সরকারি হাসপাতালে ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকানের প্রকল্প ব্যর্থ করার চক্রান্ত সরকার যে বরদাস্ত করবে না, সেই হুঁশিয়ারি আগেই দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই হুঁশিয়ারি যে স্রেফ মুখের কথা নয়, তা প্রমাণ করতে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নিজেই পথে নামলেন তিনি। প্রথমে এসএসকেএমের ওষুধের দোকান এবং তার পরে ওই এলাকার বেসরকারি দোকানগুলি ঘুরে সেখানকার কর্মীদের স্পষ্ট ভাষায় জানালেন, রোগীদের সঙ্গে কোনও অসহযোগিতা বরদাস্ত করা হবে না। অসহযোগিতা করলে ওষুধের দোকানের লাইসেন্স বাতিল করা হবে। ব্র্যান্ড নামে প্রেসক্রিপশন লিখলে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ দিন সন্ধ্যায় মহাকরণ থেকে বেরিয়ে আচমকাই এসএসকেএম হাসপাতালের ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকানে ঢোকেন মমতা। সেখানে ক্রেতাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে হাঁটতে হাঁটতেই চলে যান ওই এলাকার কয়েকটি ওষুধের দোকানে। কেন বাইরের বিভিন্ন দোকান ন্যায্য মূল্যের দোকানের সঙ্গে অকারণ প্রতিযোগিতা শুরু করেছে, কেন তারা রোগীদের সহযোগিতা করছে না, কেন ন্যায্য মূল্যের দোকান থেকে কিছু ওষুধ কিনলে প্রেসক্রিপশনের বাকি ওষুধ তারা রোগীদের দেবে না বলে হুমকি দিচ্ছে, তার কৈফিয়ত চান তিনি। আচমকা মুখ্যমন্ত্রীর এই অভিযানে হকচকিয়ে গিয়েছিলেন দোকানের কর্মীরা। মুখ্যমন্ত্রী নাগাড়ে তাঁর প্রশ্নগুলি করার পরে সব দোকানেই কর্মীরা প্রতিশ্রুতি দেন, ভবিষ্যতে এমন কিছু ঘটবে না। |
শুধু ওষুধ ব্যবসায়ী নয়, সরকারি চিকিৎসকদের উদ্দেশেও এ দিন কড়া বার্তা দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। এসএসকেএমের ন্যায্য মূল্যের দোকান থেকে কিছু প্রেসক্রিপশনের ফটোকপি সংগ্রহ করেন তিনি। বলেন, “বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও কিছু সরকারি চিকিৎসক জেনেরিক নামে ওষুধ লিখছেন না। এমনকী ন্যায্য মূল্যের দোকানে যে ওষুধগুলি পাওয়া যাবে, তার তালিকা তাঁদের কাছে থাকা সত্ত্বেও ইচ্ছাকৃত ভাবে অন্য ওষুধ লিখছেন। আমরা সমস্ত প্রমাণ সংগ্রহ করেছি। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
এ দিনের অভিযানে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র, পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ, স্বাস্থ্যসচিব সতীশ তিওয়ারি, স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী প্রমুখ। পাঁচটি দোকান ঘোরার পরে তিনি বলেন, “আমার যা বলার স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দিয়েছি। আশা করি এতেই কাজ হবে। আর না হলে অন্য পথ তো আছেই।”
এসএসকেএমের অধিকর্তা প্রদীপ মিত্র বলেন, “বহু চেষ্টা সত্ত্বেও সমস্ত চিকিৎসককে দিয়ে জেনেরিক নামে ওষুধ লেখানো যাচ্ছে না। এখনও অন্তত ৪০ শতাংশ চিকিৎসক ব্র্যান্ড নামেই ওষুধ লেখেন। কেউ কেউ তালিকায় না থাকা ওষুধগুলিই লেখেন যাতে তা বাইরে থেকে কিনতে হয়। আমরা পরিস্থিতি পরিবর্তনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। মুখ্যমন্ত্রী নিজে আসার পরে বিষয়টা বহু গুণ জোরদার হল।”
কেন মুখ্যমন্ত্রীকে এসএসকেএমে আসতে হল? স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকানে কিছু ওষুধ পাওয়া যায় না। সেই ওষুধগুলি বাইরের দোকানে কিনতে গেলে তারা তা বিক্রি করতে অস্বীকার করছে বলে অভিযোগ। দোকানগুলির বক্তব্য, কিনতে হলে সব ওষুধ কিনতে হবে, না হলে কোনও ওষুধই দেওয়া হবে না। গত মঙ্গলবার এক রোগী এসএসকেএমের ন্যায্য মূল্যের দোকানে স্যালাইন পাননি, কিন্তু প্রেসক্রিপশনের বাকি ওষুধগুলি পেয়েছিলেন। এলগিন রোডের একটি দোকানে তিনি তা কিনতে গেলে ওই দোকান তা দেয়নি। বিষয়টি মুখ্যমন্ত্রীর কানে পৌঁছয়। তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নেন এই চক্র ভাঙবেন। এ দিন বিকেলে মহাকরণে মুখ্যসচিব ও স্বাস্থ্যসচিবের সঙ্গে এ নিয়ে বৈঠক হয় তাঁর। ওষুধ-চক্র ভাঙতে তাঁর সরকার যে বদ্ধপরিকর, তা প্রমাণ করতেই বৈঠকের পরে হঠাৎ এসএসকেএমে আসার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, এখন গোটা রাজ্যে ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকানের সংখ্যা ৩২। মাস দুয়েকের মধ্যেই তা বাড়িয়ে ৫২ করা হবে। মহকুমা স্তরেও এই পরিষেবা ছড়িয়ে দেওয়া হবে।
এসএসকেএম থেকে এ দিন সন্ধ্যায় ফের মহাকরণে ফেরেন মমতা। মুখ্যসচিব ও স্বাস্থ্যসচিবের সঙ্গে ফের এক দফা বৈঠক করে বেরিয়ে যান। |