স্বাধীনতা? নাকি, সকলের সমান অধিকার? মাওবাদ, দারিদ্র-অধ্যুষিত আজকের ভারতীয় জনজীবনে কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ?
প্রশ্নটার নিষ্পত্তি সহজে হওয়ার নয়। কোম্পানি বিষয়ক মন্ত্রী এবং তরুণ কংগ্রেস নেতা সচিন পায়লট, ‘জাপানিজ ওয়াইফ’-এর লেখক কুণাল বসুদের মনে হয়েছিল, স্বাধীনতাই প্রথম শর্ত। “সমান অধিকার লক্ষ্য হতে পারে, কিন্তু সেখানে পৌঁছতে হয় স্বাধীনতার পথ দিয়েই। স্বাধীনতা ধাত্রী, সমান অধিকার তার সন্তান,” বলছিলেন কুণাল। সচিন পায়লটও সমর্থন করলেন তাঁকে, “সমান অধিকার অনুভব করতে হয়। কিন্তু সেটি অনুভব করতে গেলে স্বাধীনতা দরকার। টুইটার বা সাইবার স্পেসে সকলে সমান কেন? কারণ, সকলের যা খুশি ভাবার এবং বলার স্বাধীনতা আছে।”
অভিজ্ঞতা অবশ্য অন্য কথা বলল। বিদেশমন্ত্রী সলমন খুরশিদ কিছুক্ষণ পরেই সচিনের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে সাফ জানালেন, “সোশ্যাল মিডিয়ায় সকলে সমান, কেন না সকলের সমান অধিকার। স্বাধীনতার সঙ্গে ওর কোনও সম্পর্ক নেই।” তাঁকে সমর্থন করে সাংসদ সৌগত রায় জানালেন, সমান অধিকারই গুরুত্বপূর্ণ। ‘‘এক বিখ্যাত বাঙালি কবি তাই লিখে গিয়েছিলেন, ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় / পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।’’ এবং শুধু ওইটুকু বলেই থামলেন না তিনি “সব নাগরিকের সমান অধিকার না থাকলে কী হয় জানেন তো? তখন সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের লাইনগুলি সত্য হয়ে ওঠে। প্রিয় ফুল খেলিবার দিন নয় অদ্য।” এর পরও কবিতাপ্রিয় কলকাতায় দ্য টেলিগ্রাফ বিতর্কের ফল লেখার দরকার আছে? সঞ্চালক রুদ্রাংশু মুখোপাধ্যায়কে বেশি সময় খরচও করতে হয়নি। বিতর্কশেষে অভিজাত ক্যালকাটা ক্লাবের লনে বেশির ভাগ দর্শক হাত তুলে জানিয়েছেন, স্বাধীনতার থেকেও সমান অধিকার বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ছত্তীসগঢ়ের দরিদ্র উপজাতি বালক থেকে বিত্তবান উচ্চবর্গের নাগরিক, সকলের সমান অধিকার! |
জয়ী টিমে সৌগত-খুরশিদরা শেষ দিকে রান তুলতে নেমেছিলেন। তাঁদের আগে সচিন তেন্ডুলকরের মতো দুর্দান্ত শুরুটা করে গিয়েছিলেন রাজদীপ সরদেশাই। “যে ছেলেটা স্বাধীনতা দিবসে আপনার গাড়ির সামনে পতাকা বিক্রি করে, সে কি স্বাধীনতার আনন্দে পতাকা বিক্রি করে, নাকি দু’মুঠো ভাতের জন্য? বাইরে তাকিয়ে দেখুন, ছত্তীসগঢ়ের দলিত ছেলেটি কী চায়? তার গ্রামের নদী, জল, প্রাকৃতিক সম্পদে তার অধিকার। খনি সংস্থার হাতে উৎখাত হওয়া নয়। গিয়ে দেখুন, যে কাশ্মীরি ছেলেটি শহরে নতুন এসেছে, এবং সবাই তাকে আড়চোখে সন্ত্রাসবাদী ঠাওরাচ্ছে, সে কী চায়? স্বাধীনতা না সমান অধিকার?” বলতে বলতে ছক্কা মারলেন তিনি, “স্বাধীনতা ভাল, যদি সেটি এই ভাবে লনে বসে আপনার উপভোগের ক্ষমতা থাকে। স্বাধীনতা আসলে এলিটিস্ট ধারণা। ওটি উপভোগ করার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড দরকার। এ দেশে সেই সমান জমি তৈরি হয়নি। মার্সিডিজ বেঞ্জ আর গরুর গাড়িকে পাশাপাশি একই ভাবে ছুটতে বলা হচ্ছে।” সমান অধিকারের জমি না থাকলে, একই গণতন্ত্রে যে অনেক ‘ভারত বনাম ইন্ডিয়া’ তৈরি হবে, মনে করিয়ে দিলেন রাজদীপ।
স্বাধীনতাই যে বেশি জরুরি, প্রস্তাবের পক্ষে প্রথমে বলতে উঠেছিলেন কুণাল বসু এবং সুমন মুখোপাধ্যায়। ‘কাঙাল মালসাট’ নিয়ে সেন্সর-অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন সুমন। কলকাতার সেন্সর বোর্ড তাঁকে ছবিটি বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে বলে কিছু দৃশ্য এবং গালিগালাজ এডিট করতে বলেছে। দিল্লির ট্রাইব্যুনাল উল্টো বলেছে প্রাক্তন বাম সরকারের বিরুদ্ধে এত কথা না বললেই হত! এই যদি অবস্থা হয়, শিল্পী কোথায় দাঁড়াবেন? সোভিয়েত জমানায় মেয়ারহোল্ড, আন্না আখতামোভার মতো শিল্পীর হেনস্থার কথা টানলেন তিনি, স্বাধীনতাই বেঁচে থাকার প্রথম শর্ত।
সুমন স্বাধীনতার সমর্থনে সোভিয়েত জমানাকে টেনেছেন, আর তাঁর টিমমেট রবিশঙ্কর প্রসাদ নিয়ে এসেছেন জরুরি অবস্থার কথা। “ভারতের জনগণ বারংবার এই বিতর্কের রায় দিয়েছে, ব্যালট বাক্সে বুঝিয়ে দিয়েছে, স্বাধীনতা না সমান অধিকার কোনটাকে আগে চায় তারা।
স্বাধীনতাই গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ইঞ্জিন,” বলেছেন তিনি।
রাজদীপের প্যাশনপ্রাণিত বক্তব্যের পর শনিবার টেলিগ্রাফ বিতর্কের স্কোরবোর্ড দ্বিতীয় উজ্জ্বলতম এখানেই। রবিশঙ্কর প্রসাদ বনাম সৌগত। রাজদীপকে ঠুকে রবিশঙ্কর বলেছিলেন, “সমান অধিকার বড় কথা নয়। ৬০০টা চ্যানেলের মধ্যে লোকে রাজদীপের চ্যানেল দেখে কেন? বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা আছে, তাই।”
প্রত্যুত্তরে সৌগত: “৬০০টা চ্যানেল? ক’টা গ্রামে বিদ্যুৎ গিয়েছে? সংবিধানের ৯০ নম্বর ধারায় বাক্স্বাধীনতা, নাগরিকদের দেশের যে কোনও জায়গায় জায়গায় যাওয়ার স্বাধীনতা আছে। সুবিচার পাওয়ার স্বাধীনতা আছে। গ্রামের কোন গরিব মানুষ হাইকোর্টে মামলা করতে আসে?” প্রায় ফেডেরার বনাম নাদাল স্টাইলে বিতর্ক জমে গেল।
তারও আগে সৌগতর পাশে বসে সমান অধিকারের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন মহম্মদ সেলিম, “আদিম সমাজে সকলের সমান অধিকার ছিল, কিন্তু তার পর স্বাধীনতার নাম করে অন্যরা বেশি অধিকার ছিনিয়ে নেয়।’’ মার্ক্সীয় বিশ্লেষণের পরই তাঁর বক্তব্য, “গণতন্ত্র মানে শুধু ভোট দেওয়া নয়। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সকলের যোগদান, সকলের সমান সুযোগের অধিকার। সুযোগের অধিকার ছাড়া স্বাধীনতা সারবত্তাহীন।”
সবার শেষে মাঠে নামলেন সলমন খুরশিদ, ‘‘সংবিধান প্রতিটি স্বাধীনতাকে সময়বিশেষে নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছে। বাক্স্বাধীনতার অধিকার, ভোটদানের অধিকার সব কিছুই।
কিন্তু সমান অধিকারকে নিয়ন্ত্রণের কথা এক বারও বলেনি। সমান অধিকারই স্বাধীনতা উপভোগের প্রাথমিক শর্ত।’’
এ ভাবেই স্বাধীনতা বনাম সমান অধিকার বিতর্কে স্বাধীনতা হেরেছে। হেরেছে সুদূর বস্টনে নাইজেরীয় সাহিত্যের পথিকৃৎ চিনুয়া আচেবের মৃত্যুর পরদিন। ব্রিটিশ উপনিবেশের হাত থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার দেড় দশকের মধ্যে নাইজেরিয়ায় শুরু হয়েছিল গৃহযুদ্ধ। সংখ্যাগুরু হওয়া সত্ত্বেও ইগবো জনজাতির সেখানে সমান অধিকার ছিল না। মাত্র তিন বছরের জন্য নাইজেরিয়ার মাটিতে তৈরি হয়েছিল স্বীকৃতিহীন এক দেশ... বায়াফ্রা। স্বাধীনতা এবং সমান অধিকারের সেই কথাই তো বারংবার লিখে গিয়েছিলেন চিনুয়া। দু’টোই পরস্পরের পরিপূরক।
সম্ভবত বিতর্কের আসর ছাড়া বাস্তব দুনিয়ায় দু’টোর মধ্যে কোনও ‘বনাম’ নেই। |