|
|
|
|
|
|
এদ্মানুয়েল আংগুলো মারুফো |
বন্দি
|
অনুবাদ সুপ্রিয় বসাক |
দৃশ্য ১
|
একটা দরজা। একটা সামান্য দরজার পেছনে কত কী-ই যে ঘটতে পারে! গোটা দৃশ্যপটটা আমাকে লিঞ্চ বা বুনুয়েলের কোনও সিনেমার কথা মনে পড়িয়ে দিচ্ছে; শুধু তফাত এই যে, হোটেলের করিডরটা একেবারে আমার রক্ত-মাংসের চোখের সামনে। যদি সরাসরি দরজার ও দিকে কী ঘটছে সেটা দেখা যেত, তা হলে হয়তো চোখে পড়ত এমনই কিছু দৃশ্য...
এক নারী হোটেলের একটা ঘরে নোংরা ম্যাট্রেসের ওপর আয়েশ করে বসে একটা সিগারেট ধরাচ্ছে। তার পরে সে তার হাতের গ্লাসের হুইস্কির তলানিটা এক ঢোকে গলায় ঢেলে দিল; তার স্বামী পুরুষত্বহীন, আর প্রেমিক তৃপ্ত ভঙ্গিতে নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে; তার ছোট মেয়ে হালফিল বয়েসে দশ বছরের বড় একটা মালের সঙ্গে জীবনে প্রথম যৌনতার স্বাদ পেয়েছে, আর বড় মেয়ে তার সাম্প্রতিক প্রেমিক আলোন্সোর শরীরের ওপর শুয়ে তার কানের কাছে মৃদু স্বরে গুনগুন করছে।
পনেরো বছরের এক কিশোরী হাতে একটা .২২ ক্যালিবারের পিস্তল নিয়ে নাড়াচাড়া করছে; তার পরে হঠাৎ সেটার নলটা নিজের মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল, ফের সেটাকে বার করে এনে ক্রমশ নামাতে নামাতে নিজের যৌনাঙ্গের ওপর রাখল। পাশেই এক জন পুরুষ গুটিসুটি মেরে শুয়ে, তার চোখের দৃষ্টি ঝাপসা, অন্যমনস্ক ভাবে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মেঝেতে একটা সিরিঞ্জ পড়ে, পাশে সামান্য পরিমাণে মারিহুয়ানা, একটা সুইস-সিলভারের চামচ, একটা রবারের দড়ি, একটা ছোট আয়নার ওপরে সাদা কোকেন পাউডার আর একটা রেজর-ব্লেড।
তেইশ বছরের এক পুরুষ, বিবাহিত, ফুলের নকশা আঁকা একটা চাদরে রক্ত আর বীর্য মুছে মৃদু হেসে ওঠে; আর তেরো বছরের এক কিশোরী অচেতন ভাবে বিছানার ওপরে পড়ে থাকে।
আরও ভাল হত যদি...
আমার শরীরটা কেঁপে ওঠে, হাঁটু মুড়ে বসে আছি, মারিয়ানা একদৃষ্টে বিছানার ওপর থেকে আমার দিকে চেয়ে থাকে।
বাস্তবে, একটা দরজার আড়ালে কত কী-ই যে ঘটে যায়, লোকে জানতেই পারে না।
|
|
দৃশ্য ২
|
মারিয়ানা স্পষ্টবক্তা। ও দরজার দিকে যেতে যেতে, এতটুকু ইতস্তত না-করে আমার দিকে এসে কানের কাছে বলে ওঠে: আছে নাকি, মারিহুয়ানা? পিঠের কাছে ওর দ্রুত শ্বাসে এতটাই চমকে উঠি যে হাত থেকে গেলাসটা পড়ে যাচ্ছিল! তোমার সঙ্গে কি আগে পরিচয় হয়েছে? না, তবে আজকের রাতটা ফুল মস্তিতে কাটাতেই চাই। আমার সঙ্গে চলো। ওর হাত ধরে পার্টি থেকে বেরিয়ে এলাম। বাইরে এসে সামনের খোলা জায়গাটাতে দু’জনে বসলাম। তোমাকে কে এই পার্টিতে ইনভাইট করেছে? কেউ না, তোমাকে তো আগেই বলেছি একটু মস্তি করতে চাই। ইতিমধ্যে ওর হাতটা আমার হাঁটুর ওপর খেলতে শুরু করেছে, আর ঠোঁটের কোণ থেকে জিভটা সামান্য উঁকিঝুঁকি মারছিল।
সঙ্গে মালকড়ি কিছু আছে নাকি? মালকড়ি নেই, তবে সেক্স করার ইচ্ছেটা ভরপুর রয়েছে। যথেষ্ট নয়? হাসতে হাসতে আমি উঠে দাঁড়ালাম; দুজনে সরাসরি হেঁটে গিয়ে গাড়িতে চড়ে জেটির দিকে রওনা হলাম।
মারিহুয়ানায় আমার ঠিক জমে না, এতে মেজাজটা শুধু চড়ে যায়; এ ব্যাপারে কোকেনের তুলনা নেই। তোমার মাথায় এ সব ঢুকবে বলে মনে হয় না... এক ফোঁটা ভাল কোয়ালিটির সাদা গুঁড়ো কেনার মুরোদও নেই। মারিহুয়ানা কেবল ভিখিরিগুলোর জন্যে।
মেয়েটার বয়েস পনেরো বছর। ওর মা এক জন অ্যালকোহলিক, আর বাবা পুরুষত্বহীন। ওর একটা ছোট বোন আছে: তার নাম ডাফনে, তেরো বছর বয়েস। মারিয়ানাকে লোকে আড়ালে ছেনাল বলে ডাকে, তবে সে নিজের জন্য এলিজাবেথ নামটা ভারি পছন্দ করে। মোটেলে পৌঁছনোর পথে ওর গলা স্টিরিয়োর মিউজিকের থেকে আলাদা করা যাচ্ছিল না। তুমি একটা রক-ব্যান্ডে বাজাও, না? ফের এক বার হেসে কোনও জবাব না দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে এলাম।
‘রুম-নাম্বার সিক্স’, আমার হাতে কামরার চাবিটা গুঁজে দিতে দিতে মোটেলের লোকটা কানের কাছে ফিসফিস করে ওঠে। লিফ্টে উঠে কামরাটা খুঁজে নিলাম। দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতেই একরাশ মিশকালো অন্ধকার এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। বেশ কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে ধাতস্থ হয়ে নিতে নিতে একটা খুব প্রিয় সিনেমার কথা মনে পড়ে গেল; সেটার করিডরের দু’ধারের দেওয়াল ছবি দিয়ে ভর্তি। মারিয়ানাকে সে-কথা বলতে ও আমারই মতো একটা শুকনো হাসি হেসে জবাব দিল। পেন্টিং, কোন পেন্টিং? আমার চোখে তো কোনও পেন্টিং পড়েনি। ও কামরার দরজাটা বন্ধ করে দিল। |
দৃশ্য ৩
|
আমার হাত-দুটো রক্তে মাখামাখি। হাঁটুর কাছে একটা রেজর-ব্লেড একটা রক্তাক্ত দেহের কাছে পড়ে রয়েছে। চোখ তুলে দেখতে পেলাম মারিয়া খাটের ওপর থেকে আমার দিকে চেয়ে রয়েছে। একদৃষ্টে, যেমন করে কোনও মৃতপ্রায় মানুষ চেয়ে থাকে। ওর পায়ের মাঝে রক্ত, আর ফুলকাটা লিনেনের চাদরটা দেখে মনে হচ্ছে কেউ যেন প্রচণ্ড হিংসার সঙ্গে সেটাকে টকটকে লাল রঙের ছিটে দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছে। নিজের জামাকাপড় হাতড়ে পিস্তলটা পেলাম। আমার হাত বাতাস কেটে এগিয়ে গেল, যেন কোনও পেন্টব্রাশ মনোমতো রঙের খোঁজ করে বেড়াচ্ছে; আর সেটা খুঁজে পেল মারিয়ানার মুখে। পিস্তলের হ্যামারটা
টেনে ধরলাম, ও দিকে কামরার বাইরে চিৎকার-চেঁচামেচি কানে এল, সঙ্গে দরজায় সজোরে ধাক্কার শব্দ। মারিয়ানা আমাকে বোকার মতো একটা মৃদু হাসি উপহার দিল।
বিছানার ওপরে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে সিগারেটটাতে শেষ টান দিলাম। মারিয়ানা চুপটি করে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে। ও আমার বুকের ওপর শুয়ে কিছু একটা বলল, যেটা প্রায় শুনতেই পেলাম না। তোমাকে কিছু বলতে চাই: এমন একটা সত্য, যেটা কেবল তুমিই বুঝতে পারবে। যেটা কেউ জানে না, আর কারও জানার আবশ্যকতাও নেই; তুমি ছাড়া অন্য কারও। ঘাড় নেড়ে ওর কথায় সায় দিলাম, মারিয়ানার উষ্ণ শ্বাস একটা সরীসৃপের মতো আমার কানের কাছে এগিয়ে এল। কামরাটা দুমড়ে-মুচড়ে দলা পাকিয়ে একটা সর্পিল আকার নিল: আর নিমেষের মধ্যে আমার জীবনটা, গোটা জীবনটা, সেই মাতৃগর্ভে থাকার সময় থেকে এই মুহূর্ত পর্যন্ত চোখের সামনে একটা ভয়ংকর নির্বাক চলচ্চিত্রের মতো ভেসে উঠল। আর আমি, বন্দি আমি, যখন মারিয়ানা রুম-নাম্বার সিক্সের বাইরে বেরিয়ে দরজাটা টেনে দিল, তখন সেই মোটেলের করিডরের দু’পাশের কামরাগুলোর একটার ভেতর থেকে দেওয়াল ফেটে বেরিয়ে আসা আমার আর্ত চিৎকারে আকাশ-বাতাস খানখান হয়ে যাচ্ছিল। |
ছবি: সায়ন চক্রবর্তী |
|
|
|
|
|