|
|
|
|
|
শহরে-গাঁয়ে অলিগলি তেতে বড় ম্যাচের আঁচে
অভিষেক চট্টোপাধ্যায় ও প্রকাশ পাল • কলকাতা |
|
দু’টো প্রশ্ন কখনও পুরনো হয় না। ‘তুমি কি আমায় ভালবাস?’ যদি তার একটা হয়, আর একটা অবশ্যই ‘মোহনবাগান না ইস্টবেঙ্গল?’
আজ, রবিবার ফের মুখোমুখি হচ্ছে দুই চিরশত্রু। বঙ্গদেশের আনাচে-কানাচে চড়ছে উত্তেজনার পারদ, যার পোশাকি নাম ‘ফুটবল আবেগ’। যা কি না প্রতি বড় ম্যাচের আগে-পরেই উপচে পড়ে।
গত বছর ফেডারেশন কাপ হয়েছিল শিলিগুড়িতে। সেখানকার মোহনবাগানীরা তৈরি করান ১২ ফুটের পতাকা। ‘লাল-হলুদ শহর’ যার অন্য নাম, সেই শিলিগুড়িতে সবুজ-মেরুনের এই ঔদ্ধত্য মানতে পারেননি ইস্টবেঙ্গল সমর্থকেরা। তাঁরা ১৫ ফুট পতাকা বানান। মোহনবাগানীরা কি ছাড়ার পাত্র? গাঁটের কড়ি খসিয়ে এ বার সবুজ-মেরুন পতাকা ২৫ ফুটের!
শেষ পর্যন্ত হেরে যায় মোহনবাগান। ফেডারেশন কাপ চ্যাম্পিয়ন হয় ইস্টবেঙ্গল। তার পরে? ঘরের ছেলে বনদীপ গুঁই চওড়া হাসেন, “গোটা শহর লাল হলুদ পতাকায় মুড়ে দেওয়া হয়েছিল।”
পাহাড় ছেড়ে এ বার জঙ্গলমহল।
যে কোনও বড় ম্যাচের দিন ঝাড়গ্রাম শহরের জুবিলি বাজার বা কোর্ট রোডে গেলে মনে হবে, যুদ্ধ বাধল বলে! পতপত করে উড়ছে দু’দলের পতাকা। চোখে পড়তে পারে বাইক-বাহিনীও। বাইকের সামনে বাঁধে লাল-হলুদ কিংবা সবুজ-মেরুন এক চিলতে কাপড়। ম্যাচের শেষে আবির খেলা। মোহনবাগান যখন প্রথম বার জাতীয় লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়, একটি ট্রাককে সবুজ-মেরুন পতাকায় সাজিয়ে ঘোরানো হয়েছিল গোটা শহর মনে আছে প্রাক্তন ফুটবলার সৌমেন মাহাতোর। |
|
এই প্রবল আবেগ ফুটে বেরোয় জামাকাপড়ে, জুতোয়, রং বাছাবাছির নজরেও। “একটি বিখ্যাত জুতো সংস্থার থিম রং লাল-হলুদ হওয়ায় সেই সংস্থার জুতো কিনি না আমি”জানিয়ে দেন হুগলির শ্রীরামপুরের মোহন-সমর্থক ভাস্বর গঙ্গোপাধ্যায়। বর্ধমান রাজ কলেজের ইংরেজি অনার্সের ছাত্র শুভম দত্ত জানালেন, “আমাদের এখানে বাবুসোনাদা বলে এক মোহনবাগান সমর্থক রয়েছেন যিনি সবুজ-মেরুন ছাড়া কোনও রঙের পোশাক পড়েন না। তাঁর সাইকেলের ব্রেকের রংও সবুজ-মেরুন!”
হুগলির গৌরনিতাই সাহা ওরফে রাষ্ট্রপতিদা তো আবার ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের কাছে প্রায় ‘মিথ’ হয়ে গিয়েছেন। পেশায় বাসন বিক্রেতা এই মানুষটি দল জিতলেই বিনা পয়সায় বাসন ভাড়া দিতেন বনভোজনের জন্য। ২০০৫ সালে তিনি মারা যান। তাঁর শ্রাদ্ধবাসরের মণ্ডপের রং ছিল লাল-হলুদ।
খবরের কাগজ বিক্রেতা, হুগলির সুশান্ত মণ্ডল ওরফে খ্যাপার কথা না বললে আবার মোহন-সমর্থকদের রাগ হওয়া স্বাভাবিক। মোহনবাগানের খেলা দেখতে তিনি প্রথম মাঠে যান দশ বছর বয়সে। সেই শুরু। ১৯৮৭ সালে সপ্তম শ্রেণির বার্ষিক ভূগোল পরীক্ষা না দিয়ে মোহনবাগান মাঠে ইস্টার্ন রেলের সঙ্গে দলের খেলা দেখতে চলে গিয়েছিলেন তিনি। তাঁর কথা সত্যি হলে, দলের খেলা দেখার জন্যই খবরের কাগজ বিক্রির কাজ বেছে নিয়েছেন চল্লিশ পেরোনো মানুষটি। কেননা ভোরের দিকে কোনও খেলা থাকে না।
এমন খেলা-পাগল হলে জীবন গোল্লায় যাবে ভয় দেখান বাবা-মা। সত্যিই কি তাই?
আশির দশকে অজয় নামে একটি কিশোর স্কুল পালিয়ে মোহনবাগানের খেলা দেখতে গিয়ে ধরা পড়েছিল চেকারের হাতে। প্রিয় দলের খেলা দেখতে যেতে দেওয়ার বদলে সন্ধ্যে পর্যন্ত চেকার পড়া ধরেছিলেন তাঁর। সেই কিশোরই আজ বৈদ্যবাটির পুরপ্রধান অজয়প্রতাপ সিংহ। উত্তর ২৪ পরগনার প্রাথমিক শিক্ষক সৌমেন চাকি তুমুল মোহনবাগান। রিষড়া থানার ওসি দেবাঞ্জন ভট্টাচার্য আবার ইস্টবেঙ্গল শিবিরের লোক। দলের খেলা থাকলে তাঁদের কাছে কে-ই বা ছাত্র আর কে-ই বা আসামি!
দমদমের এক ইস্টবেঙ্গল সমর্থক শিক্ষকের কথা না বললেই নয়, যিনি ছাত্রছাত্রী টিউশন পড়তে এলেই চুপিচুপি জেনে নেন সে লাল-হলুদ না সবুজ মেরুন। যদি লাল-হলুদ হয় তো বেতন আধা। পুরো মকুব হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। সবুজ-মেরুন হলে ‘নো ডিসকাউন্ট’।
ছায়াযুদ্ধ চলছে ইন্টারনেটেও।
নীলাঞ্জন ওডাফা মুখোপাধ্যায়, প্রিয়া মোহনবাগানী ঘোষ, অরিতা মোহনবাগান পাল, আহসান সবুজ-মেরুন হাবিবদের সঙ্গে লড়াই চলে প্রিয়ব্রত মেহতাব সরকার, নীলোৎপল ইস্টবেঙ্গল বসাক, বিমল বাঙাল চৌধুরী, অনিমেষ লাল-হলুদ ঘোষের। বড় ম্যাচের কয়েক দিন আগে থেকেই পোস্টে-পোস্টে ভরে উঠতে থাকে ফেসবুকের দেওয়াল।
গত পুজোয় ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়ে কলকাতার একটি নার্সিংহোমে ভর্তি ছিলেন ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের সংগঠন ‘রিয়্যাল পাওয়ারে’র কর্তা রবিশঙ্কর সেন। হঠাৎ প্রয়োজন পড়ে রক্তের। তা ফেসবুকে পোস্ট হওয়ার আধঘণ্টার মধ্যে পঞ্চাশ জনেরও বেশি সমর্থক এসে রক্ত দিয়ে যান জানাচ্ছেন রবিশঙ্করবাবু নিজেই। বছর কয়েক ধরে আবার শেওড়াফুলিতে রক্তদান শিবির করছে ওই এলাকার মোহনবাগান ফ্যানস ক্লাব।
বাঙালির যে রক্তে ফুটবল! |
|
|
|
|
|