পরিকল্পনা ছিল, রাজ্যে বস্ত্রশিল্পের মোড় ঘোরানোয় মাইলফলক হবে এই বাড়ি। মূলত সেই লক্ষ্যেই ১৬ তলা ‘গার্মেন্ট পার্ক’ গড়তে ৭৫ কোটি টাকা উপুড় করেছে রাজ্য। কিন্তু প্রকল্পের কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও বস্ত্রশিল্পের কোনও কিছুই এক ছটাকও জায়গা নেয়নি সেখানে। বরং এখন জানা যাচ্ছে, জামা-কাপড় বিকিকিনির বদলে মন্ত্রী-আমলারাই ফাইল খুলবেন সেখানে। মহাকরণ থেকে বেশ কয়েকটি দফতর উঠে আসবে হাওড়া-মন্দিরতলার কাছে তৈরি ওই প্রস্তাবিত গার্মেন্ট পার্কে। শুধু তা-ই নয়, ওই আড়াই লক্ষ বর্গফুটের বিপুল বহুতলে আদতে কী হতে চলেছে, তা নিয়ে বিস্তর সংশয় শাসক দলের অন্দরেই।
বস্ত্রশিল্পের প্রসারে এই আধুনিক বহুতল গড়তে হাওড়ার শিবপুর মৌজায় দ্বিতীয় হুগলি সেতুর পাশে সাড়ে তিন একর জমি বরাদ্দ করেছিল পূর্বতন বাম সরকার। প্রকল্প তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল হুগলি রিভার ব্রিজ কমিশনার্স (এইচআরবিসি)-কে। ২০০৯ সালে শুরু হয় প্রকল্পের কাজ। কিন্তু সংশ্লিষ্ট মহলের অভিযোগ, সেই কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার অনেক পরেও বহুতলটিকে কাজে লাগাতে তেমন ভাবে উদ্যোগী হয়নি এইচআরবিসি। এখন সেই ফাঁকা জায়গায় মহাকরণের বেশ কিছু দফতর তুলে আনার কথা ভাবছে রাজ্য।
|
এই সেই বহুতল। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার |
পূর্তমন্ত্রী সুদর্শন ঘোষদস্তিদার জানান, “মহাকরণে স্থানাভাবের সমস্যা আছে। তাই কয়েকটি দফতর প্রস্তাবিত গার্মেন্ট পার্কে যাবে। কোন কোন বিভাগ কবে যাবে, সে সব খতিয়ে দেখা হচ্ছে।” নির্মাতা বেসরকারি সংস্থার এক কর্তা বলেন, “সরকার এখন বলছে, ওখানে সচিবালয় হবে। পূর্ত দফতরের আধিকারিকরা সমীক্ষাও করে গিয়েছেন।”
অথচ মুখ্যমন্ত্রীর সদ্য পদত্যাগী শিল্প-পরামর্শদাতা তথা তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়ের দাবি, “রাজ্যে বস্ত্রশিল্প যথেষ্ট সম্ভাবনাময়। গার্মেন্ট পার্ক নিয়ে সরকারের কী ভাবনা, বলতে পারব না।” এইচআরবিসি-র চেয়ারম্যান তথা তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় আবার মনে করেন, “বাড়িটিতে আরও গাড়ি রাখার জায়গা প্রয়োজন। তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।” কিন্তু নির্মাতা সংস্থার ইঞ্জিনিয়ারদের দাবি, “ভূগর্ভে গাড়ি রাখার যথেষ্ট জায়গা আছে। আশেপাশে সেতুর র্যাম্পের নীচেও ফাঁকা জায়গার অভাব নেই।” এই বিতর্কে ঢুকতে না-চাওয়া এইচ আর বি সি-র ভাইস চেয়ারম্যান সাধন রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, “কী হবে তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে রাজ্যই। এ নিয়ে মন্তব্য করব না।”
বহুতলটির সামনে পেল্লাই টিনের ফলকে এখনও লেখা ‘গার্মেন্ট পার্ক’। কাচের শার্সি ঘেরা ঝকঝকে ফাঁকা বাড়িটির প্রতি তলের গড় আয়তন প্রায় ১২ হাজার বর্গ ফুট। এমন তৈরি পরিকাঠামোতেও বস্ত্রশিল্পের কাউকে আনা গেল না কেন? তবে কি গোড়া থেকেই চাহিদা ছিল না সেখানে?
রাজ্যের বস্ত্র প্রস্তুতকারক ও ডিলার্স সংগঠনের সহ-সভাপতি বিজয় কারিওয়াল কিন্তু জানাচ্ছেন, “মেটিয়া বুরুজ ও তার সংলগ্ন অঞ্চলে যে-ভাবে বস্ত্রশিল্প ছড়িয়ে আছে, তা অবৈজ্ঞানিক এবং বিপজ্জনক। ফলে এক ছাদের নীচে আধুনিক এই পরিকাঠামোয় শিল্প উপকৃত হতে পারে।” হাওড়া হাট সংগ্রাম সমিতির সভাপতি তথা কলকাতা পুরসভার ১৪১ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মইনুল হক চৌধুরীও বলেন, “শুধু মেটিয়া বুরুজ অঞ্চলেই কয়েক লক্ষ মানুষ এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। তাই গার্মেন্ট পার্কের মতো আধুনিক প্রকল্প হলে তার সুফল মিলবে।”
অথচ সাধনবাবু জানাচ্ছেন, “প্রকল্প তৈরির আগে চাহিদা খতিয়ে দেখা হয়েছিল। ২০১০-এ দৈনিক সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়ে ফের তা যাচাই করা হয়। সাড়া মিললেও জায়গা বিক্রির জন্য বস্ত্র প্রস্তুতকারকদের কাছ থেকে টাকা নিইনি।”
এইচআরবিসি-র প্রাক্তন চেয়ারম্যান স্বদেশ চক্রবর্তীর সময়েই গার্মেন্ট পার্ক তৈরির পরিকল্পনা। তাঁরও অভিযোগ, “প্রকল্পটি রূপায়িত না-হওয়ার কোনও যুক্তি তো খুঁজে পাচ্ছি না। যাতায়াতের অসুবিধার কথা উঠেছিল। তা সমাধানের জন্য আলাদা ‘র্যাম্প’ করার কথাও হয়েছিল। তার জন্যও ১৫ কোটি টাকার সংস্থান আছে।” |