প্রেমাংশু চৌধুরী • নয়াদিল্লি |
সাবধানে চলাফেরা করতে হচ্ছে। নজর রাখছে জামাতি খুনেরা। সাহসী কণ্ঠ তবু বলছে, “ক’জনকে মারবে ওরা? আমাকে মারতে হলে দশ হাজার ব্লগারকে মারতে হবে!”
এখানেই বোধহয় অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট, তাহরির স্কোয়ার বা দিল্লির গণধর্ষণের বিরুদ্ধে নাগরিক আন্দোলনের সঙ্গে শাহবাগের পার্থক্য। ফেসবুক-টুইটার-ব্লগে প্রতিবাদ করার অপরাধে কাউকে খুন হতে হয়নি ওই সমস্ত আন্দোলনে। বাধা বলতে শুধুই পুলিশ, কাঁদানে গ্যাস বা জলকামান। কিন্তু শাহবাগে প্রতি মুহূর্তে জামাতের চোরাগোপ্তা হামলার ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় নামতে হয়।
তবু প্রাণের ঝুঁকি নিয়েই ‘প্রজন্ম চত্বর’-এ আন্দোলন করছেন হাজার-হাজার তরুণ-তরুণী। দিল্লিতে সেই গল্পই শোনাতে এসেছিলেন ঢাকার আজিজা আহমেদ পলা। শাহবাগের অন্যতম আন্দোলনকারী।
|
আজিজা আহমেদ পলা |
ওয়াল স্ট্রিট, তাহরির স্কোয়ার, দিল্লির আন্দোলন অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে পলাদের। প্রত্যেকটি আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি নিয়ে ভাবনাচিন্তা করে সেই অনুযায়ী রণকৌশল ঠিক করেছেন। সলতে পাকানো চলছিল গত ছয় বছর ধরেই। কিন্তু টুইটার-ব্লগের মতো সোশ্যাল মিডিয়া থেকে আন্দোলনের সূত্রপাত আগে দেখেনি বাংলাদেশ। শুরুটা যাঁরা করেছিলেন, তাঁরাও ভাবেননি এই ভাবে নেট-সমাজের হাত ধরেই ছড়িয়ে পড়বে আন্দোলন। তবু এখন প্রতি দিনই নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে শাহবাগে জড়ো হওয়া বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম। কিছু দিন আগেই জামাতের হামলায় ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারের মৃত্যু হয়েছে। এর পর থেকে প্রাণের ঝুঁকি আরও বেড়েছে। ব্যক্তিগত নিরাপত্তার বন্দোবস্ত করতে হয়েছে। কিন্তু তা বলে কেউ শাহবাগে আসা বন্ধ করেননি।
যদিও ইতিমধ্যেই হামলার হুমকির সঙ্গে যোগ হয়েছে অপপ্রচার। পলা জানাচ্ছেন, এখন এই আন্দোলনকে ইসলাম-বিরোধী বলে আখ্যা দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। শাহবাগ বোঝানোর চেষ্টা করছেন, তারা মৌলবাদ-বিরোধী। ইসলাম-বিরোধী নয়। শাহবাগের সঙ্গে নাস্তিকতার কোনও সম্পর্ক নেই।
পলার কথায়, “এখন যে লড়াইটা শাহবাগে, বাংলাদেশের মাঠে-ময়দানে দেখতে পাচ্ছেন, মৌলবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সেই লড়াইটা অনেক দিন ধরেই চলছিল।” যখন থেকে ব্লগিং, ফেসবুক টুইট সংস্কৃতির শুরু। এগুলির মাধ্যমে বাংলাদেশে মৌলবাদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়। একাত্তরের স্বাধীনতার যুদ্ধের জাতীয়তাবোধকেও আবার জাগিয়ে তোলার চেষ্টা শুরু হয়। গত বছর বাংলাদেশের দক্ষিণে রামু-তে বৌদ্ধ বিহারে ভাঙচুর চালায় মৌলবাদীরা। প্রতিবাদ হয় তার বিরুদ্ধে।
স্বাধীনতা-যুদ্ধের ২২ বছর পরেও এত জাতীয়তাবাদী আবেগ! এর উৎসটা কী? পলা নিজে স্বাধীনতা-যোদ্ধা পরিবারের মেয়ে। তাঁর ব্যাখ্যা, স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশের আর্থিক উন্নয়ন হয়েছে। আর্থিক সমৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মহিলাদের ক্ষমতায়ণ হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়নি। গত ২২ বছর ধরে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির দাবি জানিয়ে এসেছে। এখন তরুণ প্রজন্ম সেই দাবিতে পথে নেমেছে। জামাতের মতো শক্তি দেশের ক্ষমতার কাছাকাছি এলে নারী স্বাধীনতায় আঘাত আসবে, এমন আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে। তা থেকেও প্রাণ পেয়েছে জাতীয়তাবোধ।
কিন্তু জামাত-বিরোধিতার বারুদে আগুনের ফুলকি কোনটা? পলা জানান, নেটের মাধ্যমে জনমত গড়ে তোলার সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগটাও বাড়ছিল ক্রমশ। গত ৫ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির বদলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের শাস্তি ঘোষণার পরে এই ‘অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট’-রা মনস্থির করেন, এ বার সাইবার-দুনিয়া থেকে রাস্তায় নামতে হবে। আন্দোলন এখন এতটাই বড় আকার নিয়েছে, যে সবাইকে দায়িত্ব ভাগ করে নিতে হয়েছে। কেউ কর্মসূচি ঠিক করছেন। কেউ লিখছেন। ব্লগ। কেউ ছবি পোস্ট করছেন। পলার যেমন দায়িত্ব আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যোগ রাখা।
শুধু নিজের কথা নয়। পলা বলছিলেন ইমরান এইচ সরকার, লাকি আখতারের মতো শাহবাগের প্রথম সারিতে থাকা তরুণ-তরুণীদের কথাও। যে কোনও দিন যাঁরা খুন হয়ে যেতে পারেন জামাতের হাতে। ইমরান ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক। ব্লগিং-এর পাশাপাশি নানা জনসেবার কাজে জড়িয়েছিলেন। এখন শাহবাগের পুরোভাগে। শাহবাগের চত্বরে প্রথম মানব-শৃঙ্খলের রচয়িতা। লাকি আখতার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি অনার্সের ছাত্রী। তাঁর কণ্ঠে ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা’ শুনে চাঙ্গা হয় শাহবাগ। উড়িয়ে দেওয়ার সাহস পায় হামলার আশঙ্কা। বড়রা ‘স্লোগান-কন্যা’ বলেন লাকিকে। বাংলাদেশের নানা প্রান্ত থেকে চিঠি আসে তাঁর কাছে।
ঠিকানায় শুধু লেখা থাকে, ‘প্রজন্ম চত্বর’!
|