতরে হিরে পাহারা দেয় বিষধর সাপের দল। তাই, বাইরে থেকে ছোড়া হয় তাজা ভেড়ার মাংসের টুকরো। তার চর্বিতে আটকে যায় হিরের খণ্ড। ওপরে উড়তে থাকা শকুনের দল সেই হিরে-আটকানো মাংসের টুকরো ছোঁ মেরে নিয়ে আসে খনির বাইরে। আর সঙ্গে উড়িয়ে আনে নিজেদের মৃত্যুর পরোয়ানা। কারণ, শকুন মেরে হিরের দখল নেওয়াটা মানুষের কাছে নেহাত ছেলেখেলা। লড়াই আর মৃত্যুর সেই শুরু।
১৭৩৯। ঔরঙ্গজেব মারা যাওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই দিল্লির বুকে দেখা দিল নাদির শাহ নামের এক বিভীষিকা। কয়েকশো বছর ধরে বানানো মুঘলদের গর্বের শহর ৫৮ দিনের মধ্যেই স্রেফ ধ্বংসস্তূপ। রাজধানীতে যখন চলছে লুঠ, তাণ্ডব আর হত্যালীলা, ঠিক তখনই লাগাতার গুপ্তচরবৃত্তির পর মুঘল হারেমের এক সুন্দরীর বিশ্বাসঘাতকতায় খবর মিলল: বাদশাহ মহম্মদ শাহের পাগড়িতে লুকিয়ে রাখা আছে পৃথিবীর সবচেয়ে দামি হিরে। সে দিন রাতেই বাদশাহকে নৈশভোজে ডাকলেন নাদির শাহ, আর ভোজ চলাকালীনই বিজিতকে পাগড়ি বিনিময়ের প্রস্তাব দিলেন বিজয়ী নাদির। ভাবলেশহীনভাবে নিজের পাগড়ি পারস্যের সুলতানকে তুলে দিয়েছিলেন মহম্মদ শাহ। তখনই নৈশভোজ শেষ করে নিজের ঘরে গিয়ে পাগড়ি খুলে ‘কোহ-ই-নুর’, অর্থাত্ ‘আলোর পাহাড়!’ বলে চিত্কার করে উঠেছিলেন নাদির। সেই থেকেই এই হিরের নাম কোহ-ই-নুর। এর এক দশকের মধ্যেই নিজেরই প্রহরী-প্রধানের হাতে খুন হন নাদির শাহ। তখন থেকেই খেল দেখাতে শুরু করে কোহ-ই-নুর।
|
|
এই আশ্চর্য হিরের জন্মবৃত্তান্ত রহস্যে ঘেরা। ফরাসি হিরে-ব্যবসায়ী তাভার্নিয়ে-র বক্তব্য মানলে ১৬৫৬-’৫৭ সাল নাগাদ দাক্ষিণাত্যের কোল্লুরে খনিগর্ভ থেকে উঠে এসে প্রথম দিনের আলো দেখে এই হিরে। গোলকোন্ডার মুঘল সেনাপতি মির জুমলার হাত ধরে সেই হিরে পৌঁছয় শাহজাহানের হাতে। বাবরের আত্মচরিত ঘাঁটলে আবার দেখা যায়, গ্বালিয়রের রাজার থেকে এই রত্নটি আসে আলাউদ্দিন খিলজির হাতে। তার পর তুঘলক আর লোদিদের হাত ধরে এই রত্নের মালিক হন বাবর। এর আগে এই হিরের নানান নাম থাকলেও বাবরের সময় থেকে এই হিরের নাম হয় বাবরের হিরে। তবে, ১৬৬৫ সালে ফরাসি তাভার্নিয়ে ঔরঙ্গজেবের দরবারে নিজে হাতে কোহ-ই-নুর পরখ করে দেখেন। ভেনিস থেকে আসা এক হিরের কারিগরের দুর্বুদ্ধিতে কোহ-ই-নুর তখন ৭৮৭ ক্যারাট থেকে হয়ে দাঁড়িয়েছে ২৭৯ ক্যারাটের। মারাত্মক এই অপরাধের জন্য প্রাণদণ্ডের সাজা পেয়েছিলেন হোর্তেনসিয়ো বোর্জিয়ো। শেষ মুহূর্তে প্রচুর টাকা অর্থদণ্ড (তখনকার দিনে দশ হাজার টাকা!) দিয়ে বেঁচেছিলেন তিনি।
১৭৪৭। কোহ-ই-নুর হাতে পাওয়ার আট বছর পর খুন করা হয় নাদির শাহকে। এক ঘণ্টার মধ্যে কোহ-ই-নুর সহ সমস্ত সম্পত্তির দখল নেন আহমদ শাহ আবদালি। একের পর এক যুদ্ধ জিতলেও, এক অন্য শত্রুর কাছে হার মেনেছিলেন আফগান মুলুকের প্রথম দাপুটে শাসক। সময়ের সঙ্গে বাড়ছিল মুখের এক পাশের দগদগে ঘা। সম্ভবত কুষ্ঠ বা ক্যানসার। কিছু দিনের মধ্যেই তা মাথা, ফুসফুস, হৃত্পিণ্ডে ছড়িয়ে পড়ে। তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে ১৭৭২ সালে মারা যান আবদালি। কয়েক বছরের মধ্যেই টুকরো টুকরো হয়ে যায় তাঁর গড়া দুরানি সাম্রাজ্য।
১৭২৫ সালে ব্রাজিলে হিরের খনি আবিষ্কারের আগে পর্যন্ত সারা পৃথিবীর হিরে-ব্যবসায়ীদের একমাত্র গন্তব্য ছিল দাক্ষিণাত্য। কয়েকশো বছর ধরে রফতানির পরও অবশ্য হিরের আসল ঝলক ইউরোপীয়দের নজরের বাইরে ছিল। মার্কো পোলোর কথায়, আমরা শুধু ঝড়তি-পড়তি কিছু হিরে কেনাবেচা করি। গোলকোন্ডার সব ভাল হিরেই থেকে যায় স্থানীয় খান বা রাজাদের দখলে। গোলকোন্ডা নামটিই অসংখ্য গল্পকথা আর এল ডোরাডোর ভাবনাকে যুগ যুগ ধরে উসকে দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয়, কলোরাডো আর নেভাডা প্রদেশের প্রতিটিতেই গোলকোন্ডা নামে একটি করে জায়গা আছে। অস্ট্রেলিয়ার তাসমানিয়াতেও হিরের আশায় খনি-মালিকেরা একটি এলাকার নাম রেখেছিলেন গোলকোন্ডা। ১৭৯৭। আহমদ শাহ আবদালির ছেলে তিমুর শাহের থেকে এই হিরে আসে পৌত্র শাহ জামানের হাতে। টিপু সুলতানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে উত্তর ভারত আক্রমণের প্রস্তুতি হিসেবে খাইবার পাস পেরিয়ে লাহৌরের মুঘল দুর্গে ঘাঁটি গাড়েন শাহ জামান। লর্ড ওয়েলেসলির নেতৃত্বে তখন উপকূল এলাকা ছেড়ে ভারতের মূল ভূখণ্ডে ঢুকতে শুরু করেছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। পালটা চাল হিসেবে অযথা রক্তক্ষয়ের রাস্তায় হাঁটেননি কোম্পানির কর্তাব্যক্তিরা। ১৭৯৮ সালে পারস্যে পৌঁছয় ব্রিটিশ দূত। পারস্যকে কাবুল আক্রমণ করতে উত্সাহ দেওয়া হয় এই ব্রিটিশ দৌত্যে। কাবুল রক্ষা করতে গিয়ে লাহৌর থেকে পিছু হটেন শাহ জামান। এই সুযোগে লাহৌর-সহ পঞ্জাবের দায়িত্ব নিয়ে নেন রণজিত্ সিংহ নামে এক ১৯ বছরের তরুণ শিখ। কাবুলে ফেরার আগেই শিখ, ইরানি ও ব্রিটিশ সেনার তাড়া খেয়ে সর্বস্বান্ত হন শাহ জামান। রাজার এমন অবস্থা, তাঁকে আসতে দেখেই বন্ধ করে দেওয়া হয় কাবুলের গেট। পালিয়ে প্রাণে বাঁচলেও এক বরফঢাকা শীতের রাতে জালালাবাদ আর খাইবার পাসের মাঝে এক সরাইখানায় তাঁকে বন্দি করে আফগান-দস্যুরা। কোহ-ই-নুরের খোঁজে চোখে গরম সুচ ঢুকিয়ে তাঁকে অন্ধ করে দেওয়া হয়। তবু সেই হিরের কোনও হদিশ দেন না শাহ জামান। শেষ পর্যন্ত তাঁকে বন্দি রাখা হয় খাইবার পাসের কাছেই এক কেল্লায়। পালিয়ে প্রাণে বাঁচেন তাঁর ১৪ বছরের ভাই শাহ সুজা।
১৮০৯ সালের মার্চ। দশ বছর ধরে হারিয়ে থাকা একটা পারিবারিক সম্পত্তির খোঁজ পেলেন ২৪ বছরের তরুণ রাজা শাহ সুজা। নিজের ভাই শাহ জামানকে সরিয়ে সাত বছর ধরে মসনদে থাকলেও কোহ-ই-নুরের কোনও খোঁজ মিলছিল না। লাগাতার অত্যাচারের পরও হিরের খোঁজ দিতে রাজি হচ্ছিলেন না শাহ জামান। হঠাত্ খাইবার পাসের কাছে এক স্থানীয় শেখের অফিসঘরে দেখা মিলল কোহ-ই-নুরের। দুর্গের পাশের পরিখা থেকে ‘পাথরের টুকরো’টি পেয়ে সেটিকে নিজের অফিসঘরে পেপারওয়েট হিসেবে ব্যবহার করছিলেন এই শেখ! জানা গেল, বন্দিদশায় কেল্লার দেওয়ালের ফাটলে হিরেটি লুকিয়ে রেখেছিলেন শাহ জামান। কাবুলে শাহজাহানের বানানো বালা হিসার দুর্গে সে দিন উদ্দাম ফুর্তি। এ দিন থেকেই আবার শাহ সুজার জীবনে নেমে এল দুর্ভাগ্যের অন্ধকার! সৌভাগ্যের ছদ্মবেশে! তখন নেপোলিয়ন পারস্যে প্রভাব বিস্তার করছেন, ব্যাপারটা সুবিধের নয়, তাই আফগান মুলুকে নিজেদের মিত্রশক্তি থাকাটা জরুরি এই ভেবে ব্রিটিশ কর্তারা শাহ জামানের সঙ্গে শত্রুতা ভুলে তাঁর ভাই শাহ সুজার সঙ্গে বন্ধুত্ব তৈরিতে আগ্রহ দেখালেন।
এলফিনস্টোন মারফত ব্রিটিশ সাহায্যের খবর যে দিন শুনতে পান শাহ সুজা, ঘটনাক্রমে সে দিনই তিনি খোঁজ পান কোহ-ই-নুরের। ভবিষ্যত্ জানা গেলে সুজা বুঝতে পারতেন, এই দুটি আপাত-ভাল খবর তাঁর জীবনে নিয়ে আসছে চরম বিপর্যয়। ব্রিটিশদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলার মধ্যেই, মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে আফগানিস্তানের বেশির ভাগ অংশ চলে যায় বিদ্রোহীদের দখলে। একের পর এক যুদ্ধ হারতে শুরু করেন সুজা। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে সাঙ্গপাঙ্গ-সহ কলকাতার দিকে রওনা দেন ব্রিটিশ দূত এলফিনস্টোন। সব হারিয়ে আবার নিজের পুরনো জীবনে ফিরে যান সুজা।
তবে এ বার সঙ্গে কোহ-ই-নুর। তাই জীবন আরও দুঃসহ। তাঁকে বন্দি করে কাশ্মীরে নিয়ে যাওয়া হয়। কোহ-ই-নুরের খোঁজে চলতে থাকে নিত্যনতুন অত্যাচার। সুজাকে মুক্ত করতে শিখ মহারাজা রণজিত্ সিংহের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন সুজার এক বেগম। বিনিময়ে রণজিত্ সিংহকে দিতে হবে মহামূল্য কোহ-ই-নুর। ১৮১৩ সালে কাশ্মীর আক্রমণ করে সুজাকে মুক্ত করে লাহৌরে নিয়ে আসতে দেরি করেননি পঞ্জাব-কেশরী। শাহ জামানের লাহৌর ছাড়ার কয়েক বছরের মধ্যেই ধুরন্ধর বুদ্ধি আর সফল কূটনীতির সাহায্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন এক-চোখের এই মানুষটি।
|
|
লাহৌরে সুজাকে নিয়ে এসে মুবারক হাভেলিতে তোলেন রণজিত্ সিংহ। তাঁর হারেম আলাদা করে দেওয়া হয়। কোহ-ই-নুরের খোঁজে চাপ বাড়তেই থাকে। সুজাকে হিরেটির দাম জিজ্ঞেস করা হলে তিনি রণজিত্কে জানান: পাঁচ জন বলশালী যুবকের এক জন পূর্ব, এক জন পশ্চিম, এক জন উত্তর, এক জন দক্ষিণ, আর এক জন আকাশের দিকে গায়ের জোরে পাঁচটি পাথর ছুড়লে মোট যে এলাকা হয়, সেই এলাকা সোনা দিয়ে ভরাট করলে তবেই তা কোহ-ই-নুরের সমকক্ষ হবে। সোজা আঙুলে ঘি না ওঠায় সুজাকে খাঁচায় বন্দি করে রাখেন রণজিত্। সুজার ছেলেকে তাঁর চোখের সামনেই চরম অত্যাচারের মুখোমুখি হতে হয়। শেষ পর্যন্ত ১৮১৩ সালে কোহ-ই-নুর পঞ্জাব- কেশরীকে দিতে বাধ্য হন সুজা। তিন দশক পর কাবুলে নিজের দুর্গেই গুপ্তঘাতকের হাতে খুন হন শাহ সুজা।
১৮৩১। তখন রাশিয়ার আতঙ্ক চেপে বসেছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তাদের মাথায়। আফগানিস্তান হয়ে ভারতে ঢোকার চেষ্টা করছে রুশেরা এমন খবর পাওয়ার পরই, মধ্য এশিয়ায় অন্যতম সফল ব্রিটিশ কূটনীতিক আলেকজান্ডার বার্নেস-কে আফগান মুলুকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। শুরু হয় ইংল্যান্ড আর রাশিয়ার বিখ্যাত ‘গ্রেট গেম’। এলাকায় প্রভাব বিস্তারের প্রাথমিক শর্ত হিসেবে রণজিত্ সিংহের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ান বার্নেস। লাহৌরে এক আলাপচারিতার রাতে নিজে হাতে কোহ-ই-নুর পরখ করে দেখেন বার্নেস। ঠিক দশ বছর পর, নভেম্বরের এক সকালে, কাবুলে বার্নেসকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারে আফগান বিদ্রোহীরা।
১৮৩৯ সালে ৫৮ বছর বয়সে মারা যান রণজিত্ সিংহ। কয়েক বছরের মধ্যেই টুকরো টুকরো হয়ে যায় শিখ রাজ্য। দ্বিতীয় ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধে শিখদের শোচনীয় হারের পর, কোম্পানির কাছে শিখ সরকারের প্রচুর দেনা এই অজুহাতে লাহৌরের রাজকোষ বাজেয়াপ্ত করে ইংরেজরা।
কোহ-ই-নুরও যায় কোম্পানির দখলে। ১৮৫০ সালে প্রথম বারের জন্য ভারতীয় উপমহাদেশ ছাড়ে কোহ-ই-নুর। আজ পর্যন্ত যা এ তল্লাটে ফেরেনি।
১৮৫১ সালে লন্ডনের ক্রিস্টাল প্যালেসে প্রদর্শিত হয় কোহ-ই-নুর। তবে কাটিং পছন্দ না হওয়ায় ফের কাটিংয়ের নির্দেশ দেন রানি ভিক্টোরিয়া। আমস্টারডাম থেকে ডেকে পাঠানো হয় খ্যাত হিরে-শিল্পী ভুরসানগের-কে। শুধু এই কারণেই বানানো হয় চার হর্সপাওয়ারের একটি স্টিম ইঞ্জিন। যুবরাজ অ্যালবার্ট নিজে হাতে হিরেটিকে কাটিং মেশিনে বসান। এ বারের কাটিং পছন্দ হয় রানির। তবে, এত কাণ্ডে কোহ-ই-নুরের ২৭৯ ক্যারাট ইতিমধ্যেই নেমে এসেছিল ১৮৬ ক্যারাটে, এ বার কাটিং-এর ফলে তা নেমে দাঁড়ায় ১০৮ ক্যারাটে। ঘটনার একশো বছরের মধ্যে কোনও দিন সূর্য অস্ত-না-যাওয়া ব্রিটিশ সাম্রাজ্য আবার ফিরে যায় নিজেদের সেই ছোট্ট দ্বীপপুঞ্জে, যেখান থেকে বিশ্বজয়ের অভিযান শুরু করেছিল তারা।
১৯৩৭ সালে রানি প্রথম এলিজাবেথের মুকুটে বসানো হয় ব্রিটিশ আভিজাত্যের প্রতীক কোহ-ই-নুর। এর পর থেকে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানেই এই মুকুট ব্যবহার করতেন তিনি। ১৯৯৪ সাল থেকে কোহ-ই-নুর সহ এই মুকুটের ঠিকানা লন্ডনের নিউ জুয়েল হাউস। |
|
মজার ব্যাপার: কোহ-ই-নুর বাদ দিলেও দাক্ষিণাত্যের প্রতিটি বিখ্যাত হিরেরই ঠিকানা এখন লন্ডন, প্যারিস, তেহরান, মস্কো বা ওয়াশিংটন। হোপ ডায়মন্ড আছে ওয়াশিংটনে, রিজেন্ট ডায়মন্ড প্যারিসে, অরলভ মস্কোর ক্রেমলিনে। আর কোহ-ই-নুরের অনন্য জুড়ি দরিয়া-ই-নুরের মালিক এখন তেহরানের সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক অব ইরান। দরিয়া-ই-নুর ছাড়া প্রতিটি হিরেরই এখন ইউরোপীয় নাম!
১৯৪৭-এ ভারতের স্বাধীনতার পরই বোঝা যায়, এ দেশের প্রচুর সাংস্কৃতিক সম্পদের ঠিকানা গ্রেট ব্রিটেন। কোহ-ই-নুর সহ সেই সব সম্পদ দেশে ফেরানোর দাবি তখন থেকেই জোরালো হতে শুরু করে। সব দাবিকে নস্যাত্ করে ১৯৫৩ সালে ভারতের তত্কালীন শিক্ষামন্ত্রী মৌলানা আবুল কালাম আজাদ সংসদে জানান, কোহ-ই-নুর কোনও শিল্পসামগ্রী নয় এবং এই মুহূর্তে তা ব্রিটিশ রাজমুকুটের একটি রত্ন। তাই ওই হিরে ফেরানোর দাবির সঙ্গে সহমত নয় সরকার। দু’দশক পর ইংল্যান্ডের সঙ্গে কূটনৈতিক বৈঠক চলাকালীন পাক প্রধানমন্ত্রী ভুট্টো কোহ-ই-নুর পাকিস্তানে ফেরানোর দাবি জানান। তাঁর যুক্তি, লাহৌর থেকে ইংরেজদের হাতে গিয়েছিল হিরেটি। তাই পাকিস্তানই হওয়া উচিত এই রত্নের ঠিকানা। তবে কিছুতেই চিঁড়ে ভেজেনি।
ছবিটা আজও একই রকম। ক’দিন আগেই ভারত সফরে এসে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ফের এই দাবি নাকচ করে দেন। তবে লুঠের মাল ফেরত দিতে ব্রিটিশ আপত্তি শুধু কোহ-ই-নুর নয়, আরও অনেক ক্ষেত্রেই খাটে। ১৮১৬-তে পার্থেননের গ্রিক মন্দির থেকে আড়াই হাজার বছর পুরনো শ্বেতপাথরের অনন্য শিল্পকলা উপড়ে তুলে ইংল্যান্ডে পাঠান টমাস ব্রুস নামে এক ইংরেজ। তাঁর যুক্তি: স্থানীয় মানুষেরা এই সব মূর্তি ভেঙে বাড়ি তৈরির সুরকি বানাচ্ছেন। স্থানীয় মানুষেরা ভেঙে ফেললে আড়াই হাজার বছর ধরে তা টিকল কী করে? এমন নানা প্রশ্ন উঠলেও পার্থেননের মন্দিরের অনবদ্য শ্বেতপাথরের শিল্পকলা প্রায় দু’শো বছর ধরে ব্রিটিশ মিউজিয়মের ঠান্ডা ঘরে শোভা পাচ্ছে। কোহ-ই-নুরের সঙ্গে এই শিল্পকলা ফেরতের দাবিও উড়িয়ে দিয়েছেন ক্যামেরন। আসলে তিনি বোধ হয় তাঁর পূর্বসূরিদের দেখানো পথেই হাঁটছেন। |
ছবি: সুমন চৌধুরী |
|
|
|
|
|
|