রাজ্যের সর্বত্র মেয়েদের জন্য এটাই অলিখিত নিয়ম।
হিংস্রতার ভয় তাঁদের বেঁধে রেখেছে। একটি সমীক্ষার কথা জানাচ্ছেন শমিকা মাইতি |
দোকানের ঝাঁপ পড়লেই সময় শেষ— রাতের রাস্তা আর নিরাপদ নয় মেয়েদের কাছে। যে এলাকায় যখন দোকান বন্ধ হয়, সেখানে সেটাই নিরাপদে চলার শেষ সময়। বাইরের জগতের সঙ্গে এই ভাবেই বোঝাপড়া করে নিয়েছে মেয়েরা।
রাজ্যের বিভিন্ন জেলা সদরে মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে একটি সমীক্ষা করার সময় ব্যাপারটা সামনে উঠে এল। রাস্তার ধারে যত ক্ষণ দোকান খোলা তত ক্ষণ লোকজনের মুখ দেখা যায়। কলকাতায় দোকানপাট ১০টা-১১টা পর্যন্ত হামেশাই খোলা থাকে। জেলা সদরে রাত ৮টা-৯টা পর্যন্ত দোকানপাট খোলা। তার পর আর সেখানকার রাস্তা নিরাপদ নয়, সে মেদিনীপুর হোক বা তমলুক, বহরমপুর বা কৃষ্ণনগর।
প্রকাশ্য স্থানে টেলিফোন বুথ বা দোকানঘরের উপস্থিতি ছাড়াও দু’টি বিষয় নিরাপত্তাবোধকে প্রভাবিত করে। এক, পরিকাঠামো, অর্থাৎ রাস্তায় আলো আছে কি না, ফুটপাথ কেমন, ঝোপঝাড় কতটা ইত্যাদি। দুই, শ্লীলতাহানি বা নারী নির্যাতনের মতো ঘটনায় জনতার প্রতিক্রিয়া। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, শেষটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, জনবহুল রেলস্টেশনে নিরাপদ বোধ করাই উচিত, কিন্তু বাস্তবে ভিড়ের মধ্যে শ্লীলতাহানি ঘটে সবচেয়ে বেশি। দিল্লি বা মেট্রোপলিটন শহরের সাধারণ মানুষ আত্মকেন্দ্রিক হওয়ায় মেয়েরা প্রতিবাদ করার সময় সহমর্মী পান না। গ্রামে শ্লীলতাহানির মতো ঘটনা সামাজিক লজ্জার মোড়কে চেপে দেন গ্রামবাসীই। তাই মেয়েদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে হলে আগে সমাজের মানসিকতা বদলাতে হবে।
|
এখনও মেয়েদের উপরে অত্যাচারের যত ঘটনা ঘটে তার ৪১ শতাংশই স্বামী বা পরিবার পরিচিতদের হাতে (নথিভুক্ত পরিসংখ্যান মাত্র)। কাছের মানুষই যেখানে সম্মান দিতে পারেন না, সেখানে বহির্জগতে নিরাপদ বোধ করা কঠিন। সিঁটিয়ে থাকা মেয়েরা তাই ঘুরপথ খোঁজেন রাতে। কখনও বা ফেরার পথে সঙ্গ দিতে ডেকে নেন বাবা, ভাইকে। ‘আঁধার-পথে’ নামে সমীক্ষাটি করা হয়েছিল রাজ্যের ১০টি জেলা সদরে। কথা বলে দেখা গেল, কাজের সূত্রে যাঁদের বাড়ি ফিরতে রাত হয়, সমস্যাটা সবচেয়ে বেশি তাঁদেরই। বাস বা ট্রেনে ফেরার সময় পাশে লোকজন থাকে। কিন্তু স্টেশন বা বাসস্টপে নামার পরেই নিরিবিলি রাস্তা। তমলুকের বধূ ভাস্বতী বেরা খাটুয়া হলদিয়ার স্কুলে চাকরি করেন। বাস পেতে দেরি হলে মাঝেমধ্যেই রাত হয়। বললেন, “রাতে লোকজন কমে যায়। পুলিশি পাহারাও থাকে না। নির্জন রাস্তায় চলতে ভয় করে। দ্রুত পায়ে পাড়ায় ঢুকে গেলে হাঁফ ছাড়ি।”
কখনও কখনও ‘সামাজিক’ অবস্থান বদলে দেয় নিরাপত্তার সংজ্ঞা। অবিবাহিত তরুণী বা স্বামী বিচ্ছিন্নাদের ক্ষেত্রে অনেক সময় নিজেদের পাড়াতেই সবচেয়ে বেশি হেনস্থার মুখে পড়তে হয়। রাত করে ফিরলে পড়শির বাঁকা হাসি, চোখা মন্তব্য কানে আসবেই বলছিলেন উত্তর ২৪ পরগনার জেলা সদর বারাসতের এক তরুণী। তুলনায় অপরিচিত এলাকা নিরাপদ মনে হয় কল সেন্টারে কর্মরত ওই তরুণীর কাছে।
ফারাক তৈরি করে বয়সও। কমবয়সি স্কুল বা কলেজ ছাত্রীরা চিরকালই টীকা-টিপ্পনির ‘সফ্ট টার্গেট’। রাতে টিউশন তাই এড়িয়ে চলে স্কুল-কলেজ ছাত্রীরা। পুরুলিয়ায় কুকস কম্পাউন্ডের ফাঁকা রাস্তায় দল বেঁধে গেলেও অশ্লীল মন্তব্য শুনতে হয় বলে জানালেন পুরুলিয়া শহরের তরুণী সুদীপ্তা দত্ত।
গ্রামাঞ্চলে বাড়ি ফেরার সময়টা শেষ হয় সূর্য ডুবলেই। বলছিলেন কাজের সূত্রে সদ্যই কলকাতায় আসা তরুণী শম্পা জানা। বাড়ি মুর্শিদাবাদের প্রত্যন্ত গ্রামে। “আমাদের গ্রামে সূর্য ডোবার এক-আধ ঘণ্টা পরেই রাস্তাঘাট ফাঁকা। সন্ধেয় একটাই টিউশন ছিল আমার। বাবা আনতে যেত। কোনও দিন যেতে না পারলে ভয়ে-ভয়ে ফিরতাম। অথচ, ভয় করার মতো সত্যিই কিছু ছিল না কিন্তু।”
এই ভাবেই হিংসার চেয়ে হিংস্রতার ভয় মেয়েদের জীবনযাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করে বেশি। সত্যিই মেয়েদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে হলে সবার আগে ভয়শূন্য ভাবে চলাফেরার অধিকার দিতে হবে—আর পাঁচটা ছেলের মতো— সাধারণ মানুষের মতো। |