|
|
|
|
প্রবন্ধ... |
চলবে |
রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কথা বলছে, রাষ্ট্রকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছে, তাকে নিয়ে বিদ্রুপ করছে,
তবু দিব্যি সিনেমা চলছে। হয়তো রাষ্ট্রের কৌশল। হয়তো ‘উদারতার দম্ভ’।
তবু বলব, সালাম গণতন্ত্র। লিখছেন
শিলাদিত্য সেন |
এক রোববার, বসন্তের বিকেলে বেশ আমোদ হল বাল্যবন্ধুর সঙ্গী হয়ে ‘স্পেশাল ২৬’ দেখে। আমার বন্ধুটি অবশ্য মুখ হাঁড়ি করে বললে, ‘এ-ছবি সেন্সর-এ ছাড়া পেল’? তাকেও দোষ দিই না। কমেডির মোড়কে গোটা ছবিটাই রোমহর্ষক প্রতারণার গল্প। মন্ত্রী আর ব্যবসায়ীদের চোরাই টাকা-ধনসম্পত্তি সিবিআই’কে ফাঁকি দিয়ে, এমনকী তাদেরও শামিল করে কী ভাবে হাতিয়ে নিচ্ছে এক দল মানুষ, আপনার-আমার মতোই সাধারণ মানুষ, তা নিয়েই ছবি। একেবারে নাকে ঝামা ঘষে দিয়েছে ভারত সরকারের পুলিশ, প্রশাসন, গোয়েন্দা দফতরের।
পরিচালক নীরজ পাণ্ডের কাছ থেকে প্রথম যখন ছবিটার প্লট জানতে পারেন অনুপম খের, এ ছবির অন্যতম প্রধান অভিনেতা, লিখছেন: ‘I was staggered by its audacity.’ (‘আমি এর স্পর্ধায় স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেম।’) আরও লিখেছেন: ‘সিনেমা মানুষের আচরণে প্রভাব ফেলে কি না, অপরাধে উৎসাহ দেয় কি না, এই ধরনের ছবি উপলক্ষেই সেই বিতর্ক ওঠে’। অনপুমের সংশয়ের কথা আগে জানতে পারলে এ ছবিকে হয়তো আটকাত সেন্সর বোর্ড। তাদের বহুবিধ নির্দেশিকার মধ্যেই আছে: অসামাজিক কাজকর্মকে যেন মহীয়ান না করা হয়, দুষ্কৃতীদের কাজকর্মকে যেন বিশদ ভাবে চলচ্চিত্রায়িত না করা হয়, ইত্যাদি।
নীরজ এর আগে ‘আ ওয়েডনেসডে’ নামে যে ছবিটি করেছিলেন, তাতেও এক ব্যক্তি, মুম্বইয়ের লোকাল ট্রেনে সন্ত্রাসবাদীদের বিস্ফোরণের বদলা নিতে, পুলিশ-প্রশাসনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে একাই ‘খতম’ করে দিয়েছিল দুষ্কৃতীদের। এই প্রতিশোধস্পৃহা সুজয় ঘোষের ‘কহানি’তে বিদ্যার মধ্যেও ছিল। |
|
উপরে বাঁ দিক থেকে: শূন্য অঙ্ক, কহানি, এক থা টাইগার
নীচে বাঁ দিক থেকে: হাজারোঁ খোয়াইশেঁ অ্যায়সি, স্পেশাল ২৬, আ ওয়েডনেসডে |
সে-ও গোয়েন্দা দফতর, পুলিশকে কাজে লাগায়, আবার বোকাও বানায়।
ঘটনা এই যে, নতুন শতকে বেশ কিছু জনপ্রিয় হিন্দি সিনেমায় রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে নস্যাৎ করে দেওয়া বা তাতে নানা ধরনের অন্তর্ঘাত ঘটানোর গল্প দেখেছি আমরা, তাদের মধ্যে দিয়ে শুনেছি রাষ্ট্রস্বরের বিপরীতে নাগরিকস্বরের চ্যালেঞ্জ ঘোষণা। কখনও সেই অন্তর্ঘাত বা চ্যালেঞ্জ ‘মহৎ’ উদ্দেশ্যে, কখনও নিতান্ত ব্যক্তিগত প্রতিবাদ বা প্রতিশোধের তাগিদে, কখনও বা একেবারেই অসৎ স্বার্থসিদ্ধির জন্য, যেমন ‘স্পেশাল ২৬’ সিনেমায়। কিন্তু ভাল-মন্দ বা ন্যায়-অন্যায়ের বিচার সরিয়ে রেখে একটা কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় রাষ্ট্রের অচল সিস্টেম-এর বিরুদ্ধে হালের বলিউডি ছবিতে ব্যক্তি-নাগরিকের জেহাদ চোখে পড়ার মতোই। এবং সেই কারণেই এটা খুব তাৎপর্যপূর্ণ যে, রাষ্ট্র এবং তার সেন্সর ব্যবস্থা এই সব ছবিকে দিব্যি ছেড়ে দেয়, ছেড়ে দিয়েছে।
বলিউডের ‘বাজারি’ ছবির নিন্দায় যাঁরা নিরন্তর তত্ত্বে শান দেন, তাঁদের বক্তব্য: রাষ্ট্রের পরোক্ষ প্রশ্রয়ে এ সব ছবি সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র পায়, যাতে বিনোদনে বুঁদ হয়ে থাকতে পারে দর্শক, যাতে সেই মেকি ‘রাষ্ট্র-বিরোধিতা’র নেশা তাদের সত্যিকারের প্রতিবাদের পথ থেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখতে পারে, এবং যাতে বহুদিন ধরে বহুদূর পর্যন্ত বাণিজ্যের বিস্তার করতে পারে ছবিগুলো আর সেই বাণিজ্যের আশীর্বাদে প্রযোজকের কাছ থেকে কর-মাসুলের তুমুল ফসল তুলতে পারে সরকার। মানে, শুধু ভুলিয়ে রাখা নয়, অমনি কিছু রোজগারও হল।
হতেই পারে, কিন্তু তাতে আমাদের অসুবিধেটা কোথায়? বাজারই তো আমাদের সেই গণতান্ত্রিক পরিসরটুকু দিচ্ছে, যেখানে রাষ্ট্রকাঠামো সম্পর্কে সপ্রশ্ন ছবিগুলো দেখা যাচ্ছে। আমরা তো বাজারের কল্যাণেই সেই ‘কহানি’ দেখার সুযোগ পাচ্ছি, যে ছবিতে ভারতীয় গোয়েন্দা দফতরের প্রধানকে নাশকতার ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার জন্যে গ্রেফতার হতে হচ্ছে, ‘এক থা টাইগার’-এ ভারত সরকারের ‘র’-এর এজেন্ট সলমন খানকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করতেও দেখছি। তা হলে বাজারকে একটা ধন্যবাদ জানানোও আমাদের উচিত নয় কি?
নেহাতই হাতে-গোনা হালফিল কয়েকটি বলিউডি ছবির নাম করলাম। এর বাইরেও কত ছবি আছে, যেগুলোর মধ্যে বিভিন্ন ভঙ্গিতে বা নানান ভাবে রাষ্ট্র সম্পর্কে কোনও-না-কোনও বিরুদ্ধচিহ্ন ফুটে উঠছে, কিন্তু সেগুলো দেখার অধিকারে ভারতীয় রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করেনি। কোনও আঞ্চলিক কিংবা রাজ্য সরকার বা সেই শাসক দলের কর্মীরা ছবি চালানো নিয়ে ঝামেলা পাকাচ্ছে, তেমন নজির নিশ্চয়ই আছে। তা ছাড়া, কোনও ছবি বানানোর শুরু থেকে তা মুক্তি পাওয়া পর্যন্ত হাজারো ঝঞ্ঝাট পোহাতে হয় পরিচালককে, সে-ও আমাদের জানা। কিন্তু সেগুলো আলাদা আলাদা ঘটনা। বড় ছবিটা অন্য রকম। অনেকখানি খোলামেলা।
বলিউড থেকে আমরা যদি একটু বেরিয়েও যাই, কেবলমাত্র বাণিজ্যিক চাহিদা মেটানোর জন্য যাঁরা হিন্দি ছবি করেন না তাঁদের দিকে তাকাই? যেমন সুধীর মিশ্র, তাঁর ‘হাজারোঁ খোয়াইশেঁ অ্যায়সি’। ১৯৬৯-৭৫, এই সময়পর্বে নকশাল আন্দোলন থেকে জরুরি অবস্থার বৃত্তান্ত ধরা আছে ছবিটিতে, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে, তার এক ডকুমেন্টেশন এ ছবি। ছবিটি মুক্তির সময় থেকে এখন অবধি দীর্ঘ সময় কেন্দ্রে রাজত্ব করেছে কংগ্রেস সরকার, কই কোনও বাধা তো পাইনি আমরা এ ছবির চর্চায়।
আসলে, রাষ্ট্রের বোধহয় এক রকমের ‘উদারতার অহমিকা’ থাকে। সেটাও এক অর্থে ক্ষমতার দম্ভ আমার বিরুদ্ধে যা খুশি বলুক, আমার কিচ্ছু যায় আসে না, আমি অনেক বড়, অনেক ওপরে, ও-সব লিলিপুটদের আমি থোড়াই কেয়ার করি। এই ‘আত্মবিশ্বাস’ থেকেই একটা উদারতার বাতাবরণও তৈরি করে রাষ্ট্র। হতে পারে। কিন্তু তা হলে তো আর একটা কথাও মেনে নিতেই হয়। সেটা এই যে, ‘উদারতার দম্ভ’ গণতন্ত্রেই সম্ভব!
ভারতীয় গণতন্ত্রের এত বৈচিত্র আর বহুস্বর আছে যে তা কখনওই একনায়কতন্ত্রী হয়ে উঠতে পারে না বলছিলেন গৌতম ঘোষ। ‘শূন্য অঙ্ক’য় প্রচুর প্রশ্ন তুলেছেন তিনি রাষ্ট্র সম্পর্কে। পরিবেশ ধ্বংস করার উদ্যোগ থেকে সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে জনজাতি বা আদিবাসী গোষ্ঠীর ওপর যে আক্রমণ নামাচ্ছে রাষ্ট্র, পরোক্ষে বা প্রত্যক্ষে, তার জোরালো উল্লেখ আছে ছবিটিতে। ‘আমি কিন্তু সংবিধান মেনেই ছবি করেছি। সংবিধানে নাগরিকদের যে মৌলিক অধিকার দেওয়া হয়েছে, তার কথাই বলেছি সারা ছবিতে। ওই অধিকারগুলি যাতে বাস্তবায়িত হয়, কাগজে-কলমে আটকে না থাকে, সে জন্যেই এ-ছবি বানানো।’ এবং জানালেন গৌতম: ‘এ রকম ছবি এ দেশেই বানানো সম্ভব। চিনে এ-ছবি আমি বানাতে পারতাম না।’
ভারতীয় গণতন্ত্র কত মহৎ, তা নিয়ে নিশ্চয়ই অনেক প্রশ্ন। কিন্তু ওই গণতন্ত্র যে পরিসরটুকু দেয়, তা কাজে লাগানোই বুদ্ধিমান ছবি-করিয়ের লক্ষ্য। দেখা যাচ্ছে, সিনেমার বাজারে বুদ্ধির অভাব নেই। |
ঋণ: মিডিয়া নিয়ে সাতপাঁচ, সোমেশ্বর ভৌমিক (গাঙচিল) |
|
|
|
|
|