চার মাসে দু’বার। ফের বিধ্বংসী আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে গেল একটি বস্তির কয়েকশো ঘর।
শনিবার ভোরে শিয়ালদহ-বজবজ শাখার সন্তোষপুর স্টেশনের কাছে মহেশতলা পুরসভা এলাকায় ‘ষোলো বিঘা’ বস্তিতে আগুন লেগে সাতশো ঘর পুড়ে কয়েক হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছেন। পুলিশ জানিয়েছে, গত নভেম্বর মাসে এ রকমই এক বিধ্বংসী আগুনে ওই বস্তির কয়েকশো ঘর পুড়ে যায়। তাতে মৃত্যুও হয়েছিল এক শিশুর। এ বার কেউ হতাহত হননি বলে পুলিশের দাবি। যদিও স্থানীয়দের পাল্টা দাবি, জখম হয়েছেন দু’জন।
তবে গত বারের মতো এ বারেও বস্তিবাসীদের অভিযোগ, তাঁদের উচ্ছেদ করার জন্যই পরিকল্পনা করে বস্তিতে আগুন লাগানো হয়েছে। রেললাইন লাগোয়া ওই বস্তিতে আগুন লাগায় এ দিন ভোর থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত শিয়ালদহ-বজবজ শাখায় লোকাল ট্রেন বন্ধ থাকে। রেল সূত্রের খবর, লাইনের উপর দিয়ে দমকলের পাইপ নিয়ে যাওয়ায় পরিষেবা বন্ধ রাখতে হয়। এই ঘটনার পরে থানায় অভিযোগ দায়ের করেন বস্তিবাসীরা। তার ভিত্তিতে মহেশতলা পুরসভার তৃণমূলের কাউন্সিলর দীপিকা দত্ত-সহ স্থানীয় ১১ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। গ্রেফতার করা হয়েছে এলাকার দুই মহিলা-সহ পাঁচ জনকে। অভিযোগপত্রে মূল ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে মহেশতলার পুর-চেয়ারম্যান দুলাল দাসের নাম লেখা হয়েছে। |
এই ঘটনার পরে মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “মহেশতলায় ছোট আগুন লেগেছে। একটি বস্তিতে বাড়ি পুড়ে গিয়েছে। যাঁদের বাড়ি পুড়েছে, তাঁদের বাড়ি তৈরি করে দেওয়া হবে। সরকার থেকে ত্রাণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে।” তিনি বলেন, “সকালে খবর পেয়ে জাভেদকে (দমকলমন্ত্রী) পাঠাই। তিনি ঘটনাস্থল ঘুরে এসেছেন।”
বস্তির লোকজন জানান, গত বার পশ্চিম দিকে আগুন লাগে। এ দিন আগুন লাগে পূর্ব দিকে। পুলিশ সূত্রের খবর, দু’টো বাড়ির মাঝে ভোর পৌনে চারটে নাগাদ আগুন ধরে যায়। মণিরা বিবি নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা জানিয়েছেন, দরমার বেড়া থেকে আগুনের হল্কা দেখে তিনি পরিবারের সকলকে ডাকেন। তত ক্ষণে লাগোয়া ঘরগুলিতেও আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে।
বস্তির বেশির ভাগ ঘরে দরমার বেড়া এবং টালি বা প্লাস্টিকের ছাউনি। ফলে আগুন দ্রুত ছড়ায়। দমকলের কর্মীরা জানান, আগুন নেভাতে প্রথমে বজবজ এবং আলিফনগর থেকে গাড়ি যায়। কিন্তু আগুন ভয়াবহ আকার নেওয়ায় পরে কালীঘাট, বেহালা এমনকী মির্জা গালিব স্ট্রিটে দমকলের সদর দফতর থেকেও গাড়ি পাঠাতে হয়। ১৫টি ইঞ্জিন সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন আয়ত্তে আনে।
দুলু খান নামে স্থানীয় এক মহিলার দোকান রয়েছে বস্তিতে। তিনি জানান, গত বার আগুনের পরে ‘ষোলো বিঘা বস্তি উন্নয়ন কমিটি’ সিদ্ধান্ত নেয়, প্রতি রাতে পালা করে বস্তির ৫০-৬০ জন যুবক পাহারা দেবেন। নিয়মমতো রাত দশটা থেকে ভোর সাড়ে তিনটে পর্যন্ত পাহারা থাকছে। দুলুর অভিযোগ, “শুক্রবার রাতে নিতাই হালদার নামে এক যুবক আমার দোকানে এসে বলতে শুরু করেন, যা ফয়সালা হওয়ার আজ রাতেই হবে।” |
দুলুর দাবি, আগুন লাগানো হয়েছে রাতপাহারা শেষ হওয়ার পরে। বাসিন্দাদের আরও অভিযোগ চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠ রফিক মোল্লা, রেজ্জাক গাজি, আয়ুব আলি গাজি নামে স্থানীয় কিছু যুবক দীর্ঘদিন ধরেই বস্তিবাসীদের হুমকি দিচ্ছিলেন। পুলিশ জানায়, গত বার আগুনের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছিলেন নিতাই হালদার।
এ দিন বেলা পৌনে ১১টা নাগাদ ষোলো বিঘা বস্তিতে যান রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। তাঁকে ঘিরে বস্তির লোকজন অভিযোগ জানাতে শুরু করেন। বস্তি উন্নয়ন কমিটির সভাপতি ইদ্রিশ আলির সঙ্গে কথা বলেন বিরোধী দলনেতা। পরে তিনি বলেন, “গত বার বস্তিবাসীদের পুনর্বাসন দেওয়ার দাবি জানিয়ে পুর-কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছিলেন জেলার সিপিএম নেতা রতন বাগচী। কিন্তু তা হয়নি।” সূর্যকান্তবাবু বস্তিবাসীদের বলেন, “সরকার বা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কেউ পরিদর্শনে এলে আপনারা বাধা দেবেন না।” তাঁর বক্তব্য, “আগুন লাগলে রাজনীতির রং দেখতে নেই।”
পরে যান দমকলমন্ত্রী জাভেদ খান। বস্তির লোকজন তাঁকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখালে মন্ত্রী বলেন, “বস্তি থেকে কেউ উচ্ছেদ হবেন না। মহকুমাশাসককে বলেছি, কারও প্রতি যাতে অবিচার না হয়, তা নিশ্চিত করতে। কেউ ইচ্ছে করে আগুন লাগিয়ে থাকলে, তার তদন্ত হবে।” বস্তি উন্নয়ন কমিটির তরফে দমকলমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ করা হয়, এলাকার দু’টি বড় পুকুর ভরাট হচ্ছে। অথচ, মহেশতলা থানা পুকুর ভরাটের অভিযোগ নিচ্ছে না। মন্ত্রী থানার আইসি-কে বলেন, ওই অভিযোগ গ্রহণ করতে। পরে ঘটনাস্থলে যান ‘অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট’-এর চেয়ারম্যান সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী। তিনি বলেন, “স্থানীয় প্রশাসন দোষীদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না।”
এ দিন স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে বস্তিবাসীদের ত্রিপল দেওয়া হয়েছে। তাঁদের জন্য দুপুর ও রাতের খাওয়ার ব্যবস্থাও করা হয়।
|