পাঁচতারার লবিতে কেউ খালি পায়ে ঘোরাঘুরি করে নাকি! অথচ সমুদ্রস্নানের পর বালির ওপর দিয়ে হেঁটে এলে লোকে যেমন পুরীর হোটেলে-টোটেলে ঢোকার মুখে জুতোজোড়া হাতে নিয়ে নেয়, এ ভদ্রলোকেরও তেমনই ধরা। বগলে দুটো ক্রিকেট ব্যাট।
এ কী, খালি পা কেন?
চণ্ডীগড় ম্যারিয়টের লবিতে দ্রুতই উৎসাহীদের দ্বারা ঘেরাও হয়ে যাওয়া তিনি মুখ ঘুরিয়ে বললেন, “টিটি খেলছিলাম জোর।” বোঝা গেল, স্টাড থাকা ক্রিকেট জুতো টেবল টেনিসের ফ্লোরে সমস্যা করতে পারে বলে খুলতে হয়েছিল। কিন্তু লিফটে করে নিজের ঘরে যাওয়ার আগে দশ জনের ন’জন সেটা পায়ে হালকা গলিয়ে নেবে। এত লোকের ভিড়ে ফেরা যখন!
তিনি, এমএসডি তোয়াক্কাই করেন না। কে কী বলল, কে কী ভাবল না ভাবল, পরিবর্তিত এই ক্রিকেট সমাজে তাতে আর তাঁর কিছু যায় আসে না। আপাতত যা করবেন সেটাই স্টাইল— সমালোচনা বা প্রশ্ন কোনওটাই বিরোধীদের করার জায়গা নেই। নইলে নিয়ম অনুযায়ী তো ক্যাপ্টেনের বাধ্যতামূলক প্রাক টেস্ট সাংবাদিক সম্মেলনে তাঁর এ দিন হাজিরা দেওয়ার কথা। তা সিরিজে পরপর তিনটে টেস্ট শুরুর আগের দিন ক্যাপ্টেনের নির্দিষ্ট চেয়ারে ভারতীয় মিডিয়া যাঁদের পেল: হরভজন, পূজারা আর আজকে শিখর ধওয়ান! এমএসডি খুব ভাল জানেন, বুধবার ক্রিকেট পৃথিবী ওঁত পেতে ছিল অস্ট্রেলিয়া ইস্যুতে প্রতিদ্বন্দ্বী অধিনায়কের প্রতিক্রিয়া পাওয়ার জন্য। তিনি প্রত্যুত্তরে এমন এক জনকে পাঠিয়ে দিলেন যাঁকে এই প্রশ্ন করাটাই অবান্তর। সীমাহীন ঔদ্ধত্য আর ‘যা করব, করে পার পেয়ে যাব’ এমন রোখা মেজাজ ছাড়া এটা সম্ভবপর নয়! |
এক মহিলা ভক্ত বললেন, “যাই বলুন, আপনার চুলটা কিন্তু দারুণ ছিল। কেন যে ছোট করে ফেললেন!” “করলাম কারণ এই ছাঁটটা কাজে...” সেনটেন্স অসমাপ্ত রেখে ভারত অধিনায়ক লিফটে ঢুকে পড়লেন। সেই তেজি আর অনায়াস ভঙ্গিটা দেখে মনে পড়ে যাচ্ছিল, ঘণ্টাখানেক আগে সাংবাদিক সম্মেলনে যে লোকটার মুখের ওপর টুপি অনেকটা টেনে রাখা, কোণঠাসা ভঙ্গিটা দেখে এসেছি। তার কথা!
একই পেশা। চণ্ডীগড়ে একই হোটেলবাসী। একই রকম প্রিয় যাঁর যাঁর দেশজ বোর্ডের কাছে। টেস্ট অভ্যুদয়ের সময়টাও কাছাকাছি। অথচ পৃথিবীটাই যেন গত কুড়ি দিনে বদলাবদলি হয়ে গিয়েছে এঁদের। ঘটনাচক্রে এক জনের নাম মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। আর এক জনের নাম মাইকেল ক্লার্ক!
চেন্নাইয়ে যে উন্নতশির টেস্টের দু’দিন আগে এগারো ঘোষণা করার মতো দৃপ্ত সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিল, তার সঙ্গে এই ক্লার্ককে মেলানো মুশকিল। একটা যদি সুখনা লেক হয়, অন্যটা চণ্ডীগড়ের সেক্টর সিক্সটিন পুরনো স্টেডিয়াম। ব্যাগি গ্রিন নেতা যে নীতির প্রশ্নে অনমনীয়। মোহালি টার্ফ বিদ্রোহীদের জন্য যত উপযুক্তই হোক, এখানে যে খেলাবেন না ফের জানিয়ে দিলেন। সেই সময়গুলোতে হঠাৎ করে ফিরে আসা মোবাইল নেটওয়ার্কের মতো মুখভঙ্গিতে দৃঢ়তা আসছে। পরমুহূর্তেই ঝপ করে চলে যাচ্ছে টেস্ট নিয়ে ক্রিকেটীয় প্রশ্নে।
এমনিতে ‘গ্যাং অব ফোর’ নিয়ে চলতি সপ্তাহের তুলকালাম না ঘটলে ক্রিকেট সমাজে সবচেয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকা উচিত ছিল পাগড়িওয়ালা পঞ্জাব অধিনায়কের! ‘টেল অব টু সিটিজ’-এর শেষ দিককার মতো তো পরিস্থিতি হরভজন সিংহের! উইকেটপিছু চল্লিশ রানেরও বেশি দিয়ে দু’টেস্টে পাঁচ উইকেট, তা-ও একটাই মাত্র স্বীকৃত ব্যাটসম্যানের। মনে করাই যায়, ‘নাইট কেম। দ্য চার্চ বেলস র্যাং অ্যান্ড দ্য বিটিং অব সোলজার’স ড্রামস ইন দ্য প্যালেস কোর্টইয়ার্ড কুড বি হার্ড। দ্য উইমেন স্যাট নিটিং ইন দ্য ডার্কনেস।’ ভারতীয় ক্রিকেটের সেমি-অন্ধকার অধ্যায়েও তো উল বুনতে থাকা মহিলারা ধড় গুনেই চলেছে। যুবরাজ। গম্ভীর। সহবাগ। মোহালি পরবর্তী আরও একটা সম্ভাব্য নাম সহজ ভাবে চলে আসা উচিত গিলোটিনের দিকে। |
কিন্তু সেই বাজারেই তো নিজের ওপর সহসা অন্ধকার ডেকে এনেছেন ক্লার্ক। আজ অস্ট্রেলীয় বোর্ড তাঁর সঙ্গে প্রবল ভাবে আছে খুব ঠিক কথা। ডিকেন্সের গল্পের সঙ্গে এখুনি কোনও মিল তৈরি উচিত নয়। তা বলে জনমত আর মিডিয়ার গিলোটিন বলে তো একটা কাঠামো রয়েছে!
এ দিন মনোভাব রাতারাতি বদলে যাওয়া অস্ট্রেলীয় মিডিয়ার নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুনে মনে হল, মাইকেল ক্লার্কের জীবনে কঠিনতম পরীক্ষা উদয় হচ্ছে বৃহস্পতিবার। ডাউন আন্ডার-এ সদ্যপরিচালিত দুটো গণসমীক্ষার রায় সম্পূর্ণ ক্লার্কদের বিরুদ্ধে। ক্রিকেট জনতা মনে করছে বাড়াবাড়ি শাস্তি হয়েছে। সফরকারী অজি সাংবাদিকেরা জানতাম ক্লার্কের সঙ্গে। এ দিন মধ্যাহ্নভোজের সময় এদের যা সুতীব্র সেন্টিমেন্ট শুনলাম, হুবহু তুলে দিচ্ছি: তুমি বলছ ছ’টা কারণে ওদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছ। ভাল কথা। কিন্তু তুমি নিজে যে সিরিজ জুড়ে পরপর ট্যাকটিক্যাল ভুল করে চলেছ! সেটা কে দেখবে?
(১) কাজ নেই কম্মো নেই হঠাৎ সেরা এগারো আগাম বেছে চেন্নাইয়ে ভারতের অনুমান শক্তির কাজ কমিয়ে দিলে।
(২) পিচ স্পিনার সহায়ক দেখেও চিপকে স্রেফ গোঁয়ার্তুমি করে তিন পেসার খেলালে।
(৩) ভারত যখন ব্যাট করতে নেমে ১২-২। প্যাটিনসনকে শুধু তুলেই নিলে না, সারা দিনে ওকে মাত্র ছয় ওভার করালে। অথচ ভারত একমাত্র ওকেই ভয় পাচ্ছিল।
(৪) দ্বিতীয় নতুন বলের প্রথম ওভারেও কোনও স্লিপ রাখলে না। পৃথিবীতে যা কেউ দেখেনি।
(৫) নাথন লিয়ঁ অত ভাল ডেলিভারিতে সচিনকে আউট করার পর হায়দরাবাদে বেচারিকে বসিয়ে দিলে। আবার ভুল দল নির্বাচন।
(৬) রান চোক করার ডিফেন্সিভ স্ট্র্যাটেজি এত ভেবেচিন্তে যেটা নিলে, সেটা কাজই করল না কোনও টেস্টে। মানে মডেলটাই ঠিক বাছোনি।
সিডনিবাসী সিনিয়র সাংবাদিককে উত্তেজিত ভাবে বলতে শোনা গেল, “কী প্রমাণ করতে চাইছে আমাদের ক্যাপ্টেন? যে দোষীরা প্রেজেন্টেশন জমা দেয়নি বলে আমরা ০-২ পিছিয়ে রয়েছি! সোজা কথাটা মেনে নিলেই তো হয় যে, সিরিজ-ব্যর্থতার কারণ টিমে বিশৃঙ্খলা নয়। কারণ ঘূর্ণি পিচে স্পিন খেলতে না পারা।”
প্রথম দিনের শেষে মোহালির স্কোরবোর্ড যদি দেখায় ভারত ১২৫ অল আউট হয়ে গিয়ে অস্ট্রেলিয়া ৭৭-১, এই মুখগুলো অবধারিত উল্টো কথা বলবে। যতক্ষণ তা না ঘটছে, বিপন্ন অস্ট্রেলিয়া যেন সপ্তাহ শুরুর অসম্মানিত বার্সা। তিকিতাকা আর মেসির কাল রাতে দুন্দুভি বাজিয়ে প্রত্যাবর্তন ঘটেছে। ক্লার্কের বাহিনীর জন্য কী অপেক্ষা করে রয়েছে সেই সপ্তাহই বলবে।
তাঁর— ধোনির এ সব নিয়ে ভাবার কোনও দায় নেই। তাঁর দায়ভার মধ্যিখানে তীব্রতম সমালোচনা-সমালোচনায় আক্রান্ত হতে হচ্ছিল। সেটাকে টানা জিতে উপড়ে দিতে হবে। এতটুকু। এইটুকু। |
তাই মোহালি পিচেরও ঘাস পুরো উড়িয়ে দিয়েছেন। পৃথিবীটা চক্ষুলজ্জা করার নয়, জয়ীর। সেই দর্শনেই গোটা মাঠটা মখমলের মতো সবুজ। আর খয়েরি উইকেটকে দেখাচ্ছে জলের মধ্যে বসবাসকারী দ্বীপের মতো। সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। ক্লার্ক নইলে কি আর বিষণ্ণ হেসে বলেন, “নাহ, এই সারফেসটা থেকেও আর ঘাস তোলা সম্ভব না।”
এমএসডি এ সবে কর্ণপাত করতেও রাজি নন। মোহালির পিচ প্রস্তুতকারক দলজিৎ সিংহ হলেন দেশের কিউরেটরদের মধ্যে কঠিনতম। কিছুতেই প্লেয়ারের আবদার শুনতে চান না। পঞ্জাব রঞ্জি ম্যাচে এ বার বারবার চেয়েও ভাজ্জিকে স্পিনিং ট্র্যাক বানাতে সাহায্য করেননি। কিন্তু এমএসডি-কে থামাবেন কী করে? তিনি তো অমিতক্ষমতাশালী। বকলমে বোর্ড প্রধানের আসল লোক।
আর প্রতিবাদ করবেন যে, জনতার স্মৃতিশক্তিও তো খুব অল্প। তাদের তো আর মনে করিয়ে দেওয়া যাবে না, মাত্র কুড়ি দিন আগে অতিথি সাহেবকে তোমরা বলছিলে যুদ্ধোত্তর অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম সেরা। আর এঁকে— তোমরা জানতে চাইছিলে কবে যাবে? |