মনের আনন্দে জঙ্গলে উড়ে-ঘুরে বেড়ানো ময়ূর দেখতে চান? শুনতে চান আকাশ ফাটানো কেকাধ্বনী?
তা হলে বর্ধমানের কাঁকসায় আপনাকে ডাকছে গৌরাঙ্গপুরের দেউলে। সেখানে ইছাই ঘোষের প্রাচীন দেউলকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিশাল অরণ্য।
ঘুম থেকে ভোর-ভোর উঠে চলে যান স্থানীয় রিসর্ট লাগোয়া জঙ্গলে। অনেকগুলি চায়ের দোকান। যে কোনও একটিতে বসে চায়ে চুমুক দিতে দিতে নজর রাখুন গাছপালার দিকে। বলা যায় না, যে কোনও মুহূর্তে দীর্ঘ নীল সবুজ লেজে ঢেউ তুলে বেরিয়ে আসতে পারে কার্তিকবাহন।
শিকার নিষেধ হয়ে গিয়েছে সেই কবেই। শিকার আপনার পছন্দও নয়। সঙ্গে ক্যামেরা থাকলে জুম লেন্সই আপনার একমাত্র হাতিয়ার। ছবি তুলুন প্রাণ ভরে। এক বার ফসকালে চিন্তা নেই। দেউল লাগোয়া কয়েকশো একর জঙ্গলে জোড়ায় জোড়ায় তাদের উপস্থিতি, আনাগোনা, আশনাই।
কী করে এই জঙ্গলে ছড়িয়ে পড়ল এত ময়ূর? |
বন বিভাগের দুর্গাপুর রেঞ্জের ডেপুটি রেঞ্জার জয়নারায়ণ মণ্ডল জানান, ২০০৮ সালে নদিয়া-মুর্শিদাবাদের বেথুয়াডহরি রেঞ্জ থেকে দেউল সংলগ্ন ছড়া হয়েছিল পাঁচ-ছ’টি ময়ূর-ময়ূরী। গোড়ার দিকে বাজপাখির হানা, ছোটখাটো শিকারী জন্তুর হানা থেকে ছানা বাঁচানোর পর্ব সামলে ধীরে-ধীরে বেড়েছে শিখীপাখারা। এই বছরের গোড়ায় অন্তত ৩০-৩২টিকে চিহ্নিত করেছে বনবিভাগ। দেউল আউটপোস্টের মালি মদনমোহন কর্মকারের কথায়, “এ বারই অন্তত চারটি বাচ্চা নিয়ে ময়ূরদের জঙ্গলের ভিতরে হাঁটতে দেখেছি।”
পাল্লা দিয়ে বাড়ছে হরিণেরাও। ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে বর্ধমানের রমনাবাগান অভয়ারণ্য থেকে নিয়ে গিয়ে আট জোড়া হরিণ-হরিণী ছাড়া হয়েছিল দেউল লাগোয়া জঙ্গলের ভিতরে ঘেরা জায়গায়। আসগে হরিণ বাড়ানো না গেলেও এ বারের আট জোড়া বংশবিস্তার করতে শুরু করেছে। জালে ঘেরা দু’টি জায়গায় ৪৭টি চিতল হরিণের বাস। বনবিভাগের হিসেবে, তাদের ঘেরা সাত হেক্টরে ১৭টি ও ২২ হেক্টরে ৩০টি হরিণ রয়েছে।
তবে ময়ূরদের যেমন সহজেই দেখা যায়, হরিণ দেখা তত সহজ নয়। খুব বরাত না থাকলে তাদের মধ্যাহ্নভোজের সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে। বনকর্মীরা যখন তাদের খেতে দেবেন, জড়ো হয়ে আসবে ঝাঁকে-ঝাঁকে হরিণ। আর আপনি দু’চোখ ভরে দেখে যাবেন।
বন বিভাগের রক্ষনাবেক্ষণে থাকা এই জঙ্গলমহলে ধীরে হলেও বেড়ে চলেছে নানা বন্যজন্তু। নেকড়ে, বুনো শুয়োর, খরগোশ, বিভিন্ন ধরনের সাপ তো আছেই। জঙ্গল মাতিয়ে দিচ্ছে নাম না জানা নানা পাখির কূজনও। যখন-তখন মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে টিয়ার ঝাঁক। সব মিলিয়ে একটা মন ভালো করে দেওয়া ব্যাপার।
এমন পাখপাখালিতে ভরা বন তো চোরাশিকারীদের মৃগয়াভূমি হয়ে উঠছে না তো? প্রশ্নটা শুনেই ফোঁস করে উঠলেন স্থানীয় বনরক্ষা কমিটির গৌরাঙ্গপুর গ্রামের সদস্য পল্টন হাঁসদার স্ত্রী নমিতা “এখানে পাখি মেরে বের হতে দিব নাই কাউকে বাবু। আমরা রয়্যেছি কী করতে?”
কথাটা যে কথার কথা নয়, তার প্রমাণ মিলল হাতে-নাতে। বর্ধমান থেকে দেউলে ঘুরতে যাওয়া একটি পরিবারের লোকজন বন বিভাগের দেওয়া কাঁটাতারের গেট টপকাতে যেতেই নিমেষে বদলে গেলেন এত ক্ষণের সদলাপী চায়ের দোকানি। রীতিমতো ধমকের সুরে বললেন, “খবরদার! গেট টপকালে আপনাদের কিন্তু ছাড়ব না!”
এলাকার একটি রিসর্টের অন্যতম পরিচালক অচিন্ত্য সাহা বলেন, “হরিণ-ময়ূর দেখতে প্রায় প্রতি দিনই শতাধিক মানুষ এখানে আসেন। ওদের জন্যেই দোকানপাট-ব্যবসা টিকে রয়েছে। তাই সকলেই বন্যপ্রাণ রক্ষায় সচেতন।”
অরণ্য যদি মানুষের বন্ধু হয়ে ওঠে, তার চেয়ে ভাল আর কীসে? |