হেলিপ্যাড থেকে মাজার একই গাড়িতে। কোতুয়ালির প্রাসাদ থেকে আবার হেলিপ্যাডও এক গাড়িতে। পাশাপাশি।
পশ্চিমবঙ্গের আকাশে এই প্রথম এক সঙ্গে উড়ে এল প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ এবং কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধীর হেলিকপ্টার। এ রাজ্যের রাস্তায় এই প্রথম দেশের দুই শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের গাড়ির চাকাও গড়াল এক সঙ্গে!
কিন্তু মাটিতে পা ফেলে সনিয়াকে পিছনে ফেলে দিলেন মনমোহন! শনিবার সকাল ঠিক ১১টা ১৪ মিনিটে আবু বরকত আতাউল গনি খান চৌধুরীর মাজারের সামনে দেশের দুই ভিভিআইপি-কে গাড়িতে তুলে দিয়েছিল এসপিজি। হঠাৎই নেমে এলেন মনমোহন। পিছনে পিছনে সনিয়াও। গনির মাজারে ফুল চড়ানোর পরে প্রয়াত নেতার প্রাসাদ পর্যন্ত দেড়শো মিটার পথ পায়ে হাঁটবেন বলেই মনস্থ করলেন প্রধানমন্ত্রী।
পরের তিন মিনিটে কোতুয়ালি দেখল, সবুজ কার্পেটের উপর দিয়ে হেঁটে গনির বাড়ির সদর দরজা পেরোচ্ছেন মনমোহন। কয়েক কদম পিছনে সনিয়া। যিনি এর আগেও অন্তত দু’বার কোতুয়ালির প্রাসাদে এসেছেন। প্রধানমন্ত্রীর পদার্পণ এই প্রথম। |
তা-ও আবার সেই প্রধানমন্ত্রী, যিনি কি না আগে দু’বার মালদহে গনি খানের নামে কলেজ শিলান্যাস করতে আসতে চেয়েও আসতে পারেননি। শনিবার পেরেছেন এবং পুষিয়েও দিয়েছেন! আগের দু’বার আসতে না-পারার আফশোস প্রকাশ্যেই ব্যক্ত করেছেন নারায়ণপুরের কলেজ-মাঠে। আর কোতুয়ালিতে ঢুকেই তাঁদের জন্য নির্দিষ্ট ঘরে না-গিয়ে মনমোহনই এগিয়ে গিয়েছেন আবু নাসের (লেবু) খান চৌধুরীর বসত বাড়ির অংশের দিকে। সকালে ঘুম থেকে যে ছোট্ট ঘরে চায়ের পেয়ালা নিয়ে বসার অভ্যাস লেবুবাবুর, সেই ঘরেই সটান মনমোহন-সনিয়া!
আয়োজনে ঘাটতি রাখেনি কোতুয়ালি। প্রধানমন্ত্রীরা মাজারে ঢোকার প্রাক-মূহুর্তে নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে ঢুকে পড়ে বেয়াড়া এক সারমেয় কিছু ক্ষণের জন্য ঘাম ছুটিয়ে দিয়েছিল নিরাপত্তা রক্ষীদের! তাতে অবশ্য প্রাসাদের ভিতরের তাল কাটেনি। মনমোহনের প্রিয় ব্রাউন ব্রেড, ফলের রস থেকে শুরু করে সনিয়ার পছন্দের ইতালিয়ান তরমুজ, আঙুর এবং চিজ স্যান্ডউইচ তৈরি ছিল। ট্রে বাড়িয়ে দিচ্ছিলেন লেবু, তাঁর ভাই তথা কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী আবু হাসেম (ডালু) খান চৌধুরী, ডালুর বিধায়ক-পুত্র ঈশা খান ও তাঁর স্ত্রী সৈয়দ সালেহা নূর। কিন্তু ডাবের জল ছাড়া আর কিছুই মুখে তোলেননি মনমোহন-সনিয়া। ডাবের মাহাত্ম্যও অবশ্য ফেলনা নয়! গনির গেস্ট হাউসের গাছের ফল বলে কথা! |
তার চেয়ে প্রধানমন্ত্রী বরং অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ ছিলেন বরকতের স্মৃতি রোমন্থনে এবং নতুন কলেজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায়। যে ঘরে বসেছিলেন, তার দেওয়াল জুড়ে কোথাও গনি-ইন্দিরা গাঁধী, কোথাও গনি-রাজীব গাঁধীর ছবি। এমনকী, হাজির কোতুয়ালির এই বাড়িতে সনিয়ার উপস্থিতির ফ্রেমবন্দি সাক্ষ্যও। সঙ্গী সনিয়াকে যা এ দিন স্মিত হাসি সহযোগে দেখিয়েও দিয়েছেন মনমোহন। পর মূহুর্তেই আবার কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী পাল্লাম রাজুকে ডেকে নিয়ে গনির নামাঙ্কিত কলেজের কোর্স ডিজাইনের আলোচনায় লেবুকে সঙ্গে নিয়ে বসে পড়েছেন অর্থনীতিবিদ মনমোহন। প্রাক্তন অধ্যাপক লেবুবাবুর কথায়, “অনেক স্বপ্ন নিয়ে এই কলেজটা তৈরি হচ্ছে। যে ভাবে পরিকল্পনা হয়েছে, তাতে প্রধানমন্ত্রী এবং সনিয়াজি, দু’জনেই সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। বিদেশ থেকে ফেরা ইস্তক এই কলেজের স্বপ্ন নিয়েই তো লড়ছি!”
তবে আফশোসও আছে গনি পরিবারের। এত আয়োজন সত্ত্বেও মনমোহনেরা সে সবের দিকে গেলেন না। পরে ঈশা বলছিলেন, “সব কিছুই অফার করেছিলাম। কিন্তু এই বাড়িতে ওঁদের জন্য বাঁধা ছিল ১০ মিনিট। এই সময়ের মধ্যে ওঁরা আর কিছু খেতে চাননি। তবে আগে দু’বার সব আয়োজন সাজিয়েও প্রধানমন্ত্রী আসেননি। এ বার যে তিনি এসেছেন, এতেই আমরা খুশি!” কোতুয়ালি ছাড়ার আগে সনিয়া-মনমোহনের জন্য গাড়িতে তুলে দেওয়া হয়েছে মালদহের আমসত্ত্ব, সিল্কের শাড়ি ও কুর্তা-পায়জামা।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ডালু, রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী তথা বিধায়ক লেবু, আর এক বিধায়ক ঈশা সবাই ঘিরে ছিলেন মনমোহনদের। পারিবারিক আসরে উল্লেখযোগ্য অনুপস্থিতি শুধু গনি পরিবারের কনিষ্ঠতম রাজনীতিক মৌসম বেনজির নূরের। নারায়ণপুরে কলেজের শিলান্যাস অনুষ্ঠান সেরে সনিয়ারা ফিরে যাওয়ার পরে উত্তর মালদহের সাংসদ বলছিলেন, “আমি আর ভিতরে ছিলাম না। কোতুয়ালির হেলিপ্যাডে প্রধানমন্ত্রী এবং সনিয়াজি’কে স্বাগত জানিয়েই নারায়ণপুর চলে এসেছি।” সদ্যোজাত পুত্রকে কলকাতায় ছেড়ে এসেছেন বলে একে আনমনা, তায় সদ্যমাতৃত্বের ধকলে শরীরও স্বাভাবিক গতিতে নেই। তবে নারায়ণপুরের মঞ্চে তরুণী সাংসদকে পেয়ে তাঁর কুশল সংবাদ নিতে ভোলেননি সনিয়া। ছেলের নাম জেনে নিয়েছেন।
একটু বড় হলে তাকে নিয়ে ১০ জনপথে যাওয়ার সস্নেহ নির্দেশও দিয়ে গিয়েছেন। |