প্রবন্ধ ১...
তিস্তাকে তিস্তায় ফিরিয়ে দেওয়া হোক
মাত্রই কয়েক মাসের মধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির, মাঝখানে বিদেশমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর শুধুই শুভেচ্ছা-সফর হতে পারে না। বাংলাদেশের জন্য ভারতের শুভেচ্ছা যতই অফুরান হোক ও ভারতের রাষ্ট্রপতির শ্বশুরবাড়ি যতই কেননা বাংলাদেশে হোক, রাষ্ট্রনীতিতে উদ্দেশ্যহীন কোনও শুভেচ্ছা নেই।
যে সামুদ্রিক অঞ্চলকে এক কালে পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ, দ্বীপময় ভারত বা এমনকী বৃহৎ বঙ্গও বলা হত, সেই পুবদেশ থেকে নতুন বিশ্ব-বাণিজ্যের হাওয়া বইছে। ভারত থেকে মায়ানমার, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, কাম্বোডিয়া, তাইল্যান্ড, লাওস, ভিয়েতনাম পর্যন্ত স্থলবাণিজ্য সম্ভব, রাস্তাঘাটও তৈরি আছে। এই সম্ভাব্য বাণিজ্য ক্ষেত্রের দক্ষিণে মালাক্কা প্রণালি, পুবে টনকিন উপসাগর (দক্ষিণ চিন সাগর) আর পশ্চিমে মার্তাবান উপসাগর। আয়তন মোটামুটি কলকাতা থেকে কানপুর-হায়দরাবাদ ত্রিভুজের সমান। অন্ধ্রের রুই-কাতলা ও আঙুর রাতারাতি কলকাতার বাজারে আসতে পারে, রুই-কাতলা ও আঙুলের চাইতে দীর্ঘজীবী লোহালক্কড়, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ওই পুব ভূখণ্ডের একেবারে ভিতরের বাজারে পঞ্জাব-বডি ট্রাক পৌঁছে দিতে পারবে অনায়াসে।
না বুঝেই? তিস্তা ব্যারেজের উদ্বোধনে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। গাজোলডোবা,
জলপাইগুড়ি, ১৯ জানুয়ারি, ১৯৮৭। ছবি: তপন দাস
সেই প্রাচীন বাণিজ্যপথ খুলে যাওয়ার মুখে একমাত্র বাধা বাংলাদেশ। বাংলাদেশ যদি তাদের দেশের ভিতর দিয়ে বাণিজ্যপথ খুলতে না দেয়, তা হলে ভারতের পক্ষে এই নতুন বাণিজ্য গড়ে তোলা সম্ভব নয়। সেই উদ্দেশ্যেই ভারতের পক্ষ থেকে এত ঘন ঘন শুভেচ্ছা-সফর আর বাংলাদেশকে বার বার তিস্তার জলের ভাগ দেওয়ার লোভ দেখানো।
শুভেচ্ছা ও স্বার্থের এই সম্পর্ক যে হাসি-হুল্লোড়ে জমজমাট হতে পারছে না এখনও, তার একমাত্র কারণ পশ্চিমবঙ্গ সরকার। তিনি প্রকাশ্যে বার বার বলেছেন, রাজ্যের সঙ্গে কথা না বলে কেন্দ্রীয় সরকার একতরফা তিস্তা চুক্তি রাজ্যের ওপর চাপিয়ে দিতে পারেন না।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ষোলো আনার ওপর আঠারো আনা ঠিক। কেন্দ্রীয় সরকার তিস্তাচুক্তি নিয়ে এমন কাজ করছেন, যা সংবিধানের মূল উদ্দেশ্যের বিরোধী। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে ভারত সরকারের কোনও আন্তর্জাতিক চুক্তি সংক্রান্ত মতৈক্য বা মতানৈক্য ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বলা উচিত, ভারতের অভ্যন্তরতর বিষয়। কোনও ভাবেই বিদেশি কোনও রাষ্ট্রকে সে কথা বলা যায় না।
অথচ, ভারতের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিদেশমন্ত্রী এ কথা আক্ষরিক অর্থে না বললেও আভাসিক বলেই চলেছেন তিস্তা চুক্তির একমাত্র বাধা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলাদেশের এমন এক জনকেও খুঁজে পাওয়া যাবে কি, যিনি বিশ্বাস করেন তিস্তা চুক্তির স্বাক্ষরকারী ভারত সরকার ইচ্ছাসত্ত্বেও তার অভ্যন্তরীণ মতভেদ মিটিয়ে নিতে পারছে না? ভারত সরকারের প্রধানতম পদাধিকারীদের পরোক্ষ সমর্থনেই কিন্তু এই ভুল ধারণা বাংলাদেশে এমন ছড়িয়ে পড়ছে যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-ই তিস্তা চুক্তি আটকে দিয়েছেন। অন্য পক্ষে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও পরিষ্কার করে বলতে পারছেন না যে, তিস্তা চুক্তির কোন কোন ধারায় তাঁর আপত্তি।
বলতে পারছেন না, কেননা তিনি জানেন না। তিনি জানেন না, কারণ তাঁকে জানানো হয়নি। তাঁর পদের প্রাক্তন অধিকারী জ্যোতি বসু ও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও জানতেন না। কারণ, তাঁদেরও জানানো হয়নি। এই দীর্ঘ তিন দশক ব্যাপী অজ্ঞানতার কারণ তিস্তা চুক্তি এমন ধারাওয়ারি কোনও চুক্তিই না। ভারতের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, সংসদ, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী, বিধানসভা এঁরা কেউ জানেন না, পরিকল্পিত তিস্তা ব্যারাজে কোন মাসে কত জল আটকানো যাবে, আর কোন মাসে কত জল ছাড়া যাবে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বলা উচিত তিস্তা ব্যারাজ তৈরি হয়েছে অপ্রকাশ্য ও অজ্ঞাত তথ্যের ওপর। এই ব্যারাজের কাজ অবিলম্বে বন্ধ করা হোক। তিস্তা যেমন বইছিল, তিস্তা তেমনই বইতে থাকুক। তাতে ভারতের, পশ্চিমবঙ্গের, জলপাইগুড়ি, কোচবিহারের কৃষি যেটুকু জল পাবে পাক, তাতে বাংলাদেশের কৃষি যেমন জল পাবে পাক। কোনও চুক্তির দরকার নেই। নদী খুলে দাও। নদীকে নদী থাকতে দাও।
তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্প হয়েছে বামফ্রন্ট আমলে। অসম্পূর্ণ ব্যারাজটিই উদ্বোধন করেন জ্যোতি বসু। এই প্রকল্প নিয়ে আপত্তি তখনও ছিল। সেই আপত্তিগুলিকে তখনকার সরকার কোনও মূল্য দেয়নি। ব্যারাজের সম্পূর্ণ তথ্য তখনও প্রকাশ করা হয়নি, এ-পর্যন্তও প্রকাশ করা হয়নি। কোনও শ্বেতপত্র বেরোয়নি। বামফ্রন্ট সরকার একটি আইন করেছিল: যে কোনও প্রকল্পের পুরো বিবরণ প্রকল্পের জায়গায় প্রকাশ্যে বোর্ডে লিখে রাখতে হবে। এই নিয়ম অন্যান্য রাজ্যেও পালিত হয়। তিস্তা ব্যারাজে এমন কোনও বিজ্ঞপ্তি নেই।
তিস্তা ব্যারাজ সংক্রান্ত নীচের এই প্রশ্নগুলির কোনও উত্তর কেন্দ্রীয় জল কমিশন, কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রক, রাজ্য সেচ মন্ত্রক বা গত প্রায় তিরিশ বছরের মধ্যে কোনও কেন্দ্রীয় সরকার, কোনও রাজ্য সরকার ও কোনও কমিশন দিতে পারেনি।
১) তিস্তার খাত দিয়ে সারা বছরে মোট কত জল প্রবাহিত হয়? প্রধান ঋতুগুলিতে সেই প্রবাহের পার্থক্য কত দূর ও প্রকারই বা কী? এই স্রোত মাপার ব্যবস্থাটা কী?
২) তিস্তা ব্যারাজে কী পরিমাণ জল আটকানো হবে ও সেচখাল দিয়ে সেই আটকানো জল কোন ঋতুতে কী পরিমাণে ছাড়া হবে, তার পরিমাণের আন্দাজ কী?
৩) তিস্তা ব্যারাজের জায়গা গাজোলডোবা থেকে তিস্তার বাংলাদেশে ঢোকার জায়গা অর্থাৎ, ভারতভুক্ত তিস্তা নদীর দৈর্ঘ্য ৪০ কিলোমিটার নদীপথের দুই ধারে জলপাইগুড়ি-ময়নাগুড়ি-লাটাগুড়ি-মেখলিগঞ্জ-হলদিবাড়ি ইত্যাদি পুরনো শহর, নতুন শহর, পুরনো গঞ্জ ও বিস্তীর্ণ কৃষি এলাকা। গাজোলডোবার ভাটিতে এই ৪০-৫০ কিলোমিটারই ভারতের তিস্তা। গাজোলডোবার ব্যারাজে জল আটকালে এই পুরো ভারতের তিস্তাটাও জলহীন হয়ে পড়বে। আসলে ইতিমধ্যেই তা জলহীন হয়ে পড়ছে। তার অর্থ: তিস্তা ব্যারাজের জল ছাড়ার ওপর বাংলাদেশই কেবল নয়, উত্তরবঙ্গের একটি প্রধান কৃষি-এলাকাও জলহীন হয়ে পড়ছে। নদী-বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র মহাশয় তিস্তা সম্পর্কে তাঁর অনেকগুলি লেখায় এই কথা বলেছেন। আমরা এই কথা বলছি ১৯৮৩-৮৪ সাল থেকে। এই প্রমাণিত আপত্তি নাকচ করতে কী যুক্তি দেবেন কেন্দ্রীয় জল কমিশন? রাজ্য সরকারই-বা এই প্রশ্ন সরাসরি তুলছেন না কেন?
৪) সিকিমের অন্তর্গত ৬২০০ মিটার উঁচু পর্বতশিখরের জোড়াহ্রদ থেকে তিস্তা বেরোচ্ছে। সেই মুখ থেকে তিস্তামুখঘাটে (বাংলাদেশ) মেঘনা-ব্রহ্মপুত্র খাতে পড়ছে তিস্তা। মোট দৈর্ঘ্য ৪১০ থেকে ৪৫০ কিলোমিটার। নদী তো পাথর নয়, তাই দৈর্ঘ্যও স্থির নয়। ৫০০ কিলোমিটার ধরাই ভাল। এই ৫০০ কিলোমিটারের মধ্যে ১৬০ বর্গ কিলোমিটার স্থায়ী তুষার-অঞ্চল। ১৭২ কিলোমিটার তিস্তার পর্বতখাত। ৯৭ বা ১০০ কিলোমিটার মতো ভারতে তারও অনেকটা অংশ পাহাড়ের সানুদেশ। ১২৪ কিলোমিটার বাংলাদেশে। কোনও কোনও হিসেবে এটা ১৭৫ কিলোমিটার। এই তথ্যগুলি অনেকটা জানা। কিন্তু যা একেবারে জানা নেই, সিকিমে তিস্তায় কতটা জল বয়। পাশাপাশি ঝোরা, নালি, খোলা থেকে কতটা জল পেতে-পেতে তিস্তা সমতলে নামে? এই হিসেব পাওয়া না গেলে তিস্তার মোট জলের পরিমাণ কে স্থির করবে?
৫) উত্তর সিকিমের লাচুং থেকে দক্ষিণ সিকিমের রংপো পর্যন্ত ২১টি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রস্তাবিত হয়েছে ও কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রকের আপত্তি সত্ত্বেও অন্তত ৬টি থেকে ৮টি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি হয়েছে। সেভকের কাছে সিকিমের ৬টি (ওই প্রস্তাবিত ২১টির মধ্যে) ও পশ্চিমবঙ্গের ২টি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র ও ১৫ মিটারের চাইতে উঁচু বাঁধ তৈরি হচ্ছে। ফলে গাজোলডোবার আগেই তিস্তার জল তুলে নেওয়া হচ্ছে। এতে তিস্তার মোট জলের পরিমাণ কত কমছে?
৬) স্থলভূমির ঢাল অনুযায়ী তিস্তার চিরকালীন খাত হচ্ছে পাঙ্গা-করতোয়া-আত্রাই-যমুনেশ্বরী। ১৯৬৮ সালের ৩ অক্টোবর সকাল থেকে মণ্ডলঘাটের কাদোবাড়িতে দাঁড়িয়ে স্তব্ধ হয়ে আমি দেখছিলাম তিস্তা কী বেগে তার এই খাতের ভিতরে ঢুকছে। উদ্বিগ্ন হয়ে তখনই জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে গিয়ে বলি, এটা অস্বাভাবিকের চাইতেও অস্বাভাবিক, আপনি মানুষ বাঁচান। বলে আবার কাদোবাড়িতে ফিরে যাই। সন্ধ্যার মুখে প্রবলতর তিস্তার খাতপ্রবেশ থেকে বাড়িতে ফিরে আসতে বাধ্য হই। মাত্র ছয় ঘণ্টা পর তিস্তা আমার ঘরে এসে গেল। পরে তো জেনেছি, তিন দিন ধরে সিকিম অববাহিকায় ১৫০০ মিলিমিটার বৃষ্টির জল নিয়ে ২০০০০ কিউসেক জলস্রোত (গড় যেখানে ৪ থেকে ৫ হাজার) নেমে এসেছিল। বন্যা-পরবর্তী সময়ে ইঞ্জিনিয়ার (বন্যা)-এর সঙ্গে আমার মতপার্থক্য ঘটায় একটা হেলিকপ্টারে তাঁর সঙ্গে আমি এই পুরো তিস্তা-স্রোতখাত ধরে উড়েছি।
নদী নিয়ে এমন বেহিসেবি কাজ আসলে প্রতিকার-ব্যবস্থাহীন গণহত্যাসম্ভব মায়াময় উন্নয়ন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে অনুরোধ, তিনি দাবি করুন, উত্থাপিত এই প্রত্যেকটি প্রশ্নের উত্তর। তিনি যদি চান, আমরা তাঁর কাছে আমাদের অভিজ্ঞতার তথ্য ও সংগৃহীত তথ্য পৌঁছে দেব। তিনি ঘোষণা করুন তিস্তা নিয়ে বাংলাদেশের ও উত্তরবঙ্গের আসলে একই সংকট। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলুন, বাংলাদেশ ও উত্তরবঙ্গকে বাঁচাতে তিস্তা ব্যারাজ নিষ্ক্রিয় করা হোক, নদীকে নদীতে ফিরিয়ে দেওয়া হোক। মুখ্যমন্ত্রী যদি চান, তিস্তা ব্যারাজ নিয়ে একটা সব রকম মতের মিটিং ডাকুন না। সর্বদলীয় নয়, সর্বমতের মিটিং। বক্তৃতার নয়, প্রমাণের মিটিং। মুখ্যমন্ত্রী নিজে শুনুন। আমরা রবাহূত হয়েও যেতে রাজি আছি।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.