প্রবন্ধ ১...
আয়: ৫/৫, ব্যয়: ৩/৫
অমিতবাবুকে দেব দশে আট
র্থনীতির ছাত্র হিসেবে রাজ্য-বাজেট নিয়ে কোনও দিনই তেমন উত্তেজনা অনুভব করিনি। কেন্দ্রীয় বাজেট বরাবরই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, যদিও আজকাল তার গুরুত্বও কমে গেছে অনেকখানি। আগে সবাই তাকিয়ে থাকত কোন জিনিসের দাম বাড়বে আর কোনটার কমবে। এখন যেহেতু সারা বছর ধরেই দাম বাড়তে থাকে, রহস্য ও প্রত্যাশা কোনওটারই তেমন স্থান নেই। কিন্তু এ বারের পশ্চিমবঙ্গের বাজেট নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তার প্রধান কারণ দুটো।
প্রথমত, নতুন সরকার একটু গুছিয়ে বসার পর এটাই প্রথম বাজেট। দ্বিতীয়ত, আমাদের কোষাগারের অবস্থা কেমন, কী ভাবেই বা অর্থমন্ত্রী বিশাল ঋণের ধাক্কা, খরচার ধাক্কা সামলাচ্ছেন, তার একটা হিসেব এবং অদূর ভবিষ্যতে কী হতে চলেছে, তা নিয়ে প্রত্যাশা বা দুশ্চিন্তা করার মতো প্রথম সরকারি দলিল এই বাজেট।
বাজেট প্রস্তাব পেশ করার আগে গত বছরের আয়ব্যয়ের সম্যক আলোচনা করেছেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু তার আগেই এ সম্পর্কে কিছু প্রামাণ্য তথ্য পাওয়া গেছে সদ্য প্রকাশিত রিজার্ভ ব্যাঙ্কের রাজ্য-ভিত্তিক রাজস্ব ও খরচা সম্পর্কিত রিপোর্টে। সত্যি কথা বলতে কী, এ বিষয়ে যে-কোনও অর্থনীতির ছাত্রছাত্রীই মাননীয় অর্থমন্ত্রীকে তাঁর সাফল্যের জন্য বাহবা দেবেন। এক নজরে দেখে নেওয়া যাক কী করেছেন তিনি বা কী হয়েছে তাঁর অভিভাবকত্বে।
২০০৪-২০১২, এই আট বছরে পশ্চিমবঙ্গে রাজস্ব এবং সামগ্রিক আয়ের অনুপাত ছিল গড়ে দশ শতাংশ মতো। ২০১২-২০১৩-তে আশা করা যাচ্ছে এই অনুপাত ১২ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। গত বছরের তুলনায় শতকরা ৩০ ভাগের উপর রাজস্ব আদায় বেড়েছে। তার একাধিক কারণ আছে, কিন্তু এই সাফল্যের পিছনে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে কর আদায় প্রক্রিয়ায় তথ্য-প্রযুক্তির ব্যাপক প্রয়োগে এবং কর দেওয়ার ব্যাপারে প্রচুর সুবিধা করে দেওয়ার আয়োজন।
অভিনন্দন? সহকর্মীদের সঙ্গে অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র। ১১ মার্চ, ২০১৩
রাজ্যের আয় দেশের আয়ের চেয়ে বেশি হারে বেড়েছে, কিন্তু কর আদায় ও ব্যবস্থা সম্পর্কিত প্রক্রিয়ায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন ছাড়া এটা সম্ভব হত না। ২০০৪-২০১২ পর্যন্ত রাজ্যের রাজকোষ ঘাটতি (ফিসকাল ডেফিসিট) ছিল গড়ে ৪ শতাংশের কিছু বেশি, সেটা কমে ২০১২-২০১৩-তে ২.৫ শতাংশ দাঁড়াবে। ভারতের সবচেয়ে বেশি ঘাটতি আছে এমন প্রথম তিনটি রাজ্যের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের স্থান পাকা হয়ে গিয়েছিল গত দশ বছরে। ২০১২-২০১৩-তে কিন্তু রাজ্য নীচের সাতটি রাজ্যের মধ্যে একটি। অর্থাৎ, দশটি রাজ্যের ঘাটতি পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে বেশি।
যে কোনও অর্থমন্ত্রীর পক্ষে বিশাল ঋণের বোঝা একটা দুঃস্বপ্নের মতো। কিছু দিন আগেও পশ্চিমবঙ্গে যা রাজস্ব আয় হত, তার প্রায় একশো ভাগ বা তার চেয়েও বেশি ছিল ‘কমিটেড এক্সপেন্ডিচার’, অর্থাৎ যে খরচা না করলেই নয়, যেমন মাইনে, পেনশন ইত্যাদি ইত্যাদি। আজ সেই ধরনের খরচা রাজস্ব সংগ্রহের অনুপাতে অনেকটাই কমে এসেছে, এ ক্ষেত্রেও রাজস্ব বৃদ্ধির সুফল দেখছে এই রাজ্য।
তর্ক উঠতে পারে, খানিকটা ধার তো বেড়েছেও, ধার করতে হচ্ছে আরও। এখানে দুটো বিষয় পরিষ্কার হওয়া উচিত।
, নতুন সরকারের একমাত্র দায়িত্ব নিশ্চয়ই পুরনো সরকারের ঋণ শোধ করা নয়। ঋণশোধের সঙ্গে সঙ্গে নতুন ঋণের প্রয়োজন হয়, কারণ রাজস্বের অনেকটাই পুরনো ঋণশোধে বেরিয়ে যাচ্ছে। উন্নয়ন ও পরিকল্পনামূলক খরচ না করলে নতুন সরকারের কাজকর্ম থমকে যাবে।
, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ঘাটতি সূচকের পরিমাপে গত দশকের তুলনায় ২০১২-১৩-র হিসেব অনেক আশাপ্রদ, যে-কোনও ঘাটতি সূচকেই তা বোঝা যাচ্ছে। মনে রাখতে হবে, ঘাটতি সূচকের যে অনুপাত, তার নীচের অংশে রাজ্যের আয়বৃদ্ধির প্রভাব পড়ে। ফলে যে-কোনও বাড়তি ঘাটতি যদি আয়বৃদ্ধিতে সহায় হয়, তা হলেই সূচক নিয়ন্ত্রণে থাকবে। পশ্চিমবঙ্গের গল্পটা কিছুটা এ রকমই।
এ তো গেল গত বছরের হিসেব। এতে দশে পাঁচ থাকলে অর্থমন্ত্রী পাঁচে-পাঁচ পেয়ে যেতেই পারেন। আগামী বছরে বাজেট বরাদ্দে কৃষি এবং কৃষি সম্পর্কিত সমস্ত ক্ষেত্র প্রচুর গুরুত্ব পেয়েছে। কৃষিজাত দ্রব্যের বিপণন, শিল্পসম্পর্ক স্থাপন এবং স্বভাবতই পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়নে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ হয়েছে। পর্যটনে যোজনা বরাদ্দ ২০০০ থেকে ২০০৯-১০ পর্যন্ত খুবই কম ছিল, এ বছর বেড়েছে সুপ্রচুর। অর্থমন্ত্রী আশা করছেন, এই বাজেটে কর দেওয়ার ব্যাপারে ছোট ব্যবসায়ী, অসংগঠিত ব্যবসায়ী এবং সবাইকে সবসময় চোখে চোখে রাখার নিয়মকে শিথিল করায় কর দেওয়ার প্রবণতা আরও বাড়বে। খুব কম ও খুব বেশি করের ক্ষেত্রে তিনি ‘ভ্যাট’ বা যুক্তমূল্য কর খানিকটা বাড়িয়েছেন। কারণ, কর দেওয়ার ব্যাপারে প্রচুর সুবিধে করে দেওয়ায় ব্যবসায়ীরা একটু বেশি কর দিতে চাইবেন, অর্থনীতি এটাই বলে।
তবু আমি অর্থমন্ত্রীকে দশে দশ দিতে পারছি না। সমাজকল্যাণমূলক কাজকর্মে সরকারের নীতিকে যোগ্য সম্মান দিয়েছেন তিনি, এ কথা সত্যি। কিন্তু একটি বিশেষ প্রকল্প অর্থনীতির বিচারে যুক্তিযুক্ত হবে বলে মনে হয় না। ‘যুব উৎসাহ প্রকল্প’র মাধ্যমে অর্থমন্ত্রী ১৮ থেকে ৪৫ বছর বয়সের মধ্যে ক্লাশ এইট পাশ করা বেকার মানুষজনকে মাসে ১৫০০ টাকা করে বেকার ভাতা দেবার ব্যবস্থা করছেন। বেকার ভাতা দেওয়ার রীতি অনেক দেশেই আছে, কিন্তু এখানে এ ব্যবস্থার অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণ শক্ত। এখানে যাঁরা এমপ্লয়মেন্ট ব্যাঙ্কে নাম লেখাবেন, তাঁরা মাসে ১৫০০ টাকা পাবেন। এক লক্ষ লোক যদি এক বছর এই সুবিধে পান, তা হলে ১৮০ কোটির ধাক্কা। কিন্তু প্রশ্ন হল, যদি কেউ অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ পেয়েও নিয়মিত বেকার ভাতা নিতে থাকেন, কী ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে সেই সমস্যা? যাঁরা কাজ পেয়ে গিয়েছেন, তাঁদেরও যে ১৫০০ টাকা দিতে হচ্ছে না, সেটা বিচার হবে কী ভাবে? ক্লাশ এইট পাশের পর পেশাদারি দক্ষতা অর্জনের সময় কিছু দিন ১৫০০ টাকা দেওয়া হলে হয়তো ভাল হত। তাতে কাজ খোঁজার প্রবৃত্তিকে উৎসাহ দেওয়া হত। কাজ খোঁজার নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করে ভাতাটিকেও সেই সময়সীমার জন্য দেওয়া হলে হয়তো তার একটা মানে হত। হয়তো প্রকল্পটি বিশদ ভাবে ব্যাখ্যা করলে আরও একটু পরিষ্কার হবে। কাজ খোঁজার সময় সরকারি সাহায্য অবশ্যই প্রয়োজন, বিশেষ করে আর্থিক ভাবে দুর্বল যাঁরা— তাঁদের। কিন্তু প্রকল্পটির অপব্যবহারের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।
যাঁরা রাজ্য উন্নয়ন পর্ষদের কাজকর্মের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত, তাঁরা জানেন যে, রাজ্য সরকারের বার্ষিক পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজকর্মের পরিমাণ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুপ্রচুর এবং কেন্দ্রীয় সরকারের সাহায্য সংবলিত অনেক প্রকল্পে রাজ্য সরকারের যৌথ দায়িত্বের আর্থিক পরিমাণ কম নয়। প্রচুর কাজের খরচও প্রচুর। তাই ঋণের সাহায্য ব্যতিরেকে কিছু করা সম্ভব নয়। সেই ঋণকে রাজ্যের আয়বৃদ্ধির তুলনায় বা রাজস্ব সংগ্রহের তুলনায় নিয়ন্ত্রণে রাখার সুপ্রচেষ্টায় শতত নিয়োজিত অর্থমন্ত্রক। গত বছরের হিসেবে রাজস্ব ঘাটতি একটু বেড়ে যাওয়ার যে ঝোঁক দেখা দিচ্ছে, আগামী বছর সেই সমস্যা খানিকটা নিয়ন্ত্রিত হবে বলে আশা করা যায়।

কলকাতায় সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশাল সায়েন্সেস-এ অর্থনীতির শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.