মাঠপুকুর-কাণ্ডে ফেরার কাউন্সিলর শম্ভুনাথ কাওয়ের খোঁজে প্রায় ২৪ ঘণ্টা ধরে কলকাতা পুরসভার প্রাক্তন এক তৃণমূল কাউন্সিলরের বাড়ি ঘিরে রাখল পুলিশ। যদিও ভিতরে ঢুকে তল্লাশি চালানো হয়নি। বাড়ি ঘিরে রাখা সত্ত্বেও তল্লাশি চালানো হল না কেন, তা নিয়ে যেমন প্রশ্ন উঠেছে লালবাজারের অন্দরে, তেমনই শনিবার প্রগতি ময়দান থানার ওসি ইন্দ্রনীল চৌধুরীর বদলি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে পুলিশের একাংশ।
গত বুধবার ধাপা মাঠপুকুর এলাকায় একটি বহুতল নিয়ে বচসার সময়ে মারধর করা হয় স্থানীয় তৃণমূল নেতা অধীর মাইতিকে। তার জেরেই মৃত্যু হয় তাঁর। এই ঘটনায় খুনের অভিযোগ দায়ের হলে অন্যতম অভিযুক্ত হিসেবে চিহ্নিত হন এলাকার তৃণমূল কাউন্সিলর শম্ভুনাথ কাও। ঘটনার দিন থেকেই ফেরার তিনি। পুলিশের দাবি, তাঁর খোঁজে এলাকায় বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি চলছে। তদন্তকারীদের সূত্রে খবর, তল্লাশি অভিযানের অঙ্গ হিসেবেই কলকাতা পুরসভার প্রাক্তন কাউন্সিলর রতন দে-র বাড়ি ঘিরে ফেলা হয়েছিল।
পুলিশ এ বিষয়ে সরকারি ভাবে কিছু না বললেও লালবাজার সূত্রের খবর, কলকাতা পুরসভার প্রাক্তন কাউন্সিলর রতন দে-র বাড়িতে শম্ভুনাথ লুকিয়ে থাকতে পারেন বলে খবর মিলেছিল শুক্রবার দুপুরে। সেই মতো শুক্রবার বিকেল থেকেই রতনবাবুর যোধপুর পার্ক এলাকার বাড়ি ঘিরে ফেলে সাদা পোশাকের পুলিশের একটি দল। যার দায়িত্বে ছিলেন এক জন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার ও দু’জন ইনস্পেক্টর। শুক্রবার বিকেল থেকে শনিবার পর্যন্ত বাড়ি ঘিরে রাখলেও ভিতরে ঢুকে তল্লাশি চালানো হয়নি। শেষমেশ শনিবার বিকেলের দিকে পুলিশি পাহারা তুলে নেওয়া হয়। পুলিশ সূত্রের খবর, বাড়ি ঘিরে ফেললেও লালবাজারের উপর মহল থেকে নির্দেশ না মেলায় ভিতরে ঢুকে তল্লাশি করা যায়নি। তবে কে বা কারা সেই নির্দেশ দেননি, তা নিয়ে কোনও রকম মুখ খুলতে নারাজ পুলিশ।
রতনবাবুর মা বন্যা দে এ দিন জানান, শুক্রবার সন্ধ্যা থেকেই তাঁর ছেলে বাড়ি নেই। তা ছাড়া, তাঁর বাড়িতে কেউ লুকিয়ে নেই বলেও দাবি বন্যাদেবীর। রতনবাবুর পরিবার জানায়, দলীয় কাজেই বেরিয়েছেন তিনি। তবে সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানাননি তাঁরা। এ দিন রতনবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
অধীরবাবুর মৃত্যুর পরে বৃহস্পতিবার তাঁর বাড়ি যান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার আগেই বাঁকুড়ার ঝিলিমিলির সভা থেকে শম্ভুনাথ কাওকে গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। শনিবার নিহত নেতার বাড়িতে যান দলীয় সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। পুলিশের একাংশই বলছে, মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ তো রয়েইছে, তার উপরে নিহত নেতার পরিবারের পাশে দাঁড়াচ্ছেন শাসকদলের একাধিক শীর্ষস্থানীয় নেতা। তার পরেও কেন অভিযুক্ত কাউন্সিলরকে গ্রেফতার করা যাচ্ছে না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে খাস লালবাজারের ভিতরেই।
এই বিতর্কে আরও ইন্ধন জুগিয়েছে প্রগতি ময়দান থানার ওসি ইন্দ্রনীল চৌধুরীর বদলি। এক পুলিশকর্তা জানান, ইন্দ্রনীলবাবুকে থানা থেকে ট্রাফিক বিভাগে বদলি করা হয়েছে। আপাতত ওই থানার অতিরিক্ত ওসি দেবাশিস চক্রবর্তীই থানার দায়িত্বে থাকবেন। এই বদলির কারণ নিয়ে মুখ খুলতে চাননি লালবাজারের কর্তারা। তবে পুলিশের একাংশ বলছে, ওই এলাকায় তোলাবাজির বাড়বাড়ন্ত নিয়ে শুক্রবার পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ করপুরকায়স্থের কাছে ওসি-র বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়েছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তার ভিত্তিতেই বদলি করা হয়েছে ইন্দ্রনীলবাবুকে। যদিও পুলিশের অন্য একটি অংশের মত, ধাপা-সহ কলকাতার বিভিন্ন এলাকায় রাজনৈতিক ‘দাদাগিরি’ আটকানোর বিষয়টি থানা স্তরে সীমাবদ্ধ থাকে না। সেখানে ওসি-র বদলি হওয়ার বিষয়টি পুলিশের মনোবলেই ধাক্কা দেবে।
সম্প্রতি গার্ডেনরিচ-কাণ্ডের পরে শাসকদলের বরো চেয়ারম্যান মহম্মদ ইকবাল ও তাঁর শাগরেদদের বিরুদ্ধে সময়মতো ব্যবস্থা না-নেওয়ার অভিযোগে রঞ্জিতকুমার পচনন্দাকে কমিশনারের পদ থেকে সরানো হয়। এমনকী, লালবাজারের হাত থেকেও তদন্তভার সরিয়ে সিআইডি-র হাতে দেওয়া হয়। তবে নিচুতলার কোনও পুলিশকর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তা হলে এ ক্ষেত্রে ওসি-র উপরে বদলির খাঁড়া নামল কেন, তা নিয়েও পুলিশমহলে ক্ষোভ রয়েছে।
অভিযুক্ত কাউন্সিলরকে পাকড়াও করতে না-পারলেও শনিবার ধাপা এলাকা থেকে শম্ভুনাথের এক শাগরেদকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশ জানায়, ধৃতের নাম বিকাশ মণ্ডল ওরফে কানা বিকাশ। বাড়ি স্থানীয় বৈঁচতলা এলাকায়। শনিবার সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ খানাবেড়িয়ার কাছে ১০ নম্বর ধাপা ‘ডাম্পিং গ্রাউন্ড’ থেকে তাকে গ্রেফতার করে লালবাজারের গুন্ডা-দমন শাখা। পুলিশের অভিযোগ, ২০ মার্চ সকালে তৃণমূল কাউন্সিলর শম্ভুনাথ কাওয়ের নেতৃত্বে অধীর মাইতির উপরে যে দলটি হামলা চালায়, সে দলে ছিল কানা বিকাশও।
কে এই কানা বিকাশ? ধাপা রোড এলাকার বাসিন্দারা জানান, ছোট থেকে বাঁ চোখে দেখতে পায় না সে। তাই নাম কানা বিকাশ। পুলিশের সূত্র বলছে, জমি ও ভেড়ি দখলে শম্ভুনাথের অন্যতম বিশ্বস্ত শাগরেদ বিকাশ। বছর দুয়েকেরও বেশি সময় ধরে সে শম্ভুনাথের সঙ্গী। পুলিশের কাছে এলাকার মানুষ অভিযোগ করেছেন, এলাকার ব্যবসায়ী, সব্জি-বিক্রেতাদের কাছ থেকে তোলা আদায় করা ছাড়া ধাপায় পুরসভার আবর্জনা বিভাগের ঠিকাদারদের গাড়ি থেকে তেলও চুরি করত বিকাশ। শম্ভুনাথের সঙ্গী হওয়ার আগে ধাপা, ভাঙড় এলাকার চোরাই তেলের কারবারি দুধের আলির সঙ্গে থাকত সে। অধীর মাইতি খুনের ঘটনায় অন্যতম অভিযুক্ত বাচ্চা তারকও কানা বিকাশের সঙ্গে চোরাই তেলের কারবারে জড়িত বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ। তারককেও খুঁজছে পুলিশ। |