রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ২...
জাস্ট যাচ্ছি
কচক করে উঠল ধাতুর বুদ্ধমূর্তিটা। রেখে দিলাম যথাস্থানে। একটা-দু’টো বাল্ব জ্বলছে হাবিব মল্লিকের দোকানে। কিউরিয়োর দোকান তো নয়, যেন একটা মনাস্ট্রির গুপ্ত কক্ষ। চার পাশে হাজার বছর ধরে সঞ্চিত যকের ধন। আলো বাড়ার কারণটা ঠিকই আন্দাজ করেছিলাম। বেরিয়ে এসে দেখলাম রোদ উঠে গেছে দার্জিলিঙের ম্যালে। এলোমেলো টুরিস্ট। দৌড়ে আসা বাচ্চা দেখে পায়রা উড়ে গিয়ে বসছে শ্যালে হোটেলের ছাদে। অর্ধেক ঝুলে বাঙালি বউদি চলেছেন ঘোড়ায় চড়ে, বার বার তাকাচ্ছেন পিছনে। মালা জপতে জপতে, পা টেনে টেনে হাঁটছেন স্থানীয় বাসিন্দা। ঠান্ডা আছে।
হালকা করে কে যেন হাত রাখল কাঁধে। মুখ ঘুরিয়ে দেখলাম, বয়স্ক এক ভদ্রলোক। সাদা দাড়ি, কাটা হয়নি ঠিকমত, পাগলাটে হাসি, কেমন যেন চোখ দু’টো। পরিষ্কার কোট-প্যান্ট। হাসি দেখে মনে হল চেনেন আমাকে, আমি অবশ্য চিনতে পারলাম না। সেটা ঠিক বলতেও পারলাম না ভদ্রতার খাতিরে। উনি বললেন, ‘ফিরলে কবে?’ তার পর উত্তরের অপেক্ষা না-করে আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘মলয়ের খবর জানো?’ কাঁধ থেকে হাত নামিয়ে আমার হাতটা একটু জড়িয়ে ধরে পা বাড়ালেন রাজভবনের রাস্তায়। এগোতে বাধ্য হলাম। খুব মনে করার চেষ্টা করছিলাম উনি কে।
অক্সফোর্ডের বইয়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে উনি বললেন, ‘ওই বইটা, মলয়কে দিয়েছিলাম, সেই যে-বারে ম্যালোরি হারিয়ে গেল এভারেস্টে, তার পুরো ব্যাপারটা ওরা বার করেছে, ওই বইটাই কাল হল’, বলে আবার হাঁটতে লাগলেন আস্তে আস্তে। ডান দিকে একটা মূর্তি দেখিয়ে বললেন, ‘রাহুল সাংকৃত্যায়ন ভোলগা থেকে গঙ্গা।’ আমি হেসে বুঝিয়ে দিলাম পড়া আছে। বাঁ দিকে একটা পোড়া কাঠের বাড়ির ধ্বংসস্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে কী যেন বলবেন ভেবেও বললেন না। নিজের মনে মাথা নাড়লেন। খুব আস্তে বিড়বিড় করলেন, ‘আসল আগুনটা তো মনের ভেতরে থাকে। ফায়ার, বুঝলে। সেটা কন্ট্রোল করতে হয়, না হলে দাবানল হয়ে যায়।’
ছবি: শুভময় মিত্র
রাজভবনের গেট থেকে উনি ডান দিকে ঘুরলেন। হাত ছেড়ে দিয়েছেন, তবুও চললাম পাশে পাশে। কাজ তো নেই কিছু। রাস্তাটা তো অবজাভের্র্টরি হিল-কে পাক দিয়ে ম্যালেই পড়বে।
দার্জিলিঙে রোদ থাকলেও দূরের পাহাড়ে কুয়াশা। কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাচ্ছে না। ও দিকে আঙুল দেখিয়ে এ বারে বললেন, ‘এভারেস্ট তো তেনজিং-এর, কাঞ্চনজঙ্ঘাটা কার বলো দিকি?’ মাথা নাড়লাম। ‘ওটা মানিকবাবুর। ডেফিনিটলি।’ ভিউ পয়েন্ট এল, বেঞ্চ আছে, লোহার জাফরি করা পোস্ট রয়েছে। চা-ওয়ালা দেখে বললাম, ‘চা?’ উনি সম্মতি দিলেন, বললেন, ‘ব্যাপারটা তোমার জানা দরকার, বলি তোমাকে, বোসো।’ খপখপ আওয়াজ করে ঘোড়া গেল পর পর। পাহাড়ের সবুজ দেওয়ালে প্রচুর মস হয়ে আছে, ছিটেফোঁটা ছোট ফুল, ফার্ন। দেওয়াল কেটে গর্ত করে পর পর তিব্বতি ধর্মচক্র লাগানো। হাত দিয়ে ঘোরাতে হয়। আকাশের দিকে আঙুল তুলে বৃদ্ধ বললেন, ‘মহাকাল! সব দেখছে, সব জানে, কিন্তু বলছে না। এই যে মলয় চলে গেল পাহাড়ে। মহাকাল জানত। এই মলয়ের মা চলে গেল, যাওয়ারই ছিল। সামান্য ছোটখাটো ভয়, বাজে ব্যাপার, তা-ও ভয় পেল তো, চলে গেল তো।’ মুখটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে এ বারে বললেন, ‘আমি আটকাইনি ওদের। আমি কাউকে ধরে রাখি না। আমরা তো কেউ না। বুদ্ধকে দ্যাখো। সেই তো যেতে হল। রাজার ব্যাটা। কী না ছিল জীবনে। কী, ছিল তো?’ বুদ্ধদেবকে যেন আমিও ভালই চিনি, এমন ভাবেই উত্তর দিলাম, ‘হ্যাঁ, যেতে তো হয়ই।’ বলতেই উঠে দাঁড়ালেন উনি। উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলেন, ‘প্রশ্নটা হল, কেন যাব? কেন, কেন?’
হাঁটা শুরু হয়েছে আবার। মেঘের ফাঁক দিয়ে লেবং রেসকোর্সটা একটু দেখা যাচ্ছে। সামনের রাস্তায় অনেক গাছপালা, তাই আলো কম। কুয়াশাও আসছে। দূরের রেলিং, তিব্বতি পতাকার রংগুলো আবছা হয়ে আসছে। আমাদের পাশ দিয়ে গল্প করতে করতে দু’টো অল্পবয়সি মেয়ে হনহন করে চলে গেল। কুয়াশাটা যেন টানছে আমাদের। ওঁর হাঁটার গতি বেড়ে গেছে, একটু যেন বেসামাল, আবার ধরে ফেলেছেন আমার হাত। ‘ভয়। ভয় একটা মিস্টিরিয়াস ফেনোমেনন। কেন আসে, কোথা থেকে আসে, কেউ জানে না।’ কুয়াশার মধ্যেই নজর করলাম মেয়ে দু’টো দাঁড়িয়ে পড়েছে। এক জন আর এক জনকে জড়িয়ে ধরে আছে। চোখে-মুখে স্পষ্ট আতঙ্কের ছাপ। কারণ, কুয়াশার মধ্যে দিয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে একটা হনুমান। দাঁতটা বার করল এক বার। আক্রমণ করবে না তো? তার দিকে বন্দুক তাক করার মতো নিজের হাতটা ছুড়ে দিয়ে বৃদ্ধ হাসতে হাসতে বললেন, ‘বলেছিলাম কি না। ওই দ্যাখো, আসছে, ভয়। কিস্যু করবে না। কিস্যু হবে না। ইডিয়ট।’ শেষ শব্দটা গুলির মতো ফাটল ঘন কুয়াশায়। পথ বদলে হনুমানটা নেমে গেল পাশের খাদে, ঝোপঝাড়ের মধ্যে।
এ বার শান্ত ভাবে পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছলেন উনি। বললেন, ‘ঋত্বিককে দ্যাখো। রামকিঙ্করকে দ্যাখো। ফিল্ম বানাচ্ছেন, মূর্তি গড়ছেন, ছবি আঁকছেন। কী সব সাংঘাতিক কাজ! একটু ভাল করে দেখলেই বুঝবে, র’ মোটেই নয়। একেবারে নিটোল কম্পোজিশন সব। সাধারণ লোকে বোঝেনি। না বোঝারই কথা। একটু আনসেফ দেখলেই গুটিয়ে যায়, দাঁত বের করে ফ্যালে। আসলে ভয় পায়। এটাকে পাত্তা দিতে নেই। জীবনের অনেকগুলো লেয়ার আছে। ওপর-ওপর দেখলে চলবে? আচ্ছা, তোমার মনে হয় না, ঋত্বিক আর রামকিঙ্কর আসলে একটাই লোক?’
কুয়াশাটা আরও ঘন হয়ে আসছে। গাছের পাতার চাঁদোয়া ফুটো করে টুপটাপ জল পড়ছে। চার পাশে ধুনোর মতো গন্ধ। জিজ্ঞেস করলাম, ‘ওরা সব গেল কোথায়, জানেন?’ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ভদ্রলোক পকেট হাতড়াতে লাগলেন। না পেয়ে অস্পষ্ট ঘড়ঘড়ে গলায় বললেন, ‘মলয়ের মা তো ভয়েই মরে গেল। আমাকে নিয়ে ভয়। কেন, না আমাকে নাকি বোঝা অসম্ভব। আমি নাকি ’ চশমাটা খুঁজে পেয়েছেন। পরলেন, তার পর পিছন ফিরে তাকালেন। এত কুয়াশা, কিছুই দেখা যাচ্ছে না আর। তার মধ্যে দিয়েই কী একটা দেখার চেষ্টা করতে লাগলেন মরিয়া হয়ে। তার পর ওই দিকে হাত দেখিয়ে জোরালো গলায় বললেন, ‘ও আছে ওইখানে।’ বলে হাঁপাতে লাগলেন। আমি কিছু বুঝতে না পেরে চুপ করে রইলাম। বৃষ্টিটা বাড়ছে। ম্যালেই যাওয়া দরকার।
গলা নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বলতে লাগলেন, ‘আমি ভয় পাইনি। মলয়ও ভয় পেত না কোনও দিন। আমি যেটা পারিনি, সেটা ও পারবে, জানতাম। ও গিয়েছিল কাঞ্চনজঙ্ঘায়। এ দিক দিয়ে নয়, নেপাল থেকে। বেসক্যাম্প ছিল পাংপেমায়। খবর পাঠিয়েছিল। থার্ড ক্যাম্প অবধি সব ঠিক ছিল। তার পর ওয়েদার বিগড়ে যায়।’
ঝুপঝুপ বৃষ্টিতে সব কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে। দূরে পাহাড়ের নীচ থেকে হুইস্ল শোনা গেল যেন ট্রয় ট্রেনের। ঝুঁকে-পড়া মাথাটা জবরদস্তি করে তুললেন বৃদ্ধ। চশমার কাচে অজস্র জলের বিন্দু। ভ্রুক্ষেপ নেই। বললেন, ‘ওয়েদার আজও বিট্রে করে চলেছে আমাকে, কিন্তু এর শেষ আছে। বুঝলে, নজর রাখছি আমি। একটু রোদ উঠতে দাও, একটু ক্লিয়ার হলেই মলয় চলে আসতে পারবে আমি জানি।’ বলেই দু’হাত দিয়ে সামনের কুয়াশাকে ফালাফালা করে ফেলতে ফেলতে আবার হাঁটতে লাগলেন অদৃশ্য কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে মুখ করে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.