কী কাণ্ড! ছোটদেরও ঘুম গিয়েছে চুরি
ছর সাতেকের ছেলে রুকু। প্রতিদিন রাত দু’টো নাগাদ ঘুম ভেঙে যায় তার। তারপর বাড়িময় হেঁটে বেড়ায় সে। টানা সাত দিন এই একই রুটিন দেখে চিকিৎসকের দ্বারস্থ হন উদ্বিগ্ন বাবা-মা। সঙ্গে নিয়ে আসেন মোবাইলে তোলা ওই ঘটনার ছবিও। ধরা পড়ে রুকুর ‘স্লিপ ডিসঅর্ডার’ বা ঘুমের সমস্যা।
এত দিন যে নিদ্রাহীনতার সমস্যা বড়দের দুনিয়ায় সীমাবদ্ধ ছিল, এখন তা থাবা বসাচ্ছে ছোটদের পৃথিবীতে।
আজ বিশ্ব নিদ্রা দিবস। কিন্তু সেই দিনেও আক্ষরিক অর্থে ঘুম ছুটিয়ে দেওয়ার মতো তথ্য ছোটদের বিছানা থেকেও ঘুম চুরি যাওয়া। চিকিৎসকদের দাবি, এর জন্য মূলত দায়ী দ্রুত লয়ের আধুনিক জীবনযাত্রা আর টিভি-কম্পিউটার গেমসের দাপট। এই দু’য়ের যুগলবন্দিতে এই সমস্যা ফি বছর লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে বলে স্পষ্ট জানাচ্ছেন তাঁরা।
ডায়াবেটিস, হৃদরোগ থেকে শুরু করে মানসিক অবসাদ। বড়দের অনেক রোগেরই অন্যতম কারণ নিয়মভাঙা জীবনযাত্রা। চিকিৎসকদের মতে, ছোটদের ঘুমের সমস্যার কারণও কিন্তু সেই বেহিসাবি লাইফস্টাইল। কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালের ‘পালমোনারি’ বিভাগের প্রধান রাজা ধর বলেন, “প্রতি মাসে আমার কাছে অন্তত দশটি বাচ্চা এই সমস্যা নিয়ে আসে। এর মধ্যে ২-৩ জনের স্লিপ অ্যাপনিয়ার সমস্যা থাকে। অর্থাৎ, ঘুমোনোর সময় কয়েক সেকেন্ডের জন্য নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু বাকিদের সমস্যার কারণ জীবনযাত্রার ধরন। ৭-১২ বছরের বাচ্চাদের মধ্যে এই সমস্যা বেশি।”
চিকিৎসকদের মতে, এই পাল্টে যাওয়া জীবনযাত্রায় ‘ভিলেন’ হিসেবে উঠে আসছে টিভি, ভিডিও-গেম, কম্পিউটার এবং মোবাইলের নাম। তালিকায় থাকছে ক্যাফিনযুক্ত ঠাণ্ডা পানীয়ও। মনোবিদ জয়রঞ্জন রাম বলেন, “কম্পিউটার গেম খেলে বা টিভি দেখার পর বাচ্চারা অনেক সময় উত্তেজিত থাকে। শোওয়ার পরেও এ সব নিয়েই চিন্তা করতে থাকে ওরা। তাই ওই সব কাজ ও ঘুমের সময়ের মধ্যে বেশ কিছুটা ব্যবধান থাকা জরুরি। নজর দিতে হবে, কী ধরনের অনুষ্ঠান বাচ্চারা দেখছে, তার উপরেও। যেমন, অনেক সময় অতিরিক্ত মারামারির দৃশ্য দেখার রেশ থেকে যায় তাদের মধ্যে।”
বিশেষজ্ঞদের দাবি, গত ৪ বছরে ভারতে এই সমস্যা তিন গুণ বেড়েছে। কলকাতায় প্রতি বছরই ঘুমের সমস্যায় ভোগা বাচ্চার সংখ্যা বাড়ছে অন্তত ২০% হারে। অধিকাংশ মা-বাবাই এই সমস্যাকে শুরুতে আমল দেন না। চিকিৎসার সিদ্ধান্ত নেন সমস্যা অনেকটা বেড়ে যাওয়ার পরে। অথচ শরীরের বৃদ্ধি বা মনের বিকাশের জন্য ছোটদের ঘুম কতটা জরুরি, তা স্পষ্ট চিকিৎসকদের কথাতেই।
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ হীরক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, বৃদ্ধির জন্য জরুরি ‘গ্রোথ হরমোন’ ক্ষরণ হয় মূলত রাতে ঘুমোনোর সময়েই। তাই ঘুম কম হলে, বৃদ্ধিও কম হতে বাধ্য। তাঁর পরামর্শ, “যে হরমোনে ঘুম আসে, সেই মেলাটোনিনের ঘাটতি ওষুধে পূরণ করা যেতে পারে। কিন্তু পরিবেশ ও জীবনযাত্রার কারণে ঘুম নষ্ট হলে, সেই সমস্যা মেটাতে হবে জীবনযাত্রা বদলে ফেলেই।”
ঘুম নেই
উপসর্গ
• ঘুমের মধ্যে হেঁটে বেড়ানো
• প্রায়ই দুঃস্বপ্ন দেখা
• অতিরিক্ত নাক ডাকা
• রাতে প্রায়ই ঘুম ভেঙে যাওয়া
• দিনে জেগে থাকার সমস্যা
• দিনে খেলাধুলো, কাজকর্ম কমা
ফল
• আচরণে সমস্যা
• হঠাৎ মেজাজ বিগড়ানো
• স্মৃতি শক্তি কমে যাওয়া
• মনঃসংযোগ হ্রাস
সমাধান
• ঘুমের বাঁধা-ধরা সময়
• ঘুমের আগে গল্প বলা
• রাতে ভারী খাবার নয়
• ঘুমোতে যাওয়ার অন্তত ছ’ঘন্টা আগে থেকে
ক্যাফিনযুক্ত খাবার বা পানীয় বন্ধ। অন্তত
এক ঘণ্টা আগে বন্ধ টিভি, ভিডিও-গেম
* কলকাতায় প্রতি বছর ঘুমের সমস্যায় ভোগা বাচ্চার সংখ্যা বাড়ছে অন্তত ২০% হারে।
শিশুদের বৃদ্ধির ক্ষেত্রের ঘুমের প্রয়োজনীয়তার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জ্যোতির্ময় সমাজদারও। তাঁর দাবি, “শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য ঘুম অসম্ভব জরুরি। কারণ, সারা দিনে আমরা যা শিখি-জানি, সব মাথার মধ্যে গুছিয়ে ফেলার সময় কিন্তু ঘুমই। কম্পিউটারে যেমন আমরা বিভিন্ন তথ্য বিভিন্ন ডিস্কে তুলে রাখি কিংবা অপ্রয়োজনীয় কিছু ফেলে দিই, আমাদের মাথায় ঠিক তেমনটাই ঘটে ঘুমের মধ্যে। আর ছোটরা যা দেখে-শোনে, সবই তাদের কাছে নতুন। তাই অত অত নতুন তথ্য গুছিয়ে ফেলতে দীর্ঘ নির্ঝঞ্ঝাট ঘুমের প্রয়োজন তাদের আরও বেশি।”
মনোবিদদের মতে, শুধু টেলিভিশন বা ভিডিও গেম নয়। ছোটদের ঘুম কেড়ে নিচ্ছে তাদের ছোট ছোট পরিবারে বেড়ে ওঠার সমস্যাও। যেমন, অনেক ক্ষেত্রে বাবা-মা দু’জনেই কাজ করেন। তাই তাঁরা বাড়ি ফেরার পর সঙ্গ পেতে জেগে থাকার সময়টাও বাড়িয়ে নিতে চায় বাচ্চারা। ফলে ঘুমোতে যাওয়ার সময়ও পিছিয়ে যায়।
এই কম ঘুমের কুফল প্রতিফলিত হয় স্কুলের রিপোর্ট কার্ডেও। বেসরকারি স্কুলের শিক্ষিকা নন্দিনী মজুমদার জানাচ্ছেন, “ঘুমের সমস্যা হলে বাচ্চার স্বভাব বদলে যায়। পড়াশোনায় বিঘ্ন ঘটে। জেদ বাড়ে। কমে যায় প্রাণচাঞ্চল্য। এমনকী গল্প শোনা, গান শোনা বা খেলাধূলাতেও আগ্রহ হারায় তারা।”
ছোটবেলাতেই সমস্যার সমাধান না হলে, পরে জটিলতা আরও বাড়ে। ন্যাশনাল স্লিপ ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ঘুমের সমস্যার কারণে ৮১% ক্ষেত্রে ডায়াবেটিসের সম্ভাবনা বাড়ে। বেড়ে যায় হৃদরোগের (৭৮%) ও অবসাদের (৮৩%) সম্ভাবনাও।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.