|
|
|
|
|
|
|
কাঁচিবাবু |
যুগে যুগে বহু রূপে সেন্সর-এর আড়াই প্যাঁচ সিনেমাদের নুলো, খোঁড়া করে ছেড়েছে।
ক্ষমতা, বোকামি, শুচিবায়ু মিললে যা হয়।
গৌতম চক্রবর্তী |
যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন সব রথী-মহারথীরা বেরিয়ে গেলেন, কিন্তু সেন্সরের কাঁচিতে আটকে গেলেন ‘ভক্ত বিদুর’।
সন ১৯২১। কাঞ্জিভাই রাঠৌরের পরিচালনায় তৈরি হয়েছে কোহিনুর ফিল্ম কোম্পানির নির্বাক ছবি ‘ভক্ত বিদুর’। কোহিনুর সে যুগের নাম-করা ফিল্ম কোম্পানি। আগে ক্যামেরার সামনে হাতে-আঁকা ছবিতে সেট তৈরি হত। কোহিনুরই সেই ব্যবস্থা পাল্টায়। তার মালিক, নায়ক দ্বারকাদাস সম্পতের উদ্যোগে ভারতীয় সিনেমায় প্রথম চালু হয় কাঠের সেট।
‘ভক্ত বিদুর’ সিনেমায় বিদুর কৌরবদের উপদেশ দিলেন, ‘পাণ্ডবদের উপর তোমরা যত অত্যাচার করবে, ওরা ততই শক্তিশালী হবে। অত্যাচার করে হস্তিনাপুরের সাম্রাজ্য টিকে থাকবে না।’ যুধিষ্ঠিরকে বললেন, ‘বারো বছর বনবাসের কষ্ট সহ্য করেছ, কিন্তু জয় হবে তোমারই। ন্যায়, সত্য আর অহিংসাই টিকে থাকবে, কৌরবদের অত্যাচার নয়।’ পর্দায় বিদুরবেশী দ্বারকাদাসের পরনে তখন খদ্দরের হেঁটো ধুতি ও চাদর। মহাকাব্যের রূপক, না রাজনীতি?
সনটা ভয়ঙ্কর। সে বড় সুখের সময় নয়। মাত্র বছর দুয়েক আগে আইন অমান্য, চৌরিচৌরা, জালিয়ানওয়ালাবাগ অনেক কিছু ঘটে গিয়েছে।
গণ-আন্দোলনে উঠে আসছেন চরকা-কাটা, হেঁটো ধুতি এক নেতা: মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী। করাচি ও মাদ্রাজ শহরে (চেন্নাই) সেন্সর ছবিটি সিনেমা-হলেই আসতে দিল না। করাচির জেলাশাসক জানালেন, ছবিটি সরকারের বিরুদ্ধে ইন্ধন জোগাবে, লোককে অসহযোগ আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করবে।
অতএব, ছবি আটকানো ছাড়া গত্যন্তর নেই। সরকারি ফাইলে তাঁর মন্তব্য, ‘It is likely to excite disaffection against the government and incite people to non cooperation.’ শাসকদের বিরুদ্ধে কথা বললে সিনেমাকে কাঁচি করা হবে, এ জিনিস ভারতীয় সভ্যতায় ব্রিটিশ শাসকের অবদান!
সেই ট্র্যাডিশন, স্বাধীনতার পরেও! খদ্দর নিয়ে প্রশ্ন নেই, কিন্তু গাঁধী-টুপি তখন বিপজ্জনক! ১৯৫৮ সালে সত্যজিৎ রায়ের ছবি ‘পরশ পাথর’। তুলসী চক্রবর্তী লোহাকে সোনা বানিয়ে আচমকা বড়লোক হয়ে গিয়েছেন, ককটেল পার্টিতে গাঁধী-টুপি পরে এসেছেন, তাতে সেন্সরের আপত্তি। সত্যজিৎ স্বাধীনতার পরে ‘নব্য বড়লোক’ সংস্কৃতিকে ওই দৃশ্যে ধরেছেন। কিন্তু সেন্সরকর্তাদের বোঝায় কে? পরিচালককে বলা হল, ‘সাদা টুপি বাদ দিন, কিংবা কালো করে দিন। তা হলে আর ঝামেলা থাকবে না।’ সত্যজিৎ মোক্ষম দুটি যুক্তি দেখিয়েছিলেন। এক, বাঙালি হিন্দু ভদ্রলোক কালো টুপি পরে না।
দুই, তাঁর নায়ক পরেশ দত্তের ভূমিকায় যে অভিনেতা, সেই তুলসী চক্রবর্তীর মাথায় টাক। বড়লোক হয়ে ককটেল পার্টিতে এসে পরেশ দত্ত তো টুপি পরে টাক ঢাকার চেষ্টা করবেনই! সেন্সর ঝামেলা না বাড়িয়ে ছবি ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু গাঁধী-টুপি নিয়ে আপত্তিই প্রমাণ করে, শাসকের চেহারা বদলালেও চিন্তাধারা বদলায় না।
|
|
শাসক মানে শুধু ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল নয়। রাষ্ট্র, আমলাতন্ত্র সব মিলিয়ে মাকড়সার জালের মতো ব্যাপক ক্ষমতা। ১৯৫৯ সালে মুক্তি পায় মৃণাল সেনের ‘নীল আকাশের নীচে’। কলকাতায় অভিবাসী চৈনিক নাগরিক ওয়াং লু-র জীবন। হঠাৎ ১৯৬২-তে ছবিটি নিষিদ্ধ হয়ে গেল! তখন ভারত-চিন যুদ্ধ শুরু হয়েছে। ছবিটিতে কেন চিনা মানুষের প্রতি সহমর্মিতা? পার্লামেন্টে হীরেন মুখোপাধ্যায় জোর তর্ক করলেন, কেন ছবি নিষিদ্ধ হল? নেহরু শুনে স্তম্ভিত। তাই বুঝি, ব্যান হয়েছে? তাঁর নির্দেশে নিষেধাজ্ঞা উঠে গেল। প্রচার পেয়ে তিন বছর আগের ছবি আবার রিলিজ করল, বেশ ক’সপ্তাহ চলল। মৃণাল সেনের আত্মজীবনী-তে একটি ছবি রয়েছে, ফিল্মটির জন্য তিনি ও প্রযোজক হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রী নেহরুর হাত থেকে পুরস্কার নিচ্ছেন। ছবিটি দেখে নেহরুর ভালও লেগেছিল। কিন্তু সেন্সর নাহি শোনে ধর্মের কাহিনি!
সেন্সর কী শোনে এবং বলে, হদিশ পাওয়া ভার! সপ্তাহ কয়েক আগে যেমন এক বাংলা ছবি আটকানোর ব্যাপারে ‘উদাসীনতা’ বলে একটি নতুন যুক্তির কথা শোনা গেল। ছবিতে মুখ্যমন্ত্রীর শপথগ্রহণ দেখতে দেখতে এক ফ্যাতাড়ু বাঁকা হেসে বিড়ি ধরায়। জনৈক পরিচালক-কাম-সেন্সরসদস্য যুক্তি দিলেন, লক্ষ লক্ষ মানুষ যাঁকে ভালবেসে ভোট দিয়ে মুখ্যমন্ত্রিত্বে নিয়ে এসেছেন, তাঁকে নিয়ে এই ঔদাসীন্য দেখানো যায় না। মানুষ খেপে গিয়ে বিশৃঙ্খলা বাধাবে। শুনতে শুনতে সত্যজিৎ রায়ের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ছবির কথা মনে পড়ছিল। ১৯৭০ সালের সেই ছবিতে বেকার নায়ক সিদ্ধার্থ (ধৃতিমান) সিনেমা-হলে ঢুকেছে। পর্দায় তখন ফিল্মস ডিভিশনের তথ্যচিত্র, বাজেট পেশ করছেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী। সিদ্ধার্থ দেখতে দেখতে হাই তোলে, চেয়ারে বসেই ঘুমিয়ে পড়ে। মানুষের ভোটে জিতে যিনি প্রধানমন্ত্রী হলেন, তাঁর প্রতি উদাসীনতা? সেই আমলে সেন্সরকর্তার মাথায় প্রশ্নটি আসেনি, সত্যজিৎও রেহাই পেয়ে গিয়েছিলেন। রাজনৈতিক ক্ষমতাকে তুষ্ট রাখতে সেন্সর প্রতিনিয়ত নতুন যুক্তির সৃষ্টি করে।
রাজনৈতিক কারণেই এ দেশে ‘লুকনো সেন্সর’। যত দিন গিয়েছে, এর প্রাবল্য বেড়েছে। ঝামেলা না করে ছেড়ে দেওয়া হল, কিন্তু ক্ষমতাসীনদের পছন্দ না হলে দর্শকের সামনে ছবি আসবে না। যেমন, গুজরাত দাঙ্গা নিয়ে রাহুল ঢোলাকিয়ার ছবি ‘পরজানিয়া’। অমডাবাদের এক হাউজিং সোসাইটিতে দাঙ্গাবাজরা ঢুকে পড়েছে। সারিকা দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে কোনও ক্রমে বাঁচার চেষ্টা করেন। ছেলেটি হারিয়ে যায়, তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। সত্য ঘটনা অবলম্বনে তৈরি এই ছবির শেষে পর্দায় আজহার নামে এক বালকের ছবি ভেসে ওঠে। তাকে তার মা-বাবা আজও খুঁজে বেড়াচ্ছেন, সন্ধান পেলে দর্শকরা যেন জানান। সেন্সর প্রথমে নানা টালবাহানা করছিল। পরে ছাড়পত্র পাওয়া গেল, কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর রাজ্যেই ছবি দেখানো গেল না। শাসক বিজেপির সমর্থনে বজরং দল গোপনে মাল্টিপ্লেক্স-মালিকদের হুমকি দিল। গুজরাতের মাল্টিপ্লেক্স-মালিকেরা বললেন, ছবিটি ‘কমার্শিয়ালি ভায়াব্ল’ নয়। গুজরাত সরকার বলল, মাল্টিপ্লেক্স-মালিকেরা বাণিজ্যিক ভাবে কী ছবি চালাবেন আর চালাবেন না, সেই বিষয়ে তাঁদের হাত নেই। জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত ‘পরজানিয়া’ তাই গুজরাতে মুক্তি পায়নি।
এই যে সেন্সর হওয়ার পরেও ছবি চালাতে দেব না...এই বিষয়ে মেরা ভারত মহান! ‘ফানা’ ছবি রিলিজের আগে গুজরাতের সর্দার সরোবর বাঁধের কারণে ছিন্নমূল মানুষদের পক্ষে কথা বলেছিলেন আমির খান। সুপ্রিম কোর্ট সে সময় বলেছিল, আইনশৃঙ্খলা রাজ্যের দায়িত্ব। যদি কোনও সিনেমা হল বা মাল্টিপ্লেক্স ‘ফানা’ চালানোর জন্য পুলিশি সহায়তা চায়, গুজরাত সরকারকে দিতে হবে। পরে দেখা গেল, শুধু জামনগরের একটি হলে রিলিজ করেছে ছবি।
মতে না মিললে, তাই সেন্সরের পরও ছবির মুক্তি নেই। রি-সেন্সর করতে হবে! ১৯৯৬ সালে দীপা মেটার ‘ফায়ার’ ছবি রিলিজের পর শিবসেনা, বজরং দল মহারাষ্ট্রের হলগুলিতে ভাঙচুর চালায়। তাদের দাবি, নারীদের সমকামিতার দৃশ্য দেখিয়ে ভারতীয় সংস্কৃতি বিনষ্ট করা যাবে না। ‘সেন্সর্ড’ ছবিকে তখন ফের সেন্সরে পাঠানো হয়। তবে, সে বারেও ছবিটি অক্ষত থাকে।
এই ‘রি-সেন্সর’ নামের উদ্ভট ঘটনাটিই বুঝিয়ে দেয়, শিল্পবিচার-টিচার বাজে কথা। রাজনৈতিক খেলাই সব! আমির খানের ‘রং দে বসন্তী’ সেন্সর সার্টিফিকেট পাওয়ার পরেও আটকে গিয়েছিল। ছবিতে দেখানো হয়েছিল, দুর্নীতিগ্রস্ত নেতারা নিম্নমানের ফাইটার প্লেন কেনায় মদত দিচ্ছেন। আর সেই ফাইটার থেকে বিমানবাহিনিতে একের পর এক দুর্ঘটনা! তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় স্থল, নৌ এবং বিমান-বাহিনীর তিন প্রধানের সঙ্গে বসেন ‘সেন্সর্ড’ ছবিটির পুনর্বিচার করতে, এবং ছবিটি অক্ষত ভাবে মুক্তি পায়।
এই যে ‘একা সেন্সরে রক্ষা নেই, রি-সেন্সর দোসর’, এটি ভিতরে ভিতরে সত্তর দশক থেকে চলছে। ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থার বছরে রিলিজ করে গুলজারের ‘আঁধি’। এবং কয়েক দিন বাদে ‘সেন্সর্ড’ ছবি হল থেকে তুলে নেওয়া হয়। সুচিত্রা সেনের চরিত্রটি নাকি ইন্দিরা গাঁধীর আদলে তৈরি! কয়েক মাস পরে প্রধানমন্ত্রীর কানে খবরটা পৌঁছয়। তিনি নিজে ছবিটি দেখেন, এবং মুক্তি দিতে বলেন। তত দিনে গুজব যা ছড়ানোর, ছড়িয়ে গিয়েছে। ১৯৭৭ সালে জনতা দল ক্ষমতায় আসার পর শুরুর দিকেই দূরদর্শনে দেখানো হয় ‘আঁধি’।
সেন্সরের ইতিহাস ঘাঁটতে বসলে দেখা যাবে, জরুরি অবস্থার সময়টি সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং। এক দিকে সঞ্জয় গাঁধীকে সমর্থন না করার জন্য মুম্বইতে বিরোধী চলচ্চিত্রকারেরা হয়ে যাচ্ছেন প্রায় একঘরে। অন্য দিকে ’৭৬ সালে রিলিজ করছে সত্যজিতের ‘জন অরণ্য’। দেওয়ালে লেখা ‘চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান’। পর ক্ষণেই সেটি মুছে ইন্দিরার আধখ্যাঁচড়া মুখ এঁকে স্টেনসিলে ‘এশিয়ার মুক্তিসূযর্’। মারি সিটন তাঁর বইয়ে জানাচ্ছেন, প্রাইভেট স্ক্রিনিং-এ এক কংগ্রেস নেতা দৃশ্যটি দেখে ঘামছিলেন। এখন নেতা-নেত্রীদের কার্টুন আঁকলে শুধু সেন্সরে কুলোয় না, হাজতবাসও করতে হয়। কিন্তু ‘জন অরণ্য’-এর দৃশ্যটি সেন্সর বাদ দেয়নি, উল্টে সেই বছর সেরা ভারতীয় পরিচালক হিসাবে স্বর্ণকমল পান সত্যজিৎ। নিজেকে সংস্কৃতিপ্রেমিক প্রমাণের জন্য চেঁচানোর দরকার নেই, বহুত্ববাদ ও গণতান্ত্রিক বিরোধিতার শর্ত মেনে সম্মান জানালেই হয়।
বহুত্ববাদ শুধু নেতা-নেত্রীদের দায়িত্ব নয়। লেখক, শিল্পী সকলের। ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’র সেন্সর-কাহিনি যেমন! তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তখন সেন্সর বোর্ডে, ছবি তাঁর ভাল লাগেনি। ‘দূর! সরকার উদ্বাস্তুদের জন্য এত সাহায্য দিচ্ছে, সেগুলি বলা হল না?’ তারাশঙ্কর তখন কংগ্রেসের মনোনীত সাংসদ, তাঁর কথাই চূড়ান্ত। বেগতিক দেখে তাঁকে ধরলেন বিষ্ণু দে। রাজনৈতিক বিশ্বাসে তিনি তারাশঙ্করের উল্টো পথে। কিন্তু তাঁর অনুরোধে তারাশঙ্কর মত বদলান, দু’তিনটি সংলাপ কেটে ছবি ছেড়ে দিতে বলেন। সেন্সর-সদস্য শিল্পীদের মধ্যে তখন ‘আমরা-ওরা’ ছিল না।
কাঁচি-আস্ফালনে ডান-বাম কেউই ব্যতিক্রম নয়। নন্দন-এ এক ফাঁসুড়ের জীবন নিয়ে জেসি জোসেফের ছবি। পোস্টারও পড়ে গিয়েছে। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নন্দনে ঢুকছেন, নজরে পড়ে গেল সেটি। রাতেই পোস্টার, বিজ্ঞাপনী-স্টিল সব উধাও, ফাঁসুড়ের জীবন আর পর্দায় এল না। কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে লেনিনের জীবনের শেষ পর্ব নিয়ে রুশ পরিচালক সকুরভের ‘টরাস’ দেখানো হল। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নিজে সেই ছবি বাছাই করেছিলেন, কিন্তু পর দিন আলিমুদ্দিনের প্ররোচনায় কমরেডরা নন্দন-চত্বরে নেমে পড়লেন। অথর্ব লেনিনকে কেন নগ্ন দেখানো হল? কান, বার্লিনে যা হয়নি, বামশাসিত বঙ্গে সেটিই ঘটল। ছবির বাকি শো বন্ধ, ফেস্টিভ্যালে রাজনৈতিক কাঁচিবাবুদের হানা।
অবশ্য, জাতীয়তাবাদী নেতারাও সুযোগ পেলেই কাঁচির শরণাপন্ন হতেন। ১৯৩৬ সালে মুক্তি পেয়েছিল চারু রায়ের ‘বাঙালি’। মধ্যবিত্ত পরিবারে মা, বাবা ও তাদের চার ছেলেকে নিয়ে গল্প। জিনিসের দাম ক্রমে আগুন, এক ছেলেই চাকরি করে। বাকিরা কেউ নাটক করে, কেউ লিখতে চায়। বাবা এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মেয়ের পিছনে ঘুরঘুর করেন। সত্যজিৎ রায় তাঁর ‘বিষয় চলচ্চিত্র’ বইয়ে ছবিটির প্রবল প্রশংসা করে জানিয়েছেন, সেই আমলের একমাত্র রিয়ালিস্ট সিনেমা। অথচ, তিরিশের দশকে সেই ছবি অস্ট্রিয়ায় গেলে কী কাণ্ড! সুভাষচন্দ্র বসু তখন ভিয়েনায়। তিনি শহরের মেয়রকে ছবিটি নিষিদ্ধ করার অনুরোধ জানালেন। ওই ছবি দেখলে নাকি বাঙালিদের সম্বন্ধে খারাপ ধারণা তৈরি হবে!
সুভাষ অবশ্য ব্যতিক্রম নন। সিনেমায় যৌনতা নিয়ে সংস্কার তারও আগে থেকে চলছে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও নিস্তার পাননি। ১৯২৯ সালে ‘ক্রাউন’ সিনেমায় মুক্তি পায় রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্প অবলম্বনে শিশির ভাদুড়ির ছবি ‘বিচারক’। মুক্তির কয়েক দিন পরেই সেটি হল থেকে তুলে নেওয়া হয়। ক্ষীরোদা-র যৌনকর্মী হয়ে যাওয়াটা মেনে নিতে পারেনি তৎকালীন সেন্সর, নোবেলজয়ী লেখকের গল্প নিয়ে তাদের রায়: low moral tone। রবীন্দ্রনাথ এ বিষয়ে নীরবতা অবলম্বন করেছিলেন। কিন্তু সে সময়ের ‘চিত্রলেখা’ পত্রিকা ‘বাংলা সেন্সর বোর্ড ও বিচারক’ নামে লেখা ছাপে, সেন্সরকে ফের ছবিটি নিয়ে ভাবার জন্য অনুরোধ করা হয়। তিন বছর বাদে ছবিটিকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়।
যৌনতার কথা এসেছিল ১৯২৮ সালে ‘ইন্ডিয়ান সিনেমাটোগ্রাফ কমিটি’র রিপোর্টেও। এই কমিটিই আজকের সেন্সর বোর্ডের পূর্বসূরি। ব্রিটিশ ও মার্কিন ছবি দেখে সেখানকার জীবনযাত্রা নিয়ে যাতে নেটিভদের মনে অসন্তোষ না হয়, তারা যাতে না ভাবে দেশজ সংস্কৃতি নষ্ট হচ্ছে, সেই কারণেই কমিটি। কমিটির সুপারিশেই তো কাটছাঁট করে মুক্তি পাবে ব্রিটিশ ও হলিউডি ছবি। মহাত্মা গাঁধী, লালা লাজপত রায় থেকে দাদাসাহেব ফালকে অনেককেই জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল সেই কমিটি। গুজরাতি ‘জাম ই জামশিদ’ কাগজের সম্পাদক ফিরোজ শাহ মার্জওয়ানের সঙ্গে কমিটির কথোপকথন:
প্রশ্ন: ভারতীয় ছবিতে কি চুমু থাকা উচিত?
ফিরোজ: না।
প্রশ্ন: কেন? ভারতীয়রা কি চুমু খায় না?
ফিরোজ: প্রকাশ্যে নয়।
প্রশ্ন: তা হলে প্রেমের দৃশ্য বাদ দিতে হবে? সে ক্ষেত্রে সিনেমাটি তো অন্তঃসারহীন হয়ে দাঁড়াবে।
ফিরোজ: প্রেমের দৃশ্যে... থাকতে পারে। লং কিস, প্রোলংগড কিস, হট কিস, সফ্ট কিস কত চুমুই তো আছে! কিন্তু সব পর্দায় দেখানো যায় না। অন্য ভাবে বোঝাতে হয়।
মার্জওয়ানের উত্তরসূরিরা এই বঙ্গেও আছেন। ‘অন্তরমহল’ ছবির সেন্সর চলছে। পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ প্রথম প্রহরেই বেড়াল মেরে দিলেন। সফ্ট টয় দেখিয়ে জানালেন, ‘এই বেড়ালটা মারা হয়েছে। আসল বেড়াল নয়।’ সেন্সরকর্তারা খুশি হয়ে বললেন, ‘তা হলে বেড সিনগুলি একটু কেটে দিন। অতগুলি শয্যাদৃশ্য অ্যালাও করা যাবে না।’
যৌনতা ও হিংসা সম্পর্কে সেন্সরের এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে শুধু পরিচালক বা প্রযোজক নয়, নায়ক-নায়িকাদেরও সতর্ক থাকতে হয়। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় বলছিলেন, ‘মারপিটের দৃশ্যে অকারণে কত শট যে দিতে হয়! মনিটরে দেখার পর কেউ বললেন, বুম্বাদা, রক্তটা বেশি হয়ে গিয়েছে। সেন্সর আটকাবে। কম রক্ত নিয়ে আর একটা শট রাখি, কেমন?’ ফের নতুন করে রক্ত পড়ার মেক-আপ এবং শট দেওয়া! শুধু রক্ত নয়। মারপিটের দৃশ্যে আগে শব্দও নিয়ন্ত্রণ করতে হত। বেশি জোরে ঘুষি মারার শব্দ হলেই সেন্সর কাঁচি চালাত।
সিনেমা, সেন্সর নিয়ে বললে গান কি আর বাকি থাকে? অনেকেই আজকাল ‘শীলা কি জওয়ানি’ বা ‘তন্দুরি চিকেন’ শুনে বাঁকা চোখে তাকান। সেন্সর এ সব গান ছাড়ে কী ভাবে? কিন্তু ‘ডাব্ল মিনিং’ যে কত কাজে লাগে! ১৯৪৩ সালে কলকাতার রক্সি-তে রিলিজ করল অশোককুমারের ‘কিসমত’। টানা তিন বছর চলে রেকর্ড! ছবির একটি গানে বলা হত, ‘দূর হটো, দূর হটো দুনিয়াওয়ালো, হিন্দুস্থান হমারা হ্যায়।’ এক অফিসারকে গানটা নিয়ে রিপোর্ট দিতে বলা হল। যুদ্ধের বাজার, ‘ভারতরক্ষা আইন’-এর ২৬ নম্বর ধারায় গীতিকারের জেল সুনিশ্চিত। ভারতীয় অফিসারের রিপোর্ট এল, গানটি মোটেই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে নয়। ‘তুম না কিসিকে আগে ঝুকনা, জার্মান হো ইয়া জাপানি’ লাইন আছে। এটি জার্মানি ও জাপানের বিরুদ্ধে গান।
সেন্সরের কাঁচি তাই রক্তকরবীর রাজার মতো। মাঝে মাঝে সর্দারদের চোখকে ফাঁকি দেওয়া যায়। কিন্তু জালের আড়ালে থাকেন সর্বশক্তিমান। সিনেমা, শিল্পবোধ সব কিছুকেই নতজানু করে ছাড়েন তিনি। |
(কৃতজ্ঞতা স্বীকার: সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়) |
|
|
|
|
|