কাউন্সিলরের স্বামীকেই দুষছে এলাকা
দ্রুত জল বৃদ্ধার বাড়িতে, নির্দেশ মেয়রের
ক বছরে শুধু এক বার জলের মিস্ত্রি পাঠিয়ে দায় সেরেছিল কলকাতা পুরসভা। তোলাবাজদের দাপটে পুরসভার মিস্ত্রি আর যাননি মুচিপাড়ার দু’নম্বর গোবিন্দ সরকার লেনে মিনতি ঘোষের বাড়িতে। জল না-থাকায় বাড়িতে নরকযন্ত্রণা ভোগ করছিলেন বৃদ্ধা। কলকাতা হাইকোর্টের কড়া মন্তব্যের জেরে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় নির্দেশ দিলেন, ওই বাড়িতে জলের লাইন সংযোগের কাজ দ্রুত শেষ করতে হবে।
পুরসভার মিস্ত্রি গত বছর ১৪ মার্চ মিনতিদেবীর বাড়িতে জলের লাইন দিতে গিয়েছিলেন। বৃদ্ধার অভিযোগ, খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করতেই শাসক দলের আশ্রিত যুবকেরা লাইন বসানোর জন্য বৃদ্ধার কাছে ১০ হাজার টাকা দাবি করে। তার পরে গত এক বছর ধরে তোলাবাজদের শাসানির কথা জানাতে পুরসভা, পুলিশ ও স্থানীয় তৃণমূল কাউন্সিলরের দরজায় দরজায় ঘুরেছে মিনতিদেবীর পরিবার। কোনও কাজ না-হওয়ায় অসহায় বৃদ্ধা হাইকোর্টের দারস্থ হন। বুধবার সব শুনে বিস্মিত আদালত ক্ষোভ প্রকাশ করে। কঠোর ভাষায় প্রশাসনের সমালোচনা করেন বিচারপতি জয়ন্ত বিশ্বাস।
মিনতি ঘোষ
আদালত ভর্ৎসনা করায় রাত পোহাতেই ছবিটা বদলে গেল। বৃহস্পতিবার স্থানীয় ৫১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর, তৃণমূলের সঞ্চিতা মণ্ডলকে ডেকে ওই বৃদ্ধার বাড়িতে জলের লাইন বসানোর ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন মেয়র। সঞ্চিতাদেবী কথা বলেন পুরসভার জল সরবরাহ বিভাগের স্থানীয় এগ্জিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে। পরে তিনি বলেন, “দু’-এক দিনের মধ্যেই ব্যবস্থা করে দেব। যদি বাধা আসে, পুলিশের সাহায্য নেব।”
ভুক্তভোগী মিনতিদেবীরা অবশ্য কাউন্সিলরের এ-হেন মন্তব্যে আশ্বস্ত হতে পারছেন না। তাঁদের অভিযোগ, তাঁরা তো গত এক বছরে ওই কাউন্সিলরের কাছেই বারবার গিয়েছেন। কাউন্সিলর প্রতি বারেই তাঁদের জানিয়ে দেন, তাঁর কিছু করার নেই। যারা (তোলাবাজ) এসেছিল, তাদের সঙ্গেই বুঝে নিতে হবে।
মিনতিদেবীর বাড়িতে জলের লাইন বসাতে বাধা দেওয়ার ঘটনা আদালতের দৌলতে প্রকাশ্যে এসেছে ঠিকই। কিন্তু তাতে তাঁদের দৈনন্দিন ভোগান্তি কমবে কি না, সেই ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছেন না ৫১ নম্বর ওয়ার্ডে মিনতিদেবীর অধিকাংশ প্রতিবেশী। বাড়ির সামান্য মেরামতি থেকে শুরু করে ছাদের টালি কিংবা অ্যাসবেস্টস বদলাতেও এলাকার দাদাদের ‘প্রণামী’ দিতে হয়। না-দিলে বন্ধ হয়ে যায় কাজ। মিনতিদেবীর পরিণতি দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন এলাকার অনেকেই। তাঁদের অভিযোগ, শাসক দলের মদতে পুষ্ট দাদাদের বিরুদ্ধে মুখ খোলা মানেই একঘরে হয়ে পড়া কিংবা নির্যাতন ভোগ করা। এক বছর ধরে বারবার যাঁর কাছে ছুটে গিয়েছেন মিনতিদেবী, সেই কাউন্সিলর সঞ্চিতাদেবী এবং তাঁর স্বামী দেবাশিস দত্তের দিকেই কিন্তু অভিযোগের আঙুল তুলছেন বহু এলাকাবাসী।
অভিযোগ অস্বীকার করেছেন কাউন্সিলর এবং তাঁর স্বামী। সঞ্চিতাদেবী বলেন, “মিনতিদেবীর বাড়িতে জলের লাইন বসানো নিয়ে সমস্যার কথা শুনেছিলাম। কাজ বন্ধ হয়ে গিয়েছে, সেই খবরও পেয়েছি। কিন্তু কেউ টাকা চেয়ে কাজ বন্ধ করে দিয়েছে, এমনটা শুনিনি। কেউ আমাকে লিখিত অভিযোগও জানায়নি।” আর তাঁর স্বামী দেবাশিসবাবুর দাবি, গত কয়েক মাসে ৫১ নম্বর ওয়ার্ডে জলের লাইন বসানোর প্রচুর কাজ হয়েছে। নতুন লাইন বসাতে পুরসভা ছাড়া আর কাউকে টাকা দিতে হয়নি। বাড়ি মেরামতি বা নতুন বাড়ি তৈরির ক্ষেত্রে তোলাবাজির অভিযোগও অসত্য।
সঞ্চিতাদেবী ও দেবাশিসবাবুদের পাল্টা অভিযোগ, ওই বাড়ির অন্য অংশের বাসিন্দা, মিনতিদেবীর দাদার পরিবারের আপত্তিতেই কাজ বন্ধ হয়েছে। এটা তোলাবাজির কোনও ঘটনাই নয়। মিনতিদেবীর পরিবার কাউন্সিলর ও তাঁর স্বামীর বক্তব্য মানতে নারাজ। তাঁর বড় ছেলে দীপঙ্কর দত্ত বলেন, “পুরসভা থেকে যে-দিন কাজ করতে আসে, আমার মামার পরিবার কোনও আপত্তি তোলেনি। সে-দিন বাধা দিয়েছিল তৃণমূলের ছেলেরাই। মলয় দে, মলয় ঘোষ এবং হাবুল দে নামে তিন যুবক সামনে দাঁড়িয়ে থেকে কাজ বন্ধ করে দেয়। ওদের নেতৃত্বেই ১০ হাজার টাকা দাবি করা হয়।” দীপঙ্করবাবু জানান, এই নিয়ে মুচিপাড়া থানায় যে-অভিযোগ করা হয়েছিল, তাতেও নামগুলি দেওয়া হয়েছে।
কাউন্সিলরের বক্তব্য মানতে চাননি মিনতিদেবীর দাদা, প্রয়াত জয়ন্ত ঘোষের স্ত্রী বিজলিদেবীও। তিনি বলেন, “ওঁদের জলের লাইন দেওয়ার দিন আমরা আপত্তি করিনি। তখন আমার স্বামীর ক্যানসার ধরা পড়ে। তা নিয়েই চিন্তায় ছিলাম। ও-সব নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় ছিল না। পরেও আপত্তি করিনি। ওরা বেশি জল পেলে, আমাদের কী বলার আছে? শুনেছি, পাড়ার কিছু ছেলে ঝামেলা করেছিল।”
কী বলছেন পুরসভার সেই মিস্ত্রি? পুরসভার মিস্ত্রি বিজয়কুমার মল্লিক এ দিন বলেন, “আমার লোকজন সে-দিন জলের লাইন বসাচ্ছিল। খোঁড়াখুঁড়ির কাজ হয়ে গিয়েছিল। সেই সময় পাড়ার কিছু লোক কাজ করতে বারণ করে এবং আমাদের চলে যেতে বলে। বাধ্য হয়েই আমরা কাজ বন্ধ করে দিই। তার পরে কী হয়েছে, জানি না।”
উজ্জ্বল দাস নামে স্থানীয় এক বাসিন্দাও তোলাবাজি নিয়ে শাসক দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, “কাউন্সিলর ও তাঁর স্বামীর মদতে পাড়ার এক দল যুবক এলাকায় তোলাবাজি চালাচ্ছে। দাপট চালাচ্ছে। আমাদের কাছে আদালতের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও বাড়ির ভাড়াটিয়া উচ্ছেদ করতে পারছি না। যুবকেরা শাসিয়েছে, উচ্ছেদ-ফুচ্ছেদ করা যাবে না। এখন নিজেদের বাড়িতে আমাদেরই ভাড়াটিয়ার মতো থাকতে হয়।” উজ্জ্বলবাবুর আরও অভিযোগ, এলাকার বাসিন্দারা বিভিন্ন কারণে মুচিপাড়া থানায় অভিযোগ করেছেন। কিন্তু কোনও ফল হয়ি। ওই থানার ওসি বলছেন, “মাসখানেক হল দায়িত্ব নিয়েছি। তাই পুরনো অভিযোগের কথা জানি না। তবে সব অভিযোগই খতিয়ে দেখা হবে।”
কাউন্সিলরের স্বামীর দিকেই আঙুল তুলছেন এলাকার লোকজন। খুনের অভিযোগে অভিযুক্ত ৫৮ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর শম্ভু কাও-এর মতো সঞ্চিতাদেবীর স্বামী দেবাশিসবাবুও তৃণমূলের এক রাজ্য স্তরের শীর্ষ নেতার ঘনিষ্ঠ বলে জানান ওই ওয়ার্ডের তৃণমূলকর্মীদের একটি বড় অংশ। শম্ভুবাবুর সঙ্গে নানা বিষয়েই দেবাশিসবাবুর মিল খুঁজে পাচ্ছেন তাঁরা। দলের ওই অংশটি চান, বড় অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে যাওয়ার আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবিলম্বে এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করুন।

পুরনো খবর:
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.