|
|
|
|
তারাবাজি |
পুরুষ মডেলের ইতিকথা
কাজ কম, মডেল বেশি। তার উপর আবার ব্লন্ড বিদেশি মডেলদের ভিড়।
পুরুষ মডেল হওয়া কি
আরও বেশি শক্ত হয়ে উঠেছে? লিখছেন প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত |
বছর দু’য়েক আগের কথা। মার্ক রবিনসন পুরুষ মডেলদের নিয়ে একটি বিখ্যাত উক্তি করেছিলেন। বলেছিলেন পুরুষ মডেল এবং মডেলিংয়ের সম্পর্কটা ‘ফ্লিং’-এর মতো। এমন ঠুনকো সম্পর্ক যে বিয়ে পর্যন্ত পৌঁছলেও বিবাহবিচ্ছেদ সময়ের অপেক্ষা মাত্র!
এ তো গেল দু’বছর আগের কথা। দিল্লিতে সদ্য শুরু হওয়া ফ্যাশন উইকে উঁকি দিয়ে আনন্দplus দেখল ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে এই পুরুষ মডেলদের স্বপ্ন আর ব্যাকুলতার ছবি।
চলতি ‘উইলস লাইফস্টাইল ফ্যাশন উইক’-এ রয়েছেন মাত্র আটজন অফিশিয়াল পুরুষ মডেল। যেখানে মহিলা মডেলের সংখ্যা আটচল্লিশ। তুলনামূলক ভাবে পুরুষ মডেলদের সংখ্যা যে কত কম তা বুঝতে অসুবিধে হয় না। এফডিসিআইয়ের সভাপতি সুনীল শেঠি জানালেন, যদি শুধুমাত্র পুরুষদের নিয়ে ফ্যাশন উইক হয় তা হলেই আটচল্লিশ জন পুরুষ মডেল নেওয়ার কথা ভাবা যেতে পারে।
এ এমন এক দুনিয়া যেখানে মেয়েদেরই প্রাধান্য চোখে পড়ার মতো। এ হেন পেশাতে পুরুষদের ভূমিকা কতখানি? তাঁদের পক্ষে মডেলিংকে পেশা হিসেবে নেওয়াটাই বা কতটা যুক্তিসঙ্গত?
মডেলিং জগতে আসতে চাওয়া পুরুষের সংখ্যা নেহাত কম নয়। সে রকমই কম নয় তাঁদের জীবনের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতাও। ফ্যাশন উইকের আনাচে কানাচে প্রায়ই শোনা যায় সমকামিতার নামে উঠতি মডেলদের বঞ্চনার কাহিনি। এই মুহূর্তে ভারতের সেরা পুরুষ মডেলদের অন্যতম ফ্রেডি দারুওয়ালা। নিভিয়া ফর মেন, রেমন্ডস, রিলায়্যান্স, ম্যানফোর্স এই সমস্ত বিজ্ঞাপনের সুবাদে পরিচিত এক মুখ। বলিউডে পা রাখতে চলেছেন ‘শের’ ছবিটির মাধ্যমে। ফ্রেডি বললেন, “রাস্তাটা মোটেও সহজ নয়। যদি কেউ নিজেই সুযোগ করে দেন, তা হলে তাঁকে চূড়ান্ত ভাবে শোষিত হতেই হবে। এই রকম অনেক মানুষের মুখোমুখি হতে হবে যাঁরা বলবেন, ‘আমি অমুক ডিজাইনারের সঙ্গে তোমাকে আলাপ করিয়ে দিতেই পারি কিন্তু তার বিনিময়ে তোমাকে কী করতে হবে তা তো বুঝতেই পারছ।’ আপনাকে বুদ্ধি করে এই পরিস্থিতিগুলোকে পাশ কাটিয়ে যেতে হবে। হয়তো খুব শান্ত গলায় বললেন, ‘আমি আপনার সঙ্গে পরে যোগাযোগ করছি।’ ব্যস, তার পর তাঁকে আর ফোন করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। তবে এটা নিজেকেই বুঝতে হবে, ‘ইয়ে মেরা রাস্তা নহি হ্যায়।’” এ ছাড়াও ফ্রেডি স্বীকার করলেন যে টাকার ক্ষেত্রেও পুরুষ মডেলদের অনেক অসুবিধের সম্মুখীন হতে হয়। উন্নত গুণমানের কাজ আশা করা হয়, কিন্তু সেই মতো পারিশ্রমিক দেওয়া হয় না। “কেউ যদি দিনে এক লাখ টাকা পারিশ্রমিক দাবি করেন, তা হলে বেশি কাজের আশা না করাই ভাল,’’ বললেন ফ্রেডি। |
|
|
ফ্রেডি দারুওয়ালা |
সাহিল শ্রফ |
|
পুরুষ মডেলদের কি একটি বিকল্প পেশা থাকা দরকার? কী মনে করেন ফ্রেডি? “স্পনসরশিপের অভাবে মেন’স ফ্যাশন উইক বন্ধ হয়ে গেল। ইন্ডাস্ট্রির পুরুষ মডেলদের পক্ষে এটা খারাপ খবর। তবুও যদি কোনও পুরুষ মডেল আমার কাছে টিপস নিতে আসে তাকে সঠিক স্টেপস শেখার জন্য ভাল কোনও কোরিওগ্রাফারের কাছে যেতেই সাহায্য করব।” বললেন ফ্রেডি।
ইরফান আহমেদ ভট্ট কাশ্মীর থেকে আসা একজন মডেল। চার বছর ধরে ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করেছেন। তার পর ছেড়ে দিয়ে আপাতত নিজস্ব ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। “যদিও আমি বিশ্বাস করি না সব ক্ষেত্রেই তাঁরা শোষিত হন, তবে মডেলিংকে কেরিয়ার হিসেবে বেছে নিলে পুরুষদের একটা বিকল্প রাস্তা খুঁজে রাখা প্রয়োজন। মডেলিংয়ে কর্মজীবন খুবই সীমিত হয়। তাই নিজের সময় ফুরিয়ে যাওয়ার আগে অন্য রাস্তা বেছে নেওয়াটা দরকার।”
বাংলাদেশের মডেল আসিফ আজিম ইতিমধ্যেই ইতালীয়, জার্মান, এবং অস্ট্রেলীয় ‘ভোগ’ ম্যাগাজিনের কভারে জায়গা করে নিয়েছেন। ভারতের বিখ্যাত ডিজাইনারদের হয়ে র্যাম্পেও হেঁটেছেন। বার্সেলোনা ফ্যাশন উইক এবং সিডনি ফ্যাশন উইকেও অংশগ্রহণ করেছেন। আগামী মাসেই তিনি ভ্যাঙ্কুভার, মন্ট্রিয়েল এবং লস অ্যাঞ্জেলেস-এ কিছু অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে চলে যাচ্ছেন। আসিফের মতে এক হাজার পুরুষ চেষ্টা করলে হয়তো একজনের কাছে মডেলিং লাভজনক পেশা হয়ে উঠতে পারে। এই পেশাতে মহিলাদের তুলনায় পুরুষদের নিরাপত্তাহীনতা অনেক বেশি এবং সেটা পৃথিবীর সব জায়গাতেই প্রযোজ্য। “ভারতে এই ব্যাপারটা দিনকে দিন আরও বাড়ছে। বিগত কিছু বছরে দেশের প্রায় সমস্ত ছোট বা বড় শহরেই ফ্যাশন উইক হয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ ফ্যাশন উইকেই অফিশিয়াল পুরুষ মডেলের সংখ্যা নামমাত্র। অন্য দিকে অফিশিয়াল মহিলা মডেলের সংখ্যা প্রায় ষাট থেকে সত্তর। এ সবের মাঝে দু’তিনটে ফ্যাশন উইকে হয়তো তিন থেকে পাঁচ জন পুরুষ মডেল কাজ করেছেন তাও বিনা পারিশ্রমিকে। তার থেকেও বড় কথা, কখনও কখনও উদ্যোক্তারা থাকা-খাওয়ার টাকাটাও দেন না বলে অভিযোগ শোনা যায়। অনেক সময় তো ডিজাইনারদের ফ্যাশন উইকে যোগ দেওয়ার জন্য যে টাকা দিতে হয় তার পর পুরুষ মডেলদের পারিশ্রমিক দেওয়ার সাধ্য থাকে না। যদি দেশের সেরা পাঁচ জন পুরুষ মডেলের মধ্যে থাকতে পারে তা হলে একটা মানে আছে। না হলে এই পেশায় আসাই উচিত নয় পুরুষদের। এক জন সেরা মহিলা মডেল হয়তো বছরে এক কোটি টাকা রোজগার করতে পারবেন। সেখানে এক জন পুরুষ মডেলের ক্ষেত্রে সেটা খুব বেশি হলে ষাট লাখ টাকা,” বললেন আসিফ।
মডেল সাহিল শ্রফ, প্যান্টালুনস, পার্ক এভিনিউ, স্পাইস, অ্যালাইভা ব্র্যান্ডের হয়ে ক্যাম্পেন করেছেন। ‘ডন ২’ তে অভিনয়ও করেছেন। তাঁর মতে এরকম অনেকে পুরুষই আছেন যাঁরা প্রয়োজনীয় হোমওয়ার্ক করেন না। কিন্তু হাবভাব ‘ মুঝে মডেল বন্না হ্যায়’ এই গোছের। “অস্ট্রেলিয়া থেকে ফেরার পর, কারও কাছে কাজের ব্যাপারে কথা বলতে যাওয়ার আগে নিজেকে টানা তিন মাস ট্রেনিং করেছিলাম। এই প্রস্তুতিটার প্রয়োজন ছিল। শুধু পেশিবহুল শরীর সর্বস্ব চেহারা থাকলেই বলিউডের গ্ল্যামার দুনিয়ায় ঢোকা যায় না। চেহারার দরকার অবশ্যই আছে, তবে তার সঙ্গে অ্যাটিটিউড এবং কাজের প্রতি সঠিক অ্যাপ্রোচটাও খুব দরকার,” সাহিল বললেন।
এই মুহূর্তে সব থেকে বড় সমস্যা হল দেশীয় ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে বিদেশি মডেলদের অবারিত দ্বার। সাহিল জানালেন, “আমরা এমন এক দেশে বাস করি যেখানে সাদা চামড়ার প্রতি অমোঘ টান। সাদা চুলের ফিরিঙ্গি মডেলদের অনেকেই এখন ভারতমুখী। তাঁরা কয়েক মাসের জন্য ভারতে আসেন, আর যতটা পারেন রোজগার করে চলে যান। তাঁদের পারিশ্রমিক খুব কম হওয়ার জন্য এই দেশের সুপুরুষ ভারতীয় মডেলদের জায়গাটা তাঁরা নিয়ে নিচ্ছেন।”
‘কর্মা’ মডেল সংস্থার শাখা রয়েছে দিল্লি এবং মুম্বইতে। সংস্থার আয়োজক মডেল হিমাংশু ভাসিনের মতে ফিরিঙ্গি মডেলদের এ দেশে আসা শুরু হয়েছে বিদেশি মহিলা মডেলদের হাত ধরে। কারণ দেশের মহিলা মডেলদের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের গণ্ডগোলের জন্য অনেক সময় বাইরে থেকে মডেল আনিয়ে কাজ করানো হত। “আন্তর্জাতিক পুরুষ মডেলরা এখন মহিলা মডেলদের দেখানো রাস্তায় ভারতে আসতে চাইছে। আমার কাছে বিদেশী মডেলদের জন্য যা আবেদন আসে তার মধ্যে পনেরো-কুড়ি জন মহিলা মডেলের চাহিদা থাকলে পুরুষ মডেলের চাহিদা থাকে মাত্র দুই থেকে তিন জন। তবে বিদেশে পুরুষ মডেলদের কর্মজীবন প্রায় চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত হলেও এ দেশে সেটা আঠাশ থেকে তিরিশ বছর পর্যন্ত সীমাবদ্ধ,” বললেন হিমাংশু।
তবে ডিজাইনার নীলের কথায় ধরা পড়ল এই ইন্ডাস্ট্রির চূড়ান্ত সত্যিটা। জানালেন, “এখন প্রতিযোগিতাটা অনেক বেশি কঠিন। শো-এর সংখ্যা অনেক কম। সেই তুলনায় প্রচুর সুদর্শন পুরুষ মডেল সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে। মডেলিং-এ অনেক ক্ষেত্রেই মহিলাদের তুলনায় পুরুষদের মধ্যেই কাজের জন্য মরিয়া হওয়ার ব্যাপারটা বেশি দেখা যায়। অনেক মডেলই ‘কাস্টিং কাউচ’ নিয়ে অভিযোগ জানান। তবে এটাও সত্যি যে এমনও অনেকে আছেন যারা একটা সুযোগ পাওয়ার জন্য যে কোনও কিছু করতেই রাজি হয়ে যান। মাঝে মাঝে হতাশা এমন জায়গায় চলে যায় যে এরা নিজেরাই বেছে বেছে সমকামী সৃজনশীল ডিজাইনারদের কাছে ধরা দেন। এই সব বেগতিক অবস্থা দেখেই অনেক সময় নিজের ডিজাইনার পরিচয়টা প্রকাশ করি না।”
|
ছবি: ডাব্বু রতনানি |
|
|
|
|
|