নারায়ণপুরের মাঠে তখন ধুলোর ঝড়। চিকন সবুজ শাড়ির আঁচল উঠে এসেছে নাকে। পিছন থেকে আওয়াজ গেল “থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাডাম! আ বিগ থ্যাঙ্ক ইউ!” আঁচল সরিয়ে স্মিত হাসলেন সনিয়া গাঁধী। বিমান বাহিনীর কপ্টারের দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
আনুষ্ঠানিক ভাবে ধন্যবাদ জ্ঞাপনের কাজটা করলেন আবু নাসের খান চৌধুরী (লেবু)। আসলে দিল্লির উদ্দেশে রওনা দেওয়া সভানেত্রীর কপ্টারকে ধন্যবাদ জানাল
গোটা পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেস। সদ্য ইংরেজবাজারে বিধানসভা উপনির্বাচন হেরে সম্মান খোয়ানো কংগ্রেসের হয়ে পঞ্চায়েত ভোটের প্রচারের মুখবন্ধ বেঁধে দিয়ে গেলেন যে স্বয়ং সভানেত্রীই! প্রয়াত বরকত গনি খানের জেলায় জনতার আবেগ ছুঁতে নিপুণ ভাবে ব্যবহার করলেন তাঁরই নাম, তাঁরই স্মৃতি। সঙ্গে আরও দুই অস্ত্র আর্থ-সামাজিক খাতে ইউপিএ সরকারের প্রকল্প এবং সংখ্যালঘুদের জন্য পরিকল্পনা। সভানেত্রীকে ধন্যবাদ না-জানিয়ে রাজ্য কংগ্রেসের আর উপায় কী!
হেলিপ্যাড থেকেই প্রায় ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যের প্রতিক্রিয়া, “ব্রিলিয়ান্ট! ম্যাডাম যা বলে গেলেন, পঞ্চায়েত ভোটের আগে ঠিক এটাই আমাদের দরকার ছিল।” এক মাসের শিশুপুত্র এমান’কে কলকাতায় রেখে নিজের লোকসভা কেন্দ্রে সনিয়া ও মনমোহন সিংহের অনুষ্ঠানে হাজির থাকতে ছুটে আসা মৌসম বেনজির নূরের মুখেও স্বস্তির হাসি, “এই জেলা এবং সর্বত্র এটার প্রভাব পড়বে। সনিয়াজি ঠিক সময়ে ঠিক কথাটা বলে গেলেন।” |
শনিবার মালদহে কী বলে গেলেন সনিয়া? বললেন, “আপনাদের প্রিয় নেতা গনি খানের অটুট আস্থা ছিল কংগ্রেসের ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদে। ইন্দিরাজি’র ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন। এলাকার উন্নয়ন কী ভাবে করতে হয়, মানুষের আস্থা কী ভাবে অর্জন করতে হয়, জানতেন। বছরের পর বছর নির্বাচন জিততেন মানুষের মন বুঝতে পারতেন বলেই। আপনাদের এই প্রেম ও বিশ্বাসকে সম্মান জানাই।” গনি খানের স্মৃতি তর্পণ করেই (বরকতের মাজারে ফুলও দিয়েছেন) কংগ্রেস সভানেত্রী বলে গেলেন, ১০০ দিনের কাজ, রাজীব গাঁধী গ্রামীণ স্বাস্থ্য যোজনা, জেএনএনইউআরএনএম, অসংগঠিত শ্রমিক এবং অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের জন্য হরেক প্রকল্পের কথা। এই সব প্রকল্প আম-আদমির সামাজিক ও আর্থিক বিকাশের লক্ষ্যে কী ভাবে কাজ করছে, বললেন তা-ও। বলে গেলেন, সংখ্যালঘু ও অনগ্রসর অধ্যুষিত ৯০টি জেলাকে বেছে নিয়ে ইউপিএ সরকার বিশেষ পরিকল্পনা শুরু করেছে। যার মধ্যে এ রাজ্যের মালদহ জেলা পড়ছে। এবং এই ধরনের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্পের তত্ত্বাবধান খোদ প্রধানমন্ত্রীই করছেন। আরও বলে গেলেন, আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস হয়েছে মুর্শিদাবাদ জেলায়। আর্থিক ভাবে পিছিয়ে-পড়া বিধবা মহিলাদের কল্যাণে যে প্রকল্প হয়েছে, তার মধ্যেও আছে মুর্শিদাবাদ। বললেন, “সাম্প্রদায়িকতা ও বিচ্ছিন্নতাবাদের বিরুদ্ধে লড়াই-ই কংগ্রেসের পুঁজি। সেই লড়াই জারি রাখতে হবে।”
ঘড়ি ধরে ঠিক দশ মিনিয়ের বক্তৃতায় ঠিক তিন বার কংগ্রেস নামটা উচ্চারণ করেছেন সনিয়া। যদিও এ দিনের অনুষ্ঠানে তাঁর উপস্থিতি ছিল জাতীয় উপদেষ্টা পরিষদের চেয়ারপার্সন হিসেবে। একই মঞ্চ থেকে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন অবশ্য কংগ্রেসের নাম করেননি, সরাসরি রাজনীতির কথাতেও জাননি। কিন্তু সরকারি অনুষ্ঠানে সরকারি বক্তৃতার মোড়কেই প্রয়োজনীয় বার্তা দিয়ে গিয়েছেন। বলেছেন, “লাগাতার পাঁচ বার বিধানসভা এবং পাঁচ বার লোকসভা নির্বাচন জিতেছিলেন গনি খান। এতেই বোঝা যায়, কত জনপ্রিয় ছিলেন। তাঁর নামে যে ইঞ্জিনিয়ারিং ও টেকনোলজি প্রতিষ্ঠানের সূচনা করে গেলাম, আশা করি তার কাজ দ্রুত এগোবে। পরের বার এসে দেখব, এই প্রতিষ্ঠানে পাঠ নিয়ে ছেলেমেয়েরা দেশের মুখ উজ্জ্বল করছে।” যখন বলছিলেন, মঞ্চে বসে মুখ উজ্জ্বল হচ্ছিল আবু নাসের ও আবু হাসেম (ডালু) খান চৌধুরীর! প্রয়াত দাদার নামে কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনে এর আগে দু-দু’বার প্রধানমন্ত্রীকে আনার চেষ্টা করেছেন। দু’বারই শেষ মুহূর্তে সফর বাতিল হয়েছে মনমোহনের।
তৃতীয় বারের চেষ্টায় তাঁদের কপাল খুলল এমন একটা সময়ে, যখন তৃণমূলের হাতে শোচনীয় ভাবে ইংরেজবাজার খুইয়ে কংগ্রেসের ‘গনি মিথ’ বড়সড় প্রশ্নের মুখে। মনমোহন বলে গেলেন “২০০৮ এবং ২০১০-এ আসার পরিকল্পনা নিয়েও কিছু কারণে মালদহ আসা হয়নি। এ বার এসেছি ‘গনি খান চৌধুরী ইনস্টিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি’ (জিকেসিআইইটি) স্থাপন করে এখানকার এক মহান নেতাকে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিতে। যাঁর প্রয়াণের পরে তাঁর দুই ভাই দাদার কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।” এবং জানিয়ে গেলেন, গনি খানের নামাঙ্কিত কলেজের জন্য চলতি বছরে দেওয়া হয়েছে ২৬.৬ কোটি টাকা। তার মধ্যে নতুন ক্যাম্পাস গড়ার জন্য বরাদ্দ ১৫ কোটি। প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতেই কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী এম পাল্লাম রাজুর উচ্চকিত ঘোষণা, “অরুণাচল এবং পঞ্জাবের লঙ্গওয়ালের পরে এই প্রথম এই রকম প্রতিষ্ঠান হচ্ছে। টাকার জোগান কোনও বাধা হবে না। পরের বছর মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক ৫৬ কোটি টাকা দেবে।” খুব স্বাভাবিক যে, এমন ঘোষণার পরে গনি পরিবার স্বস্তির শ্বাস ফেলবে। নারায়ণপুরের মাঠেই পিএমও-র অস্থায়ী ক্যাম্প অফিসে বসে খুশিতে ডগমগ বিধায়ক লেবুবাবু বলছিলেন, “রাজনীতি অনেক পরে। আমার প্রথম স্বপ্ন ছিল এই কলেজ! আজ ম্যাডামও খুশি, আমিও খুশি!” |
এত খুশির কারণ অবশ্য দেখছেন না কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে গিয়ে সদ্য ইংরেজবাজার-জয়ী কৃষ্ণেন্দু নারায়ণ চৌধুরী। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে রাজ্য মন্ত্রিসভার প্রতিনিধি হিসেবে প্রধানমন্ত্রী ও সনিয়াকে কোতুয়ালির হেলিপ্যাডে পুষ্প-স্বাগত জানিয়েই যিনি দ্রুত উধাও হয়ে গিয়েছিলেন। পরে বললেন, “বরকতদা’র নামে অনুষ্ঠান। প্রধানমন্ত্রী এবং সনিয়া গাঁধীর মতো দেশের প্রথম দু’জন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এসেছেন। তাতে মাত্র দু’শো লোক! তার মধ্যে পঞ্চাশ জন আবার সাংবাদিক! এর চেয়ে আমি কৃষ্ণেন্দু চৌধুরী ডাক দিলে তো কয়েক হাজার লোক আসত! সনিয়া গাঁধী দেখে গেলেন, মালদহে কংগ্রেসের দিন ফুরোতে চলেছে!”
ঘটনা যে, মাঠে লোকসমাগম তেমন কিছু ছিল না। ডালুবাবুরা বলছেন, সরকারি অনুষ্ঠান বলে সংগঠিত ভাবে লোক আনা হয়নি। মৌসম বলছেন, তিনি এক দিনের জন্য এসেছেন। অনুষ্ঠান আয়োজনের কিছুই জানেন না। তা হলে দাঁড়াল কী? সনিয়ার বার্তা থাকল প্রদীপ-ডালু-লেবু-দীপা দাশমুন্সিদের জন্য। জনতা কানে তুলল কি না, প্রশ্ন থাকছেই! |