নতুন টার্মিনাল পুরো চালু হওয়ার পর কার্যত দশ দিনও কাটেনি। এর মধ্যেই ঝকঝকে, সুদৃশ্য কাচের দেওয়াল থেকে ভেঙে পড়ে যাচ্ছে কাচ। এই ক’দিনে মোট ছ’বার কাচ খুলে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। সৌভাগ্যবশত, এখনও পর্যন্ত কেউ জখম হননি। তবে এ ভাবে চলতে থাকলে যে কোনও সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে বলে মনে করছেন বিমানবন্দরে কর্মরত বিভিন্ন বিমানসংস্থার কর্মীরা। কলকাতার নতুন টার্মিনাল এই মূহূর্তে যে কয়েকটি সমস্যায় জর্জরিত, তার মধ্যে কাচ খুলে পড়ার সমস্যাটিকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন তাঁরা।
প্রথমত, ভেঙে পড়া কাচ থেকে যে কোনও দিন যে কোনও কর্মী, বা যাত্রী গুরুতর আহত হতে পারেন! দ্বিতীয়ত, এই ভাবে একের পর এক কাচ খসে পড়ে গেলে এই গরমে ভিতরে শীতাতপ ব্যবস্থা খারাপ হয়ে যেতে পারে। এ ছাড়া, যদি দেখা যায় কাচ লাগানোর পদ্ধতি ভুল ছিল, তা হলে প্রচুর টাকা খরচ করে নতুন করে লাগাতে হবে সেই কাচ। তার জন্য নতুন টার্মিনাল বন্ধও করে দেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। |
এই পরিস্থিতিতে কলকাতা বিমানবন্দরের অধিকর্তা বি পি শর্মা আশ্বাস দিয়েছেন, কয়েকটি কাচ ভেঙে পড়লেও তা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। তাঁর কথায়, “গাড়ির সামনের কাচে আঘাত লাগলে যে ভাবে সেটা চুর চুর হয়ে ভেঙে পড়ে, সেই ভাবে বিমানবন্দরের কাচও ভেঙে পড়ার সময়ে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। ফলে, তা কারও মাথায় পড়লেও গুরুতর আঘাত লাগার কথা নয়।” তাঁর মতে, টার্মিনাল চালু হওয়ার আগে নিরাপত্তা নিয়ে সমীক্ষা করা হয়েছে। কাচ নিয়ে বড় কোনও গলদের কথা চোখে পড়েনি।
তবু আশ্বস্ত হতে পারছেন না বিমানসংস্থার কর্মীরা। ১১ মার্চ থেকে শুরু হয়েছে নতুন টার্মিনাল থেকে নিয়মিত উড়ান পরিষেবা। এ পর্যন্ত যে ছ’টি কাচ ভেঙে পড়েছে তার মধ্যে একটি অ্যারোব্রিজের দেওয়ালের কাচ ভেঙেছে ১৯ মার্চ। ২০ মার্চ সকালে ১১ নম্বর বোর্ডিং গেট-এর কাছে প্রায় কুড়ি ফুট উপর থেকে একটি কাচ ভেঙে পড়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে বিমানবন্দরের ৩ এবং ৪এ-বি গেটের সামনে থেকে দু’টি বড় কাচ ভেঙে পড়েছে। এই দু’টি গেট দিয়ে বিমানবন্দরে ঢোকার কথা যাত্রী ও বিমানসংস্থার কর্মীদের। কিন্তু, বৃহস্পতিবার কাচ ভেঙে পড়ার সময়ে ওই দু’টি গেটের কাছে কোনও যাত্রী ছিলেন না বলে বেঁচে গিয়েছেন।
এক বিমানসংস্থার কর্মীর কথায়, “যতবার এয়ার সাইড-এ (বিমান যেখানে দাঁড়ায়, সে দিকটিকে বিমানবন্দরের ভাষায় ‘এয়ার সাইড’ বলে) কাচ ভেঙে পড়েছে, ভাগ্যক্রমে কোনওবার সেখানে কেউ ছিলেন না। কিন্তু, কাচ ভেঙে যে এলাকায় গিয়ে পড়ছে, সেখান দিয়ে আমাদের কর্মীরা নিত্য যাতায়াত করেন। এমনকী, যখন বাসে করে যাত্রীদের বিমানে পৌঁছে দেওয়া হয়, তখন যাত্রীরা ওই এলাকা দিয়ে হেঁটে গিয়ে বাসে ওঠেন।”
কেন ভাঙছে কাচ?
দিল্লির যে সংস্থা এই কাচ লাগিয়েছে, তার প্রকল্প-ম্যানেজার প্রকাশ কুলাপ্পার কথায়, “বড় এই ধরনের প্রকল্প বানানোর সময়ে কিছু কাচ ভেঙে পড়তেই পারে। তৈরির সময়েও ভেঙেছে।” কিন্তু, দশ দিনের ব্যবধানে ছ’টি কাচ ভাঙার কোনও পরিষ্কার যুক্তি তিনি দেখাতে পারেননি। বৃহস্পতিবার দুপুরে ফোনে কুলাপ্পা বলেন, “পরপর কাচ ভেঙে যাওয়ার কারণ আমরা খতিয়ে দেখছি। এখনই স্পষ্ট করে কারণ বলা সম্ভব নয়।”
কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?
শিবপুর বি ই কলেজের প্রাক্তনী, পেশাদার স্থপতি মলয় ঘোষ বলছেন, প্রধানত তিনটি কারণ হতে পারে। এক, প্রবল হাওয়া। কিন্তু গত কয়েকদিনে শহরে তত হাওয়া ছিল না। দুই, তাপমাত্রার প্রবল হেরফের। অর্থাৎ বাইরে বেশ গরম আর ভিতরে বেশ ঠাণ্ডা। বিমানবন্দরের ভিতরে সাধারণত বেশ ঠাণ্ডা থাকে। এখন বাইরের তাপমাত্রা বাড়ছে। কিন্তু, এই ধরনের বড় প্রকল্প তৈরির সময়ে তাপমাত্রার হেরফেরের এই বিষয়গুলি বিবেচনা করা হয়। তিন, স্টিলের ফ্রেমে কাচ লাগানোর সময়ে সামান্য উপর-নীচ হয়ে গেলে চাপ পড়ে ভেঙে যেতে পারে কাচ।
মলয়বাবুর কথায়, “দু’টি কাচ জোড়া লাগিয়ে একটি কাচ তৈরি করা হয়। মাঝে থাকে ল্যামিনেশন। সেই ল্যামিনেশনের জন্য কাচ ভেঙে গেলেও তা নীচে পড়ে যাওয়ার কথা নয়। কারণ, ল্যামিনেশন ভেঙে যাওয়া কাচকেও ধরে রাখে। এ ক্ষেত্রে কাচ ভেঙে নীচে পড়ে যাওয়ার অর্থ, ল্যামিনেশনের সমস্যাও থাকতে পারে।” বিশেষজ্ঞ এই স্থপতির ধারণা, কাচ নির্মাণেও ত্রুটি হয়ে থাকতে পারে। তবে, নতুন টার্মিনালে যত কাচ লাগানো হয়েছে সব কাচের ক্ষেত্রেই সেই ত্রুটি নাও হতে পারে। তাঁর কথায়, সম্ভবত কিছু কাচের ক্ষেত্রে সেই ত্রুটি হয়েছে এবং কাচগুলি যেখানে যেখানে লাগানো হয়েছে, সেখান থেকে একের পর এক তা খসে পড়ছে। |