সম্পাদকীয়...
মরুসমাজ
ক্টোবরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। ডিসেম্বরে রবিশঙ্কর। মার্চে গণেশ পাইন। নিয়মিত নক্ষত্রপতন ঘটিতেছে। আকাশে অনেক নক্ষত্র থাকিলে পতনের গুরুত্ব হয়তো তেমন বোঝা যায় না, কিন্তু বাঙালির ভাগ্যাকাশ সেই সমৃদ্ধির কাল হইতে বিচ্যুত হইয়াছে অনেক দিন আগেই। যে কয়েক জন বঙ্গসন্তান কৃতির উচ্চলোকে এখনও বিরাজমান, তাঁহাদের সংখ্যা আক্ষরিক অর্থে মুষ্টিমেয় এবং তাঁহাদের অধিকাংশ বয়সে প্রবীণ। তরুণ, অন্তত তরুণতর ব্যতিক্রম সম্পূর্ণ বিরল নহে, কিন্তু ব্যতিক্রমমাত্র। একটি সমাজে শ্লাঘনীয় মানুষের অভাব যদি ক্রমশ বাড়িতে থাকে, তবে এমন একটি চিন্তার উদ্রেক হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে, যথার্থ উৎকর্ষের সৃষ্টি ও লালনে সেই সমাজ আর যথেষ্ট সক্ষম নহে। বড় মাপের প্রতিভা কোনও অঙ্কের নিয়ম মানিয়া চলে না, তাহার গতিপ্রকৃতি সর্বদাই অনেকাংশে ব্যাখ্যাতীত। কিন্তু একটি সমাজ বা জাতি বড় মাপের প্রতিভাকে তাহার প্রাপ্য মর্যাদা দিতে সক্ষম কি না, সেই সমাজ বা জাতির মানসিক স্বাস্থ্যের পক্ষে তাহা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেই হিসাবে, গণেশ পাইনের বিদায়ের পরে এই প্রশ্ন অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং জরুরি যে, বাঙালি তাঁহার গুরুত্ব সম্যক বুঝিয়াছিল কি না। মৃত্যু এ-প্রশ্নের উপলক্ষ মাত্র।
এবং, দুর্ভাগ্যের কথা, ইহার সহজ উত্তর: না। শিল্পী গণেশ পাইনকে বাঙালি তাঁহার প্রাপ্য মর্যাদা দেয় নাই। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির কথা হইতেছে না, এ ক্ষেত্রে সেই বিচারে প্রাসঙ্গিক নয় যথার্থ শিল্পকলা দুনিয়ার কোনও দেশেই বহুজন-প্রিয় হয় না, সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ায় বা তাহার বিবিধ উপনিবেশে ‘গণ-শিল্প’ উৎপাদনের নানা চেষ্টার করুণ পরিণাম গত শতাব্দী দেখিয়াছে। কিন্তু রুচি এবং সংস্কৃতির বিচারে সমাজের উচ্চবর্গ হিসাবে যাঁহারা পরিচিত, তাঁহারা শিল্পকলা সম্বন্ধে কতটা উৎসাহী, শিল্পের উৎকর্ষ বিষয়ে কতখানি বোধ তাঁহাদের আছে, তাহা সেই সমাজের মন ও মস্তিষ্কের গুণমান বিচার করিবার এক মূল্যবান মাপকাঠি। এই পরীক্ষায় বঙ্গসমাজ ভাল নম্বর পাইবে না। যথার্থ উচ্চস্তরের সৃষ্টি, যে সৃষ্টির মহিমা কেবল আবেগ দিয়া বোঝা সম্ভব নহে, যাহাকে উপলব্ধি করিতে চাহিলে মস্তিষ্ক নামক বস্তুটির সদ্ব্যবহার আবশ্যক হয় এক কথায় বলিলে, যে শিল্প সহজিয়া নয়, যাহাকে মগজ দিয়া বুঝিতে হয়, ‘শিক্ষিত বাঙালি’ তাহার প্রতি উদাসীন।
এই অক্ষমতা নূতন নহে। গত শতাব্দীর প্রথমার্ধে অনন্য প্রতিভার অধিকারী শৈলজ মুখোপাধ্যায়ের শিল্পের মর্যাদা অন্যরা দিয়াছিল, বাঙালি দেয় নাই। গণেশ পাইনের ক্ষেত্রেও তাহার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়াছে। প্রথমত, তাঁহার শিল্প মস্তিষ্ক-সাধ্য। দ্বিতীয়ত, তাঁহার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিগুলি ‘দৃষ্টিসুখকর’ নহে, তাহাদের অনুজ্জ্বল বিষাদ, অন্তর্লীন ভীতি, নিরুদ্ধ যন্ত্রণা, আশ্বাসহীন নিঃসঙ্গতা বা অনুচ্চ অথচ তীব্র আর্তি সচরাচর দ্রষ্টাকে বিচলিত করিয়া তোলে। যে কোনও মহৎ শিল্পের মতোই তাঁহার চিত্রকলাও এই সমস্ত অনুভূতি হইতে উত্তরণের পথেও লইয়া যায়, কিন্তু সেই উত্তরণের মর্ম বুঝিবার জন্য প্রয়োজন হয় যথার্থ মননশীলতার। অভাব সেখানেই। ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায় আক্ষেপ করিয়াছিলেন, বিশুদ্ধ জ্ঞানের চর্চায় সাধারণত বাঙালির বিশেষ আকর্ষণ দেখা যায় নাই। বিশুদ্ধ সৌন্দর্যের ক্ষেত্রেও একই সিদ্ধান্ত প্রযোজ্য। এবং এ ক্ষেত্রেও বাঙালি উত্তরোত্তর নিম্নগামী হইয়াছে, হইতেছে। সহজ, তরল এবং চটুলের মোহে তাহার মুগ্ধতা উত্তরোত্তর বাড়িতেছে। এই সমাজে গণেশ পাইনরা ব্যতিক্রম।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.