এই প্রথম দেশের আইন স্বীকার করল কিশোরকিশোরীদের যৌনচেতনা
থাকতে পারে, এবং তাদের আছে শরীরের অধিকার। লিখছেন
শাশ্বতী ঘোষ |
কতটা বয়স হলে তবে শরীর বোঝা যায়? উত্তরটা সদ্য দিয়েছেন দেশের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা, একটি নতুন আইনের প্রস্তাবনায়। চলতি আইনে কোনও নারী বা পুরুষ ১৮ বছরে পা দিলেই দেশের নাগরিক, সে সুবাদে তাঁদের প্রাপ্তবয়স্ক মনে করা হয়, শরীরের ব্যাপারটা তাঁরা তখন নিজেরাই বুঝে নিতে পারবেন। যদিও আদতে এ দেশে শরীর বোঝার মূল দায়িত্বটা রয়েছে কিছুটা সমাজ আর কিছুটা আদালতের হাতে। এ দেশে শরীরের অধিকার মানে বিয়ে, সেটা ঠিক করে বাবা-মা ও ধর্মীয় সংস্কার বা কানুন। হিন্দু বিবাহ আইনে বিয়ের আইনি বয়স মেয়েদের ১৮, ছেলেদের ২১। অবশ্য যদি তার আগে ধর্মীয় নিয়মে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়, তা হলে বিয়েটা বৈধই থাকে। তবে বালিকা বধূ ১৬ না পেরোলে তার সঙ্গে স্বামীর সহবাসের অধিকার নেই। এই ম্ুহূর্তে এ দেশে যে মেয়েদের বয়স ২০ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে, তাঁদের প্রতি পাঁচ জনে এক জনের বিয়ে হয়েছে পনেরো বছরের আগে, আর প্রতি দু’জনে এক জন মেয়ের বিয়ে হয়েছে ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই, তাঁরা মা হয়ে গেছেন মোটামুটি ভাবে বিয়ের এক বছরের মধ্যেই। আর শরিয়ত অনুযায়ী ঋতুমতী হলেই মেয়েদের বিয়ে হতে পারে। তার মানে তো ঋতুচক্র শুরু হলেই ধরে নেওয়া হচ্ছে তার শরীর সহবাসের জন্য তৈরি। শরীর তাই জিম্মি আছে সমাজ আর ধর্মের গণ্ডিতে। |
প্রশ্নটা নতুন নয়। রাজকপূরের ‘ববি’, ১৯৭৩
|
আমাদের দেশের বিচারব্যবস্থার কাছে মেয়েদের শরীর মানেই শুধু সন্তানধারণ, ফলে সে এত দিন যৌন অপরাধ নিয়েই মাথা ঘামাত, যৌন অধিকার নিয়ে নয় তাই ষোলো বছরের মেয়েকে মা-বাবা ধরে-বেঁধে পঁয়তাল্লিশ বছরের দোজবরে-তেজবরের সঙ্গে বিয়ে দিলেও বিয়েটা বৈধ, কিন্তু সে মেয়ে যদি একটা আঠেরো বছরের ছেলের সঙ্গে পালায়, তা হলে পরিবারের সম্মানরক্ষার জন্য সে ছেলেকে ধর্ষণের অভিযোগে ফাটকে পোরো এই পথ প্রশস্ত করে রেখেছিল আঠারোর সম্মতি।
সাম্প্রতিক বেশ কিছু ঘটনায়, বিশেষত দিল্লির বাসে এক ছাত্রীর গণধর্ষণ ও হত্যার পর যৌননিগ্রহ, ধর্ষণ, নাবালক ধর্ষক এই সব সমস্যার জন্য নতুন আইন প্রণয়নের দাবি জোরালো হয়েছে। এই প্রসঙ্গেই প্রশ্ন উঠছে, কোন বয়সে একটি নারী ও পুরুষ নিজেরাই শারীরিক সম্পর্কের সিদ্ধান্ত নিতে পারে? একটু অন্য ভাবে বললে, কখন এক জন নিজের শরীরের অধিকার নিজেই ব্যক্ত করতে পারেন? একেই বলা হচ্ছে ‘সম্মতির বয়স’, যে বয়সে ছেলেমেয়েরা যৌন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লে তা বেআইনি নয়। নতুন আইন বলছে সম্মতির বয়স বলতে বোঝাবে যদি ১৬ বছরের কোনও মেয়ে কোনও নিকটবয়সি ছেলের সঙ্গে স্বেচ্ছায় শরীরী সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে, তা হলে সেই ছেলেকে মেয়েটির অভিভাবকরা ধর্ষণের অভিযোগে কাঠগড়ায় তুলতে পারবেন না। এ রকম ঘটনা বেশ নিয়মিত ঘটে। সম্মতি না থাকলে তা অবশ্যই ধর্ষণ।
সম্মতির বয়স নতুন কোনও ধারণা নয়। তার মূল উদ্দেশ্য অপ্রাপ্তবয়স্কদের সুরক্ষা। কিশোরকিশোরীরা যদি এ ধরনের কোনও কাজ করে ফেলে, তার জন্য কাউকে অপরাধী না বানিয়ে তাদের বোঝানোর জন্যই সম্মতির বয়স বলে একটি বয়সকে দেশের আইনে নির্দিষ্ট করা হয়। অপরাধী বলে চিহ্নিত করা নয়, প্রয়োজনে তাদের বোঝানো শরীরী সম্পর্ক মানে শুধু মজা করা নয়, পরীক্ষা করা নয়, তার জন্য তৈরি হওয়া দরকার, দরকার এ ধরনের সম্পর্ক থেকে কী কী বিপদ বা দায়িত্ব আসতে পারে, সে সব জানানো। বিশেষত মেয়ে হলে দায়িত্ব বা বিপদ আরও বেশি, সে কথাও জানানো। ব্রিটেন, কানাডা, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়ায় সম্মতির বয়স ১৬, আমেরিকায় রাজ্য ভেদে ১৬-১৮। কিন্তু সে সব দেশে সংশ্লিষ্ট ছেলেটিকেও মেয়েটির বয়সের খুব কাছাকাছি হতে হবে বলছে, অর্থাৎ দু’জনেই সমান অপরিণত। অবশ্য গত নভেম্বরে প্রণীত যৌননিগ্রহ থেকে শিশুদের সুরক্ষা আইনে এই সম্মতির বয়স ষোলো থেকে আঠারো বছর করা হয়েছে। ফলে আইনি জটিলতার আশঙ্কা রয়েই গেল। তবু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে, এই প্রথম দেশের আইন স্বীকার করল কিশোরকিশোরীদের যৌনচেতনা থাকতে পারে, এবং তাদের আছে শরীরের অধিকার।
অনেকের মতে যে দেশে আঠারোর নীচে কেউ প্রাপ্তবয়স্ক বলে গণ্য নয়, ভোট দিতে পারে না, চুক্তি করতে পারে না, আইনমতে বিয়ে করতে পারে না, সে দেশে সম্মতির বয়স ষোলো করা মানে তো তারা যৌনসম্পর্ক স্থাপন করতে পারে বলে ধরেই নেওয়া হচ্ছে, তা কী করে সম্ভব? বাকি অনেকে ভয় পাচ্ছেন এর ফলে সব কিশোর-কিশোরীরাই শরীরী সম্পর্কে মেতে উঠবে। দু’দলের জন্যই একটা জবাব: ধর্ম-বর্ণ, গ্রাম-শহর, নির্বিশেষে সব বিয়েতে পাত্রী আঠারো আর পাত্র একুশ হবে নয়তো বিয়েটাই অবৈধ সরকার এই অবস্থান নিক, কঠোর নজরদারি চালাক, তা কার্যকর করার জন্য। না হলে গোঁড়া অভিভাবক আর খাপ পঞ্চায়েতের হাত শক্ত করার কী প্রয়োজন? |