সঞ্জয় দত্ত দোষী। এ নিয়ে যদি কারও মনে এতটুকু সন্দেহ থেকেও থাকত, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরে আর তার জো রইল না। কিন্তু মুম্বই বিস্ফোরণের ষড়যন্ত্রে সঞ্জয়ের কোনও ভূমিকা ছিল না। তাঁকে কোনও ভাবে রাষ্ট্রদ্রোহীও বলা চলে না। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেককেই এ নিয়ে ঝড় তুলতে দেখছি। সঞ্জয়ের দোষ বলতে নিজের কাছে বেআইনি অস্ত্র রাখা। তার থেকেও যেটা খারাপ, ও সত্যিটাকে চাপা দিতে চেয়েছিল। বন্ধুকে প্রমাণ লোপাট করতে বলেছিল। এই মূর্খামির (অপরাধও বলতে পারেন, যদি চান) জন্যই ওর পাঁচ বছরের জেল হল।
১৮ মাস জেল ও আগেই খেটেছে। অনেক বছর পরে এ বার বাকি ৪২ মাসের মেয়াদ খাটতে যে সঞ্জয় জেলে ফিরবে, সে আগের চেয়ে অনেক পরিণত, প্রাজ্ঞ।
সঞ্জয়ের জন্য সত্যিই খারাপ লাগছে। হ্যাঁ, ও আমার বন্ধু। ওর বাবা সুনীলও আমার বন্ধুই ছিলেন। আগাগোড়া স্বচ্ছ ভাবমূর্তির মানুষ, রাজনীতির মারপ্যাঁচ কষতে জানতেন না। সঞ্জয় আটক হওয়ার পর, সবাই সেটাকে হাতিয়ার করে কংগ্রেসে সুনীলকে কোণঠাসা করে দিতে নামল। মনে আছে, সেই সময় সুনীল আমাকে ওঁর একটা জনসভায় ভাষণ দিতে ডেকেছিলেন। আমি গিয়েছিলাম। এও স্বীকার করছি, সঞ্জয়ের বিচার যাতে তার নির্দিষ্ট অপরাধের জন্যই হয়, সে জন্য জোরদার প্রচারও চালিয়েছিলাম। আমি চাইনি সঞ্জয়কে টাডায় ধরা হোক। কারণ টাডা মানেই নানা কাল্পনিক অপরাধের সঙ্গে নাম জড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। সে সময় তখন এক দল মানুষ গলা ফাটাচ্ছিল, সঞ্জয়কে দেশদ্রোহী হিসেবে বিচার করা হোক। বাকিরা চাইছিল, মুম্বই বিস্ফোরণের চক্রী হিসেবে ওর শাস্তি হোক। আসলে যখনই ওই রকম ভয়ানক কোনও ঘটনা ঘটে, লোকে তখন যেনতেন প্রকারেণ একটা ভিলেন খাড়া করতে চায়। একটা চেনাজানা মুখ, যার উপরে সব দোষ চাপিয়ে দেওয়া যাবে। ওই মুহূর্তে সঞ্জয় ছিল সেই আদর্শ ‘খলনায়ক’। ক্ষিপ্ত জনতার একটা অংশের কাছে সঞ্জয় তখন সন্ত্রাসবাদী। ওর বাবা সুনীল দত্ত যে কংগ্রেসের নেতা এবং বিরল রকমের সৎ এক জন মানুষ, তাতে ওর এক ফোঁটাও সুবিধে হয়নি। এমনকী লোকজন এও ভাবছিল যে, হয়তো সঞ্জয়ের অপরাধ আড়াল করা হবে।
আমি কংগ্রেস সমর্থক নই। কোনও কালে ছিলাম না। আমি রাজ্যসভায় গিয়েছিলাম শিবসেনার কিছু বাড়তি ভোটের কল্যাণে। বিজেপি আমাকে সমর্থন করেছিল। এ রকম নির্বাচন সচরাচর দেখা যায় না। রাজ্যসভার সাংসদদের নির্বাচনে সাধারণত তেমন একটা জটিলতা পোয়াতে হয় না। আমি কিন্তু আক্ষরিক অর্থেই লড়াই করে আমার আসনটা জিতেছিলাম। সনিয়া গাঁধীর প্রার্থী রাম প্রধান হেরে যান। শিবসেনার মূল প্রার্থী, সতীশ প্রধান খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে জিতেছিলেন। এই রকম অবস্থায় সঞ্জয়ের হয়ে কথা বলাটা আমার পক্ষে যথেষ্ট ঝুঁকির ব্যাপার ছিল। রাজনৈতিক ভাবে আমার দিকে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা তো বটেই। বিরোধীদের অনেকেও এতে খুশি হননি। কিন্তু সঞ্জয় যে রাষ্ট্রদ্রোহী, তার কোনও প্রমাণ ছিল না। বিস্ফোরণে ওর হাত ছিল, এমনও নয়। ও ছিল নেহাতই বদ-সঙ্গে পড়া এক নির্বোধ যুবক, যে একটা লাইসেন্সবিহীন আগ্নেয়াস্ত্র রেখেছিল। আরও বড় বুদ্ধুর মতো তার প্রমাণ লোপাট করতে গিয়েছিল। এবং এই জাতীয় সব বুদ্ধুদের মতোই ধরাও পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু ওর বিরুদ্ধে সে সময় একটা গণ-হিস্টিরিয়া শুরু হয়ে যায়। তার একটা উদ্দেশ্য যদি হয়, কোনও একটা মুখ খুঁজে নিয়ে তার উপরে পুরো স্পটলাইট এনে ফেলা। তা হলে আসল অপরাধীরা গর্তে মুখ লুকোনোর সুবিধা পায়। দ্বিতীয় উদ্দেশ্যটা অবশ্যই ছিল, সুনীল দত্ত তথা কংগ্রেসকে বিব্রত করা (বাস্তবিকই ওঁরা এত লজ্জিত ছিলেন যে সঞ্জয়কে বাঁচাতে কিছুই করেননি)। আমার প্রচারটা কিন্তু কাজে লেগেছিল। ১৮ মাসের বন্দিদশার পরে সঞ্জয় জামিন পায়। জেলে আমি ওর সঙ্গে দেখাও করেছিলাম। একটা অস্থিচর্মসার, ভেঙে পড়া মানুষ। সঙ্গী বলতে ছিল একটা চড়াই পাখি। তার সঙ্গেই ও বন্ধুত্ব পাতিয়েছিল। আর ছিল ওর ওয়ার্ক আউটের নেশা। কিন্তু জঙ্গি তকমাটা ওকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। সঞ্জয় মনে করত, ও ওর বাবার মাথা হেঁট করেছে। বাবার রাজনৈতিক কেরিয়ার ধ্বংস করে দিয়েছে (সেটা সত্যিই)। এই জটিলতা থেকে বেরনোর কোনও পথ ও খুঁজে পেত না। আমি ওকে খুব সহজ একটা উপদেশ দিয়েছিলাম। সত্যের সঙ্গে থাকো আর তার পরিণতির মোকাবিলা করো। এক সময় হিস্টিরিয়া মরে যাবে, রাজনীতি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে এবং ন্যায়বিচারই রয়ে যাবে। ঠিক সেটাই ঘটল। আর যাই হোক না কেন, পাঁচ বছরের এই সাজা সঞ্জয়ের বিরুদ্ধে অন্যান্য ঘৃণ্য অভিযোগে কিন্তু দাঁড়ি টানল।
তবু ভাবতে খারাপ লাগছে, এক জন মানুষ ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়েছিল, নতুন করে কেরিয়ারটা তৈরি করেছিল। এখন আবার তাকে ৪২ মাসের জন্য গরাদের ও-পারে যেতে হচ্ছে। বিখ্যাত হওয়ার এটাই ঝুঁকি। প্রতিটা বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর সফ্ট টার্গেট হয়ে যেতে হয়। একটা ছোট্ট ভুলও অতিকায় দেখায়। বিচার-বিবেচনায় সামান্য ত্রুটিও অমার্জনীয় অপরাধ মানা হয়। নিজেকে বাঁচানোর প্রতিটা চেষ্টা ক্ষমতা আর অর্থের অপব্যবহার বলে দেখা হয়। চিত্রতারকারা আসলে কার্ডবোর্ডের কাট আউটের মতোই। লার্জার দ্যান লাইফ, কিন্তু বড় ভঙ্গুর। আমরা তাদের ভালবাসি। আবার প্রায় সমান পরিমাণে ঘৃণা করি, হিংসে করি। সব সময় চাই, ওরা চুলোয় যাক! সঞ্জয়ের মতো কেউ তাই যায়ও। আমার, আপনার মতো ওরাও ভুল করে। কিন্তু সেই ভুলগুলো অনেক বড় ফ্রেমে দেখানো হয়। এতটাই বড় যে, ছবিটাই ভেঙে যায়। এটাই তাদের ট্র্যাজেডি। এতটাই গ্রিক, যে তার মাহাত্ম্যটাও চোখে পড়ে না। |