শৌচাগারের অভাবে এ দেশে অজস্র মেয়ের জীবনে অসুবিধা, কষ্ট, অসুখ, বিপদের অন্ত নেই। কিন্তু
কী এসে গেল? পুরুষ তো ইচ্ছে করলেই রাস্তার ধার খুঁজে দাঁড়িয়ে যেতে পারে, ব্যস!
লিখছেন
পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায় |
মেয়েদের যখন-তখন বাথরুম পেতে নেই। এ দেশের প্রশাসকেরা নিশ্চয়ই তা-ই মনে করেন। তা না হলে যে কোনও সভ্য দেশের মতো এখানেও শহরে, মফস্সলে, গ্রামে, হাইওয়ে-জাতীয় সড়কের ধারে নির্দিষ্ট ব্যবধানে মেয়েদের জন্য যথেষ্ট সংখ্যায় শৌচাগার থাকত। প্রশাসন কি কখনও ভেবেছে হঠাৎ রাস্তাঘাটে বাথরুম পেলে, ঋতুস্রাব শুরু হয়ে গেলে, ন্যাপকিন বা কাপড় বদলের দরকার হলে যখন আশপাশে কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে শৌচাগার পাওয়া যায় না, তখন একটা মেয়ের কী অবস্থা হয়? কে ভাববে? কেন ভাববে? তুমি মেয়ে অতএব তোমার শরীর সম্পর্কে প্রবল লজ্জাবোধ থাকবে, তুমি হবে সহনশীলতার প্রতিমূর্তি। বেচারা পুরুষ অত সইতে পারে না বলেই তো তাদের যত্রতত্র দাঁড়িয়ে পড়ে হালকা হওয়ার ছাড়পত্র আছে। সর্বংসহা মেয়েদের বাথরুম চেপে রেখে ইউরিনারি ট্র্যাকে সংক্রমণ হল তো বয়েই গেল।
সুপ্রিম কোর্ট সময়সীমা বেঁধে দিয়ে নির্দেশ দিয়েছে যে, প্রতিটি স্কুলে ছেলে ও মেয়ে পড়ুয়াদের জন্য আলাদা স্থায়ী শৌচাগার করতেই হবে। কিন্তু তাতে কতটা কাজ হবে, বলা শক্ত। ইউনিসেফের সমীক্ষা বলছে, ভারতে যত স্কুল রয়েছে তার মাত্র ৪৪ শতাংশে মেয়েদের জন্য আলাদা শৌচাগার রয়েছে। |
ছত্তীসগঢ়ে অনুপাতটা মাত্র ২০ শতাংশ, জম্মু-কাশ্মীরে ২২, মধ্যপ্রদেশে ২৩, অসম-সহ উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিতে ২৭। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও দেশের ৬০ শতাংশ স্কুল এখনও মেয়েদের জন্য আলাদা শৌচাগার তৈরি করে উঠতে পারেনি। এই সমস্যাটা ছাত্রীদের স্কুলছুট হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ। ‘অ্যানুয়াল স্টেটাস অব এডুকেশন রিপোর্ট’ (২০১১) অনুযায়ী, ভারতে ঋতুমতী হওয়ার পর ২৩ শতাংশ ছাত্রী স্কুল ছেড়ে দেয় শুধু স্কুলে শৌচাগার না-থাকার জন্য। অন্য দিকে, ১৯৯২ থেকে ইউনিসেফ বাংলাদেশে স্কুলে-স্কুলে মেয়েদের আলাদা শৌচাগার তৈরি শুরু করার পর নারীশিক্ষার হার একলাফে ১১ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল। ২০১২ সালে কলকাতা সহ ভারতের পাঁচটি বড় শহরে বস্তি এলাকায় সমীক্ষা চালিয়ে ‘চাইল্ড রাইটস অ্যান্ড ইউ’ (ক্রাই) দেখেছিল, ৪০ শতাংশ স্কুলে মেয়েদের আলাদা শৌচাগার নেই।
যথেষ্ট শৌচাগার না থাকাটা মেয়েদের পক্ষে এক দৈনন্দিন যন্ত্রণার কারণ। কিছু দিন আগে এক নিউজ চ্যানেলে দিল্লির এক বস্তির বাসিন্দা বছর পনেরোর এক কিশোরী বলেছিল, “আমাদের বস্তির পিছনে একটি ছোট পার্ক আছে। ভোর ভোর উঠে আমরা মেয়েরা একসঙ্গে ওখানে যাই। এ ছাড়া উপায় নেই। পার্কের গা ঘেঁষে একটা সব্জিবাজার বসে। সেখানে ভোরেই দোকানিরা চলে আসে, লুকিয়ে দেখে। টিটকিরি দেয়, পাথর ছুড়ে মারে। আমাদের ভীষণ লজ্জা করে।”
২০০৯ সালের এক সরকারি সমীক্ষা বলছে, ভারতের রাজধানী শহরে ছেলেদের জন্য ১৫৩৪টি শৌচাগার রয়েছে, মেয়েদের জন্য রয়েছে মাত্র ১৩২টি! মুম্বইয়ে মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের শৌচাগার প্রায় ২৫০০ বেশি। পুরসভার হিসাবে কলকাতা শহরে একই বাড়িতে পাশাপাশি পুরুষ ও মহিলা শৌচাগার রয়েছে মাত্র ২৩০টি জায়গায়। শুধু ছেলেদের জন্য এর বাইরেও শৌচাগার আছে, মেয়েদের নেই। ও দিকে, বহু তথাকথিত ‘শিক্ষিত’, ‘রুচিমান’ পরিবারে কাজ করতে আসা মেয়েটিকে প্রয়োজনে শৌচাগার ব্যবহার করতে দেওয়া হয় না। কাজের মেয়েটি অনেক নিচু জাতের, জামাকাপড়ে সুবাস নেই। অতএব, তাঁরা ব্যবহার করলে ভদ্রলোকি বাথরুমের জাত যাবে।
ব্রিটিশ আর্বান প্ল্যানার ক্লারা গ্রিড বলেছিলেন, “একটা দেশে মেয়েদের অবস্থা ঠিক কেমন তা বোঝা যায় তার টয়লেটের দশা এবং তার সামনে রোজ কতটা লাইন পড়ছে সেটা দেখে।” আমাদের ক’টা জেলা শহরে যথাযথ পাবলিক টয়লেট রয়েছে? বাঙালি সবচেয়ে বেশি যে দু’টি জায়গায় গাড়ি নিয়ে বেড়াতে যায় সেই শান্তিনিকেতন এবং দিঘার রাস্তার ধারে একটিও সুলভ শৌচালয়ের কথা মনে পড়ছে? পুরুষেরা গাড়ি দাঁড় করিয়ে ঝোপে নামতে পারেন। কখন এমন একটা খাবারের দোকান বা ধাবা আসবে যেখানে একটা শৌচালয় রয়েছে, তার অপেক্ষায় সময় গোনা ছাড়া মেয়েদের গতি নেই। লোকাল ট্রেনেও তথৈবচ। মফস্সলের স্টেশনে মহিলা শৌচালয়ের প্রায় কোনও অস্তিত্ব নেই। যে মেয়েটা ত্রিবেণী বা ব্যান্ডেল, বর্ধমান বা ক্যানিং-লক্ষ্মীকান্তপুর থেকে কয়েক ঘণ্টা লোকাল ট্রেন উজিয়ে কলকাতায় আসবে তার বাথরুম পেলে কোনও গতি নেই।
আর গ্রামে? অর্ধেকের বেশি ভারতবাসী এখনও মাঠে-হাটে মলমূত্র ত্যাগে অভ্যস্ত। এতে পুরুষের থেকে মেয়েদের সমস্যা হয় চতুর্গুণ। প্রধান সমস্যা নিরাপত্তার অভাব ও লোকালয় বেড়ে যাওয়া। লোকজন জাগার আগে অন্ধকার থাকতেই বাড়ির মেয়েদের মাঠে প্রাতঃকৃত্য সেরে আসতে হয়। বহু মেয়ে এই সময়েই শ্লীলতাহানি বা ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। আয়লার পরে দক্ষিণ ২৪ পরগনার কুলতলি এলাকায় গিয়েছিলাম। গ্রামের পর গ্রাম গাছপালাশূন্য। গ্রামের মেয়েরা ঘরে নিয়ে গিয়ে কাপড় তুলে দেখিয়েছিলেন, তাঁদের যৌনাঙ্গ জুড়ে ঘা! জানিয়েছিলেন, ঝোপঝাড় ভেসে যাওয়ায় তাঁরা মলমূত্র ত্যাগ করার আড়ালটুকু পাচ্ছেন না। পুকুরের জল নষ্ট। উপায়ান্তর না থাকায় সেই জলেই ঋতুকালীন কাপড় ধুতে হচ্ছে। ছড়াচ্ছে সংক্রমণ।
কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী জয়রাম রমেশ বলেছিলেন, “শৌচালয় মেয়েদের মধ্যে অদ্ভুত আত্মমর্যাদাবোধ, আত্মবিশ্বাস আর নিরাপত্তার ধারণা নিয়ে আসে।” খুব দামি কথা। আর একটা কথা বলেছিলেন রমেশ। “আমাদের দেশে দেবদেবীর সংখ্যা বড্ড বেশি। এ দেশে মন্দিরের তুলনায় শৌচালয়ের সংখ্যা বাড়ানো উচিত।” শুনে বজরং দল, বিশ্ব হিন্দু পরিষদেরা সব রে-রে করে উঠেছিল। সনাতন ভারতবর্ষে কিনা ধর্ম আর শৌচালয় এক করে দেওয়া! এত আস্পর্ধা!
আচ্ছা ধরা যাক, এক দিনের জন্য নিয়ম করা হল যে, ২৪ ঘণ্টা দেশের কোনও পুরুষ রাস্তা-ঘাট-মাঠ-হাট কোথাও প্রকাশ্যে মল বা মূত্র ত্যাগ করতে পারবেন না। তখনও কি সর্ব ধর্মের সব কট্টরবাদী দল শৌচালয় তৈরির থেকেও মন্দির-মসজিদ তৈরিকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলতে পারবে? দরকার একটা ধাক্কা দেওয়া। চিনের গুয়াংঝাউ শহরের মেয়েরা ‘পটি প্যারিটি’ আন্দোলন করেছিল: ছেলেদের বেশি টয়লেট, মেয়েদের কম, এটা চলবে না। প্রতিবাদে এক ঘণ্টার জন্য শহরে ছেলেদের সব টয়লেট দখল করে বসে ছিলেন মেয়েরা। নাগপুরের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও এক দিনের ‘টয়লেট দখল’ অভিযান চালিয়েছিল। হরিয়ানায় সরকারি সহযোগিতায় গড়ে উঠেছে ‘শৌচালয় নহি তো দুলহন নহি’ আন্দোলন। শ্বশুরবাড়িতে পাকা শৌচালয় না-থাকলে কোনও মেয়ে সেই বাড়িতে বিয়ে করবেন না বা বিয়ে করলেও আমরাও তো আর একটু ভাবতে পারি! |