নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ১১৬ জন জুনিয়র ডাক্তার দল বেঁধে গিয়েছিলেন তাজপুরে পিকনিক করতে। আর ছুটির মজা লুটতে মন্দারমণি গিয়েছিলেন মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ৮০ জন জুনিয়র ডাক্তার। এবং কোনও দলই কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বিধি মেনে ছুটি নেননি। মিল আরও আছে। দু’দলই ওষুধ সংস্থার সৌজন্যে পানভোজন করেছেন বলে অভিযোগ।
হাসপাতাল খালি করে দল বেঁধে বেড়াতে যাওয়া নিয়ে তোলপাড়ের আঁচ পেয়েই নীলরতনের জুনিয়র ডাক্তারেরা সোমবার কাকভোরে তাজপুর থেকে তড়িঘড়ি কলকাতায় ফিরে আসেন। কিন্তু এ দিন সকালে হাসপাতালে কাজে যোগ দিতে দেখা যায়নি তাঁদের অধিকাংশকেই। কেউ দুপুরে ডিউটিতে ঢুকেছেন। বেশির ভাগই রাত জাগার ধকল কাটাতে বিকেল পর্যন্ত পড়ে পড়ে ঘুমিয়েছেন হস্টেলে। ফলে নীলরতনের পরিষেবা স্বাভাবিক হতে বিকেল গড়িয়ে যায়।
রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর এই ঘটনার তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছু হবে কি না, সেই প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন রাজ্যের অন্য একটি হাসপাতালের ৮০ জন জুনিয়র ডাক্তার। রবিবার সন্ধ্যায় নীলরতনের জুনিয়র ডাক্তারদের তাজপুর সফর নিয়ে যখন স্বাস্থ্য দফতরে তোলপাড় চলছে, তখনই দেখা যায়, অদূরে মন্দারমণিতে গিয়ে উঠেছেন মেদিনীপুর হাসপাতালের ৮০ জন জুনিয়র ডাক্তার। |
মেদিনীপুর মেডিক্যালে জুনিয়র ডাক্তারের মোট সংখ্যা ১৬০। তার ৫০ শতাংশ হঠাৎ ছুটি নেওয়ায় সেখানকার রোগীরাও রবিবার সন্ধ্যা থেকে যথাযথ পরিষেবা পাচ্ছেন না। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, নীলরতনের জুনিয়র ডাক্তারদের মতো মেদিনীপুর হাসপাতালের জুনিয়র ডাক্তারদের ওই সফরের টাকা জুগিয়েছে কয়েকটি ওষুধ সংস্থা।
হাসপাতালের পরিষেবা নিয়ে রোগীরা প্রশ্ন তোলার পরেই মেদিনীপুর হাসপাতালের সুপার ও অধ্যক্ষ জানতে পারেন, অর্ধেক জুনিয়র ডাক্তার হঠাৎই ছুটিতে চলে গিয়েছেন। সুপার ও অধ্যক্ষ জানান, তাঁদের কাছ থেকে ছুটি না-নিয়েই জুনিয়র ডাক্তারেরা হাসপাতাল ছেড়েছেন। এখানেও নীলরতনেরই পুনরাবৃত্তি। ওই ৮০ জন জুনিয়র ডাক্তারের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না, মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষের কাছ থেকে তার সদুত্তর মেলেনি। যেমন ছুটি অনুমোদন না-করিয়ে বেড়াতে যাওয়া ১১৬ জন জুনিয়র ডাক্তারের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না, সে ব্যাপারে সোমবারেও নিরুত্তর নীলরতনের অধ্যক্ষ।
নীলরতনের ঘটনা নিয়ে স্বাস্থ্য দফতর সোমবার যখন তদন্তের নির্দেশ দেয়, তখনও পর্যন্ত মেদিনীপুর হাসপাতালের ঘটনা কর্তাদের নজরে আসেনি। স্বাস্থ্য (শিক্ষা) অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, জুনিয়র ডাক্তারেরা কর্তৃপক্ষকে না-জানিয়ে কী ভাবে একসঙ্গে ছুটিতে গেলেন এবং কোনও ওষুধ সংস্থা এর সঙ্গে জড়িত কি না, তা তদন্ত করে দেখা হবে। আগেও এ ব্যাপারে অভিযোগ উঠেছিল। স্বাস্থ্য দফতর সেই অভিযোগের তদন্ত করেছে। কিন্তু কারও বিরুদ্ধেই কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। শুধু সতর্ক করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য (শিক্ষা) অধিকর্তার যুক্তি, ওষুধ সংস্থার সঙ্গে জুনিয়র ডাক্তারদের বেড়াতে যাওয়ার সম্পর্ক নিয়ে আগেও একাধিক বার অভিযোগ উঠেছে। তবে তা প্রমাণ করা কঠিন।
কিন্তু না-জানিয়ে কাজ ছেড়ে যাওয়াটা তো শৃঙ্খলাভঙ্গের সামিল। সেই অপরাধে তাঁদের শাস্তি হবে না কেন, প্রশ্ন উঠেছে চিকিৎসক মহলেই।
নীলরতনের অভিযুক্ত জুনিয়র ডাক্তারেরা যে এ বারেও পার পেয়ে যাবেন, তার ইঙ্গিত মিলেছে কলেজের অধ্যক্ষের বক্তব্যেই। নীলরতনের অধ্যক্ষ শ্রীকান্ত পুরকায়স্থ এ দিন বলেন, “রবিবার অধিকাংশ জুনিয়র ডাক্তারেরই ছুটি থাকে। তাঁরা যদি সে-দিনটা কোথাও বেড়িয়ে আসেন, কারও কোনও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। আপনাদের যা খুশি আপনারা লিখে যাচ্ছেন। আমাদের হাসপাতালে কিন্তু কোনও সমস্যা হয়নি।” হাসপাতালের পরিষেবা স্বাভাবিক আছে বলে দাবি করেছেন মেদিনীপুর মেডিক্যালের অধ্যক্ষ শুদ্ধোদন বটব্যালও। তাঁর দাবি, “কোথাও পরিষেবা ব্যাহত হয়নি। সর্বত্র স্বাভাবিক কাজকর্ম হয়েছে।”
যদিও বাস্তব হল, এ দিন হাসপাতালের বহির্বিভাগ সময়মতো খোলেনি। উপরন্তু ডাক্তারের অভাবে কয়েকটি বিভাগের একাধিক ঘরও দিনভর খোলা হয়নি। জুনিয়র ডাক্তারদের অধিকাংশ কাজে যোগ না-দেওয়ায় এ দিনও স্বাভাবিক হয়নি নীলরতন। ঠিক ছিল, জুনিয়র ডাক্তারেরা রবিবার তাজপুরে রাত কাটিয়ে সোমবার দুপুরে ফিরবেন কলকাতায়। তার বদলে তাঁরা সোমবার কাকভোরেই ফিরে আসেন। রবিবার গভীর রাতেই তাঁদের তাজপুর ছাড়তে হল কেন?
স্থানীয় সূত্রের খবর, সাংবাদিকদের সঙ্গে বিরোধ এবং গ্রামবাসীদের বিক্ষোভের মুখে পড়ে রবিবার রাতের ‘ডিনার পার্টি’ বাতিল করতে হয় জুনিয়র ডাক্তারদের। তাঁদের বিরুদ্ধে একটি বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিকে বেধড়ক মারধর করে ক্যামেরা ও টাকার ব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগও উঠেছে। দীর্ঘ ক্ষণ আটক থাকার পরে বিকেলে ওই সাংবাদিক কোনও রকমে নিজেকে মুক্ত করে রামনগর থানায় গিয়ে অভিযোগ দায়ের করেন। রামনগরের ওসি বিশ্বজিৎ হালদারের নেতৃত্বে পুলিশ তাজপুর যায়। সংবাদিকদের সঙ্গে জুনিয়র ডাক্তারদের বচসায় ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এলাকার বাসিন্দারা। তাঁরা বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন।
পুলিশি সূত্রের খবর, বেগতিক দেখে পরিস্থিতি সামলাতে এগিয়ে আসেন তাজপুর সি কোস্ট হোটেলিয়ার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের এক প্রতিনিধি। তিনিই রামনগর থানার পুলিশের উপস্থিতিতে জুনিয়র ডাক্তারদের কলকাতায় ফেরার ব্যবস্থা করে দেন। পুলিশ ওই ডাক্তারদের বাসকে নিরাপত্তা দিয়ে কিছুটা রাস্তা নিয়ে যায় বলেও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। খুব ভোরে তাজপুর থেকে কলকাতায় ফেরেন নীলরতনের ১১৬ জন জুনিয়র ডাক্তার। তবে তাঁরা বাসগুলিকে হাসপাতাল পর্যন্ত আনেননি। কেউ মৌলালিতে, কেউ বা আরও আগে নেমে হেঁটে হাসপাতালে যান।
ছিনতাই ও নিগ্রহের অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও জুনিয়র ডাক্তারদের নিরাপত্তা দিয়ে পুলিশ অনেকটা রাস্তা পার করে দিল কেন, উঠেছে সেই প্রশ্নও। রামনগর থানার ওসি জানান, পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে। তবে সৈকতে আক্রান্ত সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধির ছিনতাই হওয়া ক্যামেরা ও ব্যাগের হদিস পাওয়া যায়নি। প্রথমে ওই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে জুনিয়র ডাক্তারেরা পাল্টা অভিযোগ করার সিদ্ধান্ত নিলেও পরে চুপচাপ ফিরে যান। যে-সংস্থা তাঁদের তাজপুরে নিয়ে গিয়েছিল, সেই সংস্থার তরফে গৌতম চক্রবর্তী বলেন, “আমরা শুধু খাওয়া আর থাকার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব পেয়েছিলাম।” কারা এই দায়িত্ব দিয়েছিল, পেশাগত কারণ দেখিয়ে তা জানাতে অস্বীকার করেন তিনি। তবে সোমবার দুপুর পর্যন্ত প্রাপ্য টাকা তাঁরা পাননি বলে অভিযোগ গৌতমবাবুর।
|